ইন্দুবালার শরীর এখন বেশ ভালো। আদৌ কখনও খারাপ হয়েছিল কিনা বোঝা যায় না। তেলের মধ্যে আমগুলো যখন বেশ চুবো চুবো হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, প্রদীপ তার বউকে নিয়ে এলো একদিন। সেদিন যে কথাটা পাড়া হয়নি এবার বলেই ফেললো সাহস করে। “যাবে মা আমাদের সাথে বাংলাদেশ?” ইন্দুবালা খুব যে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছিলেন তেমনটা নয়। এঁচোড় কাটছিলেন হাতে তেল মেখে আঠা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে। কুটনো কাটা থেমে গেল তাঁর। বিয়ের পরে যখন দেশ থেকে এসেছিলেন তখন সেটা ছিল পূর্ব পাকিস্তান। আর আজ সেটা বাংলাদেশ। তাঁর ছেলে বলছে মাকে একবার বাংলাদেশ ঘোরাবে। সত্যি কানে ঠিক শুনছেন তো তিনি? কোনো ছলনায় এরা আবার এসে জোটেনি তো এই সাত সকালে? উঠে পড়েন ইন্দুবালা। পড়ে থাকে আধ কাটা এঁচোড়। ডালনার না কাটা আলু। মোচা। আরও অনেক তরিতরকারি। ছেলের কাছে এগিয়ে এসে জানতে চান “হঠাৎ বাংলাদেশ যাওয়ার কথা বলছিস কেন? আমি না মরা পর্যন্ত এই বাড়ি তোমরা বিক্রি করতে পারবে না বড় খোকা”। প্রদীপ হো হো করে হাসে। “তুমি কী করে ভাবলে আমি বাড়ি বিক্রি করার জন্য তোমাকে বাংলাদেশের লোভ দেখাবো?” ইন্দুবালার বিশ্বাস হয় না বড় ছেলের কথা। “এই তো সামনের চক্কোত্তিবাড়ির মেয়ে দুটো বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিয়ে বাড়ি বিক্রি করে ফ্ল্যাট তুলে দিলো।” সম্পূর্ণা এবার এগিয়ে আসে। ইন্দুবলার বড়ছেলের বউ কম কথা বলে। কিন্তু যেটুকু বলে কাটা কাটা, তীক্ষ্ণ, নুন ছড়ানোর মতো। “আপনি ভুল বুঝছেন মা। চক্কোত্তি বাড়ির সাথে আপনার ছেলে-মেয়েদের গোলাবেন না। আমরা বাংলাদেশের ট্যুর প্ল্যান করছিলাম। আপনার ছেলে তাই ভেবেছিল আপনি গেলে আমাদের ভালো লাগবে। ও তো কোনোদিন দেখেনি…। কলকাতা স্টেশন থেকে এখন ট্রেনও ছাড়ছে। মৈত্রী এক্সপ্রেস। এর মধ্যে বাড়ি বিক্রির কথা আসছে কী করে? আর আমাদের সবার তো বাড়ি আছে মা…।” ট্রেন ছাড়ছে বাংলাদেশের জন্য এই বড় খবরটা ইন্দুবালার কাছে ছিল না এতদিন? “ট্রেনে করে যাওয়া যাবে খুলনা?” বড় ছেলে বলে যাবে। ইন্দুবালা প্রশ্ন করেন “জানলার ধারে সিট পাবো খোকা?” প্রদীপ জানিয়ে দেয় “পাবে। একটা কূপ রিজার্ভ করে নেবো মা। সেখানে আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ থাকবে না।” কেমন যেন ফুরফুরে মেজাজের হয়ে যান ইন্দুবালা। বাড়ির সামনের তুলসী মঞ্চটাকে স্পষ্ট দেখতে |||||||||| পান। মাকে…বাবাকে…ঠাম্মাকে…ভাইকে…মনিরুলকে…।
বড় ছেলে, বউকে এঁচোড়ের ডালনা, মোচার ঘন্ট, পাবদার ঝোল আর কাঁচা আমের চাটনি খাইয়ে বাড়ি পাঠান ইন্দুবালা। সঙ্গে দিয়ে দেন এক শিশি আম তেল। ভাত খেতে আসা কালেক্টর অফিসের কেরানি থেকে শুরু করে সামনের মেসের ছেলেগুলো এমনকি পাগলা পাঁচুও জেনে যায় ট্রেনে করে ইন্দুবালা বাংলাদেশ যাবেন। সারা রাত ওপরের ঘরে খটর মটর করে কীসের যেন আওয়াজ হয়। ধনঞ্জয় যতক্ষণ জেগেছিল শুনেছে। অনেক ভোরে ইন্দুবালার ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে যায় তার। “কী হয়েছে মা? এত ভোরে?” চোখ কচলায় ধনঞ্জয়। দেখে ইন্দুবালার পরিপাটি করে চুল বাঁধা। নতুন কাপড় পরা। কোথাও যাওয়ার প্রস্তুতি। “কী হলো কি মা তোমার? নাতি পাসপোর্টের ফটো তোলার জন্য তোমাকে নিয়ে যাবে বেলা নটায়। এখন থেকে কাপড় পরে বসে আছো কেন?” ইন্দুবালা হুকুমের সুরে বলে “একটা ট্যাক্সি ডাক। আমি কলকাতা স্টেশন যাবো।” ধনঞ্জয় বলে “এ্যাঁ? এতো সকালে কলকাতা স্টেশনে? দেশে যাওয়ার নামে তোমার মাথা কি সত্যিই খারাপ হলো?” ইন্দুবালা কোনো কথা না বলে দরজার দিকে এগোলে কোনোরকমে উঠে জামা পরে দৌড় লাগায় ধনঞ্জয়। এই মুড তার অনেক দিনের চেনা। বেশি কথা বললে জেদ আরও বাড়বে। নিজেও চলে যেতে পারে। তখন হিতে বিপরীত হবে। দাদাবাবুদের কাছে কৈফিয়ৎ দিতে দিতে জান কাবার হবার জোগাড়। তাই কথা না বাড়িয়ে একটা ট্যাক্সি ডেকে নিজেও চেপে বসে ধনঞ্জয়।
দুটো প্ল্যাটফর্ম টিকিট কাটা হয়। ইন্দুবালা বলেন “জিজ্ঞেস কর মৈত্রী এক্সপ্রেস কোন প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে?” একজন টিটি দেখিয়ে দেয়। “ওই তো… দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ওদিকে তো যেতে পারবেন না। সময় হয়নি এখনও। টিকিট আছে তো? পাসপোর্ট, ভিসা? সব চেক হবে কিন্তু।” ইন্দুবালার ওইসব কিছু নেই। তিনি দূর থেকে দেখেন মৈত্রী এক্সপ্রেসকে। ট্রেনের গায়ে বড় বড় করে বোর্ডে লেখা কলকাতা-খুলনা। কিন্তু সেই আগের ট্রেনটার মতো সবজেটে নয়তো। কেমন যেন ধূসর নীল। ইন্দুবালার বিশ্বাস হয় না। এবার নিজেই এগিয়ে যান টিটির কাছে, “আচ্ছা আপনি ঠিক বলছেন তো ভাই? এই ট্রেনটাই যাবে খুলনা?” বিরক্ত হয় টিটি। একে ইন্টারন্যাশানাল ট্রেন। তার ওপরে ঝক্কি আছে অনেক। সিকিউরিটির দিকে সব সময় খেয়াল রাখতে হয়। তার মাঝে কিছু লোক এসে দেশ দেশ করে এমন ন্যাকামো করে না। ঝাঁঝিয়ে বলে ওঠে, “দেখতেই তো পাচ্ছেন লেখা আছে সব কিছু”। ইন্দুবালা অবাক হন নাতির বয়সী ছেলেটার বিরক্তি দেখে। “ওকি রেগে যাচ্ছো কেন বাবা? ধনা, ওনাকে দুটো নাড়ু দে। ট্রেন দেখতে আসলে কেউ এরম করে বকে?” কী বলবে বুঝতে পারে না বছর সাতাশের অখিলেশ। নতুন চাকরির প্রথম পোস্টিং তার। হাতে নাড় নিয়ে দিদার মতো এক মহিলাকে একটু দূর থেকে ট্রেনটা দেখতে বলে এগিয়ে যায় সে নিজের কাজে। ইন্দুবালা অবাক হয়ে দেখেন ট্রেনটাকে। এর কত ভাগ্য। কতবার ছুঁয়ে আসছে দেশটাকে। আর তিনি? সেই যে চলে এসেছিলেন আর একটি বারের জন্যেও যাওয়া হয়নি। বলা যেতে পারে যাননি। ধনঞ্জয় তাড়া দেয় “হলো মা তোমার? হোটেলের দেরি হয়ে যাবে যে। রান্না বসাবে কখন?”। ইন্দুবালা ধমকান, “তুই থাম। কিচ্ছু দেরি হবে না। সব আমি সামলে নেবো। কী জানিস তুই এই ট্রেনের?” ধনঞ্জয় মনে মনে ভাবে জানার আর কী আছে? সেও তো দেশের বাড়িতে ট্রেনে করেই যায়। আর মা এখন আদেখলার মতো ট্রেন ঘুরে ঘুরে দেখছে। যেন কোনোকালে ট্রেন দেখেনি। ইন্দুবালার ইচ্ছে করছিল একবার ট্রেনটার গায়ে স্পর্শ করতে। দুই দেশের মধ্যে যখন সব যোগাযোগ বন্ধ তখন সেই সবজেটে ট্রেনটাই কি একটা থমকে থাকা সময়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকতো না শিয়ালদার স্টেশনে? মাঝে মাঝে লছমীর সাথে শুধু সেই ট্রেনটাকে দেখবেন বলে চলে আসতেন ইন্দুবালা। সেই ট্রেনের গায়ে হাত দিলে তিনি তার দেশকে দেখতে পেতেন। গ্রামটাকে দেখতে পেতেন। গন্ধ পেতেন মায়ের আঁচলের। প্ল্যাটফর্ম এখনও ফাঁকা। ছোকরা টিটিকেও দেখা যাচ্ছে না আর। ইন্দুবালা আরও এগিয়ে যান ট্রেনটার দিকে। কাঁপা কাঁপা হাতে স্পর্শ করেন তার গা। কিন্তু কোথায়? ভেসে আসছে না তো তার দেশের গন্ধ। কলাপোতার গ্রাম। বোসদের পুকুর। কপোতাক্ষ নদ। ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকির মিটমিট করে জ্বলে থাকা। না না না এই ট্রেন তাঁর সেই সবুজ কাঁচা আমতেল রঙের ট্রেন নয়। এই ট্রেনে করে তিনি দেশ ছেড়ে আসেননি। এই ট্রেন তাঁর দাদুকে শেষবারের মতো নামিয়ে দেয়নি কপোতাক্ষের ধারে। এই ট্রেন তো এখন বেড়াতে যাওয়ার। দেশে ফেরার নয়। উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করা নয় সবচেয়ে কাছের মানুষগুলোকে দেখার জন্য। চোখ দিয়ে টিপটিপ করে বৃষ্টির মতো পড়তে থাকে জল। অনেক দিন আগে একাত্তরে তাঁদের কলাপোতার বাড়িটা পুড়িয়ে দিয়েছিল খানসেনারা। বাড়ির সাথে পুড়েছিল মা, ভাই আরও অনেকে। সেই চিতাভস্ম আর হাজার হাজার শহীদের রক্তে যে দেশটা গড়ে উঠেছে নতুন করে সেখানে আজ গিয়ে দাঁড়ালে তাঁর বাড়িটাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না ইন্দুবালা নিশ্চিত জানেন। এবার যদি গিয়ে গ্রামটাকেই না খুঁজে পান? যদি বোস পুকুরটাই আর না থাকে? কপোতাক্ষের ঘাট? মনিরুলের বাড়ির উঠোন? বড় মাঠের ফলসা গাছ? তাহলে কার কাছে ফিরে যাবেন ইন্দুবালা? কার আঁচলে মুখ লুকোতে? যারা ছিল অথচ আজ নেই? নাকি যারা মরেও বেঁচে আছেন ইন্দুবালার মধ্যে? নীরবে কাঁদেন ইন্দুবালা। কোনো সদুত্তর পান না অন্তর থেকে। শুধু এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়া মানুষদের ভিড় বাড়ে। পাসপোর্টে ছাপ পড়ে। বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে ইমিগ্রেশন পার করে মানুষ। এক সময়ে যে দেশটা নিজের দেশ ছিল সেটারই বেড়া টপকায়। প্রত্যেক বছর বৃষ্টি আসে নিয়ম করে দু দেশেই। তবুও সীমান্তের দাগ মুছে যায় না সেই জলে। ওটা ইন্দুবালার দাদুর স্বপ্ন হয়েই থেকে যায়।