চাকরি পাওয়ার পর যেদিন প্রথম সে বাড়ি থেকে বেরোলো বড় মন কেমন করেছিল। ভাই, বোন এমনকি ধনাদা পর্যন্ত গিয়েছিল তার দিল্লির কোয়ার্টার গুছিয়ে দিতে। মা একবারও যায়নি। বিয়ের আগেও না। পরেও না। কেউ নড়াতে পারেনি তাকে এই বাড়ি ছেড়ে। হোটেল বন্ধ থাকা মানে যেন মায়ের প্রাণ চলে যাওয়া। ভাই আর খুকি বুঝিয়েছিল দাদাকে। মা যেমন আছে থাক। মেনে নিয়েছিল প্রদীপ। কিন্তু এখন তার মাঝে মাঝেই ভয় হয় এই বয়সে অতটা আগুনের সামনে একটা বিপদ যদি হয়ে যায়। কলকাতায় পোস্টিং হওয়ার পরে এমনও হয়েছে সপ্তাহে দুবারও এসেছে সে। কিন্তু লক্ষ্য করেছে তাতে মা বিরক্ত হয়। ভাবে বুঝি নজর রাখতে এসেছে ছেলে। মার পছন্দ হয় না এমন কোনো কাজ প্রদীপ করতে চায় না। কিন্তু না জানিয়ে এসে সেকি আজ ভুল করলো? ধনঞ্জয়কে অন্তত ফোন করে আসলে ঠিক সময় মতো ও দাঁড়িয়ে থাকতো। গাড়ি পার্ক করার অসুবিধে হতো না। আজ বেজায় ঝামেলা হচ্ছে।
ইন্দুবালার ভাতের হোটেলের সামনে একটু বৃষ্টিতেই গোড়ালি সমান জল। সেখানে আবার কোথায় গর্ত আছে, নর্দমা আছে সেইসব দেখে গাড়ি রাখতে প্রদীপের অনেকটা সময় লেগে যায়। এতক্ষণে বাড়িটার দিকে তাকানোর ফুরসৎ হয় তার। শহরের এক পুরোনো পাড়ায় বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যেয় দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা কেমন যেন একলা হয়ে। কোথাও আলোটুকু পর্যন্ত নেই। তার মন কেমন যেন কু গেয়ে ওঠে। গোটা বাড়ি জুড়ে অন্ধকার। কেউ কোথাও নেই। এমনকি সামনে যে দু তিনটে খদ্দের ঘোরাঘুরি করে তারাও আজ নেই। বোর্ডে লাগানো আলোটাও আজ জ্বলছে না। প্রদীপ অনেক দিন পর মায়ের সাথে দেখা করতে এলো। আসবো আসবো করে তার আসাই হয় না। আজ এইটা কাল ওইটা লেগেই থাকে। তার আজকে আসার আরও একটা বড় কারণ হচ্ছে এইবার পাসপোর্টটা ফারদার রিনিউ করার আগে সে একবার বাংলাদেশ ট্যুর করতে চায়। একটা প্যাকেজও পাচ্ছে প্রায় কিছু খরচ না করেই। ছেলে বুবাই বললো “যাও না ঠাম্মির দেশে! কীসব তোমাদের কলাপোতা…ফোতা।” আইডিয়াটা খারাপ লাগেনি প্রদীপের। বউ সম্পূর্ণাও রাজি হয়ে গিয়েছিল। কর্মসূত্রে স্বামীর সাথে তার বাইরের অনেক দেশ ঘোরা। কিন্তু বাংলাদেশ যাওয়া হয়নি। নিজের চোখে হাতে করে একটু ঢাকাই মসলিন দেখে আসার ইচ্ছে আছে তার। সাথে কিছু কেনারও। এবার মা রাজি হলে তাহলে পাসপোর্টের একটা ঝামেলা থাকবে। মায়ের পুরোনো পাসপোর্টটা আছে কিনা সেটাও দেখা দরকার। প্রদীপ যদিও জানে পাসপোর্ট করাতে সময় লাগবে না। বুবাইয়ের বন্ধু কাজ করে পাসপোর্ট অফিসে। তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে সব। সম্পূর্ণই তাকে ঠেলে পাঠালো। একবার কথা তোলবার জন্য। মেজাজ যা মাঝে মাঝে থাকে বুড়ির!
প্রদীপ বাড়ি থেকে যখন বেরিয়েছিল বৃষ্টি ছিল না। এই দিকেই হয়েছে তাহলে ভালো। গরমের বৃষ্টি কোথায় যে কখন হয় বোঝা যায় না। প্রদীপ এগিয়ে গেল ভেতরের দরজার দিকে। সিঁড়ির আলো জ্বালানো। বাইরের বারান্দার। না কোথাও কেউ নেই। দুবার ডাকলো “মা..মা” বলে। কোন সাড়া শব্দ পেলো না। প্রদীপ চিৎকার করে ডাকলো ধনঞ্জয়কে। “ধনাদা..”। উত্তর নেই। কেমন যেন ভয়ে পেয়ে গেলো প্রদীপ। যদি মা সত্যি না থাকে? এই কথাটা যেন প্রথম ভাবলো সবে সিনিয়র সিটিজেনের তালিকায় প্রবেশ করতে যাওয়া প্রদীপ। এমন ভাবে কোনোদিন এর আগে মনে হয়নি। মা থাকলে জগৎটা তার এক রকম। আর মা না থাকলে অন্য রকম। বাবাকে ঝাপসা মনে পড়ে। ঘুড়ি ওড়ালে বাবা লাটাই ধরা শেখাতো। ব্যস, ওইটুকুই। তার তো তাও এটা মনে আছে, ভাই আর বোনের সেটুকুও তো মনে নেই। সবটাই তো তিনজনের মাকে ঘিরে। একবার কি ফোন করবে তাহলে ভাইকে? খুকুকে? কিন্তু কী বলবে? ছেনু মিত্তির লেনে ইন্দুবালা ভাতের হোটেলে সে এসেছে অথচ ইন্দুবালাকে খুঁজে পাচ্ছে না? দোতলা ঘুরে এসে পিছনের দিকে কুয়োতলায় উঠোনের কাছে এসে আর একবার কাঁপা কাঁপা গলায় ডেকে উঠলো প্রদীপ “মা…”। এবার খুব শান্ত গলায় উত্তর ভেসে এলো “আয়..”। প্রদীপ তার মায়ের গলা শুনতে পেল কিন্তু মাকে সে দেখতে পেলো না তখনই। মোবাইলের টর্চ জ্বালালো। “কোথায় তুমি মা?” একটু এগিয়ে যেতেই সে তার মাকে খুঁজে পেলো। কাক ভিজে হয়ে সন্ধ্যের উঠোনে ঝাঁকড়া আমগাছের ডালটার নীচে বসে আছেন ইন্দুবালা। চারপাশে জড়ো করা ঝড়ে পড়া কাঁচা আম। প্রদীপ এগিয়ে যায়। জড়িয়ে ধরে তার মাকে। “মা তুমি ঠিক আছে তো? তোমার শরীর ঠিক আছে তো? পড়ে গিয়েছিলে নাকি? আমাকে ধরো মা..প্লিজ আমাকে ধরো…শক্ত করে ধরো…।” ইন্দুবালা ছেলের হাত ধরেন। সেই আধো আলো আধো অন্ধকারে, আধুনিক মোবাইলের এল ই ডি লাইটে ইন্দুবালা বলে ওঠেন “আমাকে একটু তেল কিনে দিবি বড় খোকা? আম তেল করবো…।”
এমনটা নয় যে ইন্দুবালার তেল কেনার টাকা নেই। এমনটা নয় ইন্দুবালা এইভাবে ছেলেদের কাছে টাকা চান। কোনোদিন কারো কাছে একটা টাকাও হাত পেতে চাননি সেই প্রথম দিন লছমী টাকা দিয়ে ভাত খেয়ে যাওয়ার পর থেকে। তারপর মা লক্ষ্মীর দয়ায় ক্যাশবাক্স ভর্তি থেকেছে সবসময়। তাই প্রদীপ একটু আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল। তার মনে ভয় ছিল ছোটোখাটো কোনো সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়েছে কিনা। কেমন যেন ঘোরের মধ্যে আছে মা। ততক্ষণে সারা রাজ্যের বাজার ঘুরে ধনঞ্জয় এসে পড়েছিল। প্রদীপ একটুও দেরি না করে অ্যাম্বুলেন্স ডেকেছিল। সোজা নিয়ে গিয়েছিল কাছের নার্সিংহোমে। এমার্জেন্সির ডাক্তার বরং উলটে কথা শোনালো প্রদীপকে “আমতেল করার জন্য টাকা চেয়েছেন বলে সোজা এখানে নিয়ে চলে এলেন মাকে? আচ্ছা ছেলে তো মশাই”। প্রদীপ ইচ্ছে করলে ডাক্তারকে বোঝাতে পারতো তার মা কোন ধাতে গড়া মানুষ। কিন্তু সেই পথে সে হাঁটলোই না। কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকলো। তারও যেন এক ঘোর লেগেছে চোখে। আমের স্কুপের মধ্যে বৃষ্টি ভেজা মাকে একা বসে থাকতে দেখে তার কি কান্না পেয়েছে? কিছুক্ষণের জন্য হলেও নিজেকে লুকোয় প্রদীপ। আর ওদিকে ডাক্তার অবাক হয়ে শোনেন দুবেলা এখনও তিনশো করে লোকের রান্না করা, কুটনো কাটা ইন্দুবালার দিনলিপি। আতিপাতি খোঁজ নিয়ে হোটেলের ঠিকানা চেয়ে দুটো এন্টাসিড লিখে ডাক্তার ছেড়ে দিলেন ইন্দুবালাকে। তার সাথে ইন্দুবালা তাঁকে বলে এলেন সকালে উঠে লেবুর জলের সাথে মধু খাওয়ার নিদান। তাও যে সে মধু নয়। সর্ষে ফুলের মধু। গরম জলের মধ্যে ঘুরবে তার ঝাঁঝ। চর্বি যাবে কমে। মন থাকবে ফুরফুরে। বাড়ি ফেরার পথে বড় খোকার গাড়ি থামিয়ে পাঁচ কিলো সর্ষের তেল কিনলেন। ততক্ষণে ছোট খোকা, খুকি বেসবাই ফোন করতে শুরু করে দিয়েছে। ইন্দুবালার মুখে হাসি। তিনি এক্ষুনি মরছেন। নাকি? বড় খোকার গাড়িতে এই প্রথম উঠে বেশ লাগলো তাঁর। চারপাশটা কেমন যেন ঠাণ্ডা। কী সুন্দর জুই ফুলের গন্ধ গাড়ির মধ্যে। হুশ হুশ করে কত জায়গায় বেড়াতে যায় ওরা। অথচ সবাই কত কষ্টে বড় হয়েছে। ঈশ্বর করুন যেন এমন থাকে সবাই। দুধে, ভাতে, সুখে, আনন্দে। ওদের এই শ্রী বৃদ্ধি দু চোখ ভরে দেখার আশায় ঈশ্বরের কাছে আরও কয়েকটা বছরের আয়ু চেয়ে নেন তিনি মনে মনে।