রান্নার পাট শেষ হলে ইন্দুবালা ওপরের ঘরের তাক থেকে পাড়লেন গতবারের তেঁতুলের আচার। আসন পেতে লছমীকে যত্ন করে খাওয়ালেন। ফেরার সময় বাকি পয়সা ফেরত দিতে গেলে লছমী বললো, “এ কীরম বাত হলো মাজি? কাল যে আবার খাবো। হর রোজ পয়সা দেব না কি তোমায়? ওটা তুমি রেখে দাও”। লছমী সেই যে গেল পরের দিন ফিরে এলো আরও তিন জনকে সঙ্গে নিয়ে। এইভাবে আস্তে আস্তে বাজারের সবাই এসে খাওয়া শুরু করলো ইন্দুবালার নীচের ঘরে। একদিন উড়িষ্যা থেকে এলো ধনঞ্জয়। কেউ তাকে ডাকেনি। কেউ কথা বলেনি। দরজার কাছে শুধু ভাত খাওয়ার জন্য বসেছিল বেচারা। বড় মায়া হয়েছিল তাকে দেখে ইন্দুবালার। ওই বয়সের একটা ভাই ছিল যে তার। যুদ্ধের সময় খান সেনারা জ্বালিয়ে দিয়েছে নাকি তাকে। আর একটুও মনে করতে চাননি সেসব কথা। অনেকটা ভাত আর ডাল দিলে চেটে পুটে খেয়ে নিয়েছিল সবটা ধনঞ্জয়। ছেলেদের খাইয়ে, মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে রান্নাঘর পরিষ্কার করতে এসে ইন্দুবালা দেখেছিলেন সব কিছু সাফসুতরো। থালা বাটি বোয়া। এমনকি মাটির উনুনটা পর্যন্ত সুন্দর করে ল্যাপা। সেই থেকে ইন্দুবালার সংসারে থেকে গেল উড়িষ্যার কোন এক খরাপীড়িত অজ গাঁয়ের ধনঞ্জয়। সিঁড়ির নীচটা সাজিয়ে নিল তার নিজের মতো করে। সেখানেই থাকতে শুরু করলো সে। একদিন হঠাৎ রান্নার গন্ধে চলে এলেন সামনের কালেক্টর অফিসের বড়বাবু। ইন্দুবালার হাতের রান্না খেয়ে তাঁর কবেকার মরে যাওয়া মায়ের কথা মনে পড়লো। নিদান দিলেন তাঁর অফিসের সবাই এখানে খেতে আসবে। শুধু তাই নয় নিজে থেকে খুশি হয়ে একটা হলুদ রঙের এনামেল বোর্ড টাঙিয়ে দিয়ে গেলেন ইন্দুবালার বাড়ির বাইরের দরজার ঠিক ওপরে। সেখানে জলজল করে লেখা থাকলে ইন্দুবালা ভাতের হোটেল। পুরসভা থেকে লাইসেন্স হলো। দুই ছেলে বড় হলো। তারা দিব্য লেখাপড়া শিখে সুন্দর বিয়ে করে টুপটাপ সরে পড়লো। মেয়ে গেল জামাইয়ের সাথে পাঞ্জাবে, হিল্লিতে দিল্লিতে ঘুরে ঘুরে সংসার করতে। ইন্দুবালা একা থেকে গেলেন তাঁর ভাতের হোটেল নিয়ে। একদম একা।
একা কেন থাকলেন? তার একটা বিস্তৃত ব্যাখ্যান দেওয়া যেতই। গল্পের পরিসর জটিল করার জন্য প্যাঁচ পয়জার কম ছিল না। কিন্তু তাহলে এক তরফা ইন্দুবালার কথা শুনলে চলতো না। তার সাথে তাঁর দুই ছেলে এবং এক মেয়ের কথাও শুনতে হতো। চার পক্ষের কথা শুনলে মনে হতো বাঙালির চেনা গল্প। মা মানিয়ে নিতে পারছেন না ছেলেদের সংসারে। কেমন যেন পরপর মনে হচ্ছে নিজেকে। আজ পর্যন্ত সংসারের যে চাবিটা নিজের আঁচলের খুঁটে বাঁধা থাকতো তা যেন চলে গেছে অন্য কারো হাতের মুঠোয়। ওদিকে ছেলেরা বলতো মা বড় বেশি নিজের মতো করে চলতে চাইছে। কারও কথাই শুনছে না। বয়সেরও তো একটা ছায়া নিবিড় শান্তি আছে। কিন্তু ইন্দুবালার নিজের থেকেই সেসবের কোনো বালাই ছিল না। আর কোনো কালেই তো মেয়ের বাড়িতে বাঙালি মায়েরা থাকতে খুব আহ্লাদিত হননি। সব সময় কিন্তু কিন্তু করেছেন। কাজেই মেয়ের দিকের দরজায় অনেক আগেই খিল তুলে দিয়েছিলেন ইন্দুবালা। যদিও খোঁজ খবর নেওয়া, এসে দেখাশুনো করা এই সবই তারা করেছে। এমনকি মায়ের নিয়মিত ডাক্তারি চেক-আপও। নাতিরাও আহ্লাদ করে নাত বউ নিয়ে আসে মাঝেমাঝে। ঠামুনের খবর রাখে। কিন্তু বুড়ি নিজে এইসব জাগতিক মায়ার ছেদো বাঁধনে একটুও আটকা পড়তে চান না। একদিনও ভাতের হোটেল বন্ধ হয়নি লছমীর খাওয়ার দিন থেকে। বন্যা, কলেরা, ডেঙ্গু, দাঙ্গা, কারফিউ কোনো কিছুতেই ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের উনুনে আঁচ নেভেনি। ভাঁড়ারে বাড়ন্ত হয়নি চাল। বাড়ির পেছনের বাগানের কুমড়ো শাক। আজ ইন্দুবালার বয়েস যখন সাতের ঘর ছুঁয়ে ফেলেছে তখন ছেলেরা মাকে এই ব্যবসা বন্ধ করতে বললে, নিজের হাতে রান্না-বান্না না করার ফরমান জারি করলে অশান্তি বাধে কালবৈশাখীর মতো। ফলে বেশ কিছুদিন মুখ দেখাদেখি বন্ধ থাকে দু-পক্ষের। তখন শিব রাত্রির সলতের মতো বিজয়া, পয়লা বৈশাখের নমস্কারটুকু টিকিয়ে রাখে নাতি-নাতনিরা। ছেলেরা দূর থেকে ফোন করে খবর নেয়। ধনঞ্জয়কে বকাঝকা করে মায়ের ঠিক মতো দেখাশুনো করার জন্য। আর ইন্দুবালাও তখন নিজের সামনে একটা পাঁচিল তুলে দেন। অভিমানের আদান প্রদান বেশ কিছুদিন অব্যাহত থাকে। কিন্তু তার মধ্যেই ইন্দুবালার রান্নাঘরে মরশুমি পদের কোনো বিরাম হয় না। সেখানে কৌটো ভর্তি হতে থাকে পৌষের পিঠেতে। বর্ষায় ভাপা ইলিশে। গরমের মুড়ি ঘন্টতে। ধনঞ্জয় সব দিয়ে আসে বুড়ির নাম করা টিফিন কৌটোতে ছেলে-মেয়ে প্রত্যেকের বাড়ি-বাড়ি। পূর্ণিমায় বুড়ির গাঁটে বাতের ব্যথা বেড়ে যায়। অমাবস্যায় হাঁটতে পারেন না প্রায়। তবু মলম লাগিয়ে গরম জলের সেঁক নিয়ে রান্না করেন ইন্দুবালা। অতগুলো লোক আসবে। আঙুল চেটে চেটে খাবে। বায়না করবে একটু শুক্তোর জন্য। একটু মাছের মাথা দিয়ে করা ডালের জন্যে। পরিতৃপ্ত চাঁদপানা মুখগুলো দেখতেও ভালো লাগে যেন। এদের খাইয়েও সুখ। ইন্দুবালা তাই কোনোদিন কোনো তীর্থে যাননি। ধম্মে কম্মো করেননি। ঠাকুরের কথামৃতের বাণী মনের মধ্যে আউড়ে গেছেন। নারায়ণ সেবা। জীবে প্রেম।