ঝোড়ো হাওয়ায় বাড়ির সব জানলা দরজাগুলো হুটোপাটি করে পড়ার শব্দে ইন্দুবালার ঝিমুনি কাটে। দুপুরে হোটেলের কাজ কম্ম শেষ করে তাঁকে এখন একটু বিশ্রাম নিতে হয়। না হলে রাতের দিকে আর উনুনের সামনে দাঁড়াতে পারেন না। ভেতরে কীরকম যেন একটা কষ্ট হয়। এইসব যদি ঘুণাক্ষরেও ধনঞ্জয় জানতে পারে তাহলে ছেলেদের বলে দেবে। তারা তখন মাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। ডাক্তার বদ্যি নিয়ে অযথা ছুটোছুটি শুরু হয়ে যাবে। নিয়ম দিয়ে মাকে বেঁধে ফেলতে চাইবে ওরা সাত তাড়াতাড়ি। এইসব ভাবলেও বিরক্ত বোধ হয় ইন্দুবালার। ঝিম ধরা চোখে তাকান বাইরের দিকে। আকাশ কালো করে মেঘ করেছে। কালবৈশাখী। কোনোরকমে গাঁটের ব্যথা সামলে উঠে পড়েন তিনি। ধনঞ্জয়কে ডেকেও কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। বাজার করতে গেল নাকি? এখন এতগুলো জানলা বন্ধ করবেন কী করে? তাও কোনোরকমে ওপরের ঘরের জানলাগুলো বন্ধ করতে পারেন তিনি। আর ঠিক তখনই নজর পড়ে উঠোনের দিকে। বাগানের গাছটা থেকে টুপ টুপ করে আম পড়ছে ঝড়ে। সেদিনও কি এমন ঝড়টাই হচ্ছিল না? তবে সেটা ছিল ভোর। আর আজ বিকেল। ইন্দুবালা ভুলে যান তাঁকে বন্ধ করতে হবে বাড়ির আরও জানলা দরজা। ভুলে যান তাঁর বয়েস ছুঁয়ে গেছে সত্তরের ওপার। ঝোড়ো হাওয়া আর টুপটুপ আম পড়ার শব্দ তখন তাঁকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সিঁড়ির দিকে। ইন্দুবালা নামছেন সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে। কোথায় তাঁর পায়ের ব্যথা? গাঁটের বাত? যেন ছুটছেন তিনি এক ঘোরের মধ্যে দিয়ে উঠোনের দিকে। ছুটছেন ইন্দুবালা। ছুটছেন তীর বেগে। ঝোড়ো হাওয়ায় কেঁপে উঠছে হাতের লণ্ঠনের শিখা। কড়কড় করে বাজের শব্দ কানে তালা ধরিয়ে দিচ্ছে। ভোর হতে তখন অনেক দেরি। পেছনে ছুটছে ছোট্ট ভাইটা। তার পেছনে মা, তারও অনেক পেছনে ঠাম্মা। গোটা আমবাগান জুড়ে কলাপোতার লোকজন জড়ো হয়েছে ওই আঁধার ভোরে। প্রায় একশো গাছের বাগান যাদের তারাও এসেছে। গাঁয়ের লোকের আম কুড়োনোতে তাদের কোনো আপত্তি নেই। এমনিতেই নষ্ট হয় কত। শিলের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে আম পড়ছে হাওয়ায়। কেউ মারামারি করছে না। রেষারেষি না। সবার কোঁচড় ভরে উঠছে কাঁচামিঠে, ল্যাঙরা, বোম্বাই আমে। ঝড়ের সাথে শুরু হয়েছে বৃষ্টি। কড়কড় করে বাজ পড়ছে। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ভাইটা ঠকঠক করে কাঁপছে। বারণ করেছিলেন ইন্দুবালা। বাবার সাথে বাড়িতে থাকতে বলেছিলেন। শোনেনি ভাই। তাঁর সাথেই ছায়ার মতো থাকে যে। চলে এসেছে ছুটে ছুটে দিদির পেছন পেছন। এবার বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাধালেই হলো আর কি। তাড়াতাড়ি গিয়ে নিজের আঁচলে জড়িয়ে ধরেন ইন্দুবালা ভাইকে। তাও কি বৃষ্টির থেকে রক্ষা পাওয়া যায়? বিড়বিড় করেন, “লেবু পাতায় করম চা যা বৃষ্টি থেমে যা”। কিন্তু বৃষ্টি থামার নাম নেই। বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে যেন বরফ জলের ঠাণ্ডা। ভাই বোন ঠকঠক করে কাঁপে। দুজনে আগলে রাখে কোঁচড়ে জমানো আমগুলোকে। একটা সময়ে ইন্দুবালা ইঠাই বুঝতে পারেন চারপাশে বৃষ্টি পড়ছে কিন্তু তাঁদের মাথায় বৃষ্টি নেই কেন? ওপর দিকে তাকাতে ইন্দুবালা দেখলেন একটা বড় কচু পাতা। সেটা ধরে আছে মনিরুল। কী যে ভালো লেগেছিল সেদিন, ইন্দুবালা বলে বোঝাতে পারেননি কাউকে। বলার সুযোগ ছিল না। রুমালের ওপর সুতা দিয়ে একটা ছেলেকে এঁকেছিলেন তিনি। তার হাতে দিয়েছিলেন একটা কচু পাতা। আর মেয়েটাকে রেখেছিলেন দূরে। এলোচুলে। বৃষ্টির মধ্যে। ইচ্ছে ছিল মনিরুলকে নিজে হাতে করে দেবেন রুমালটা। সেটা আর দেওয়া হয়নি। কেন দিতে পারেননি মনিরুলকে? মা দেখতে পেয়ে গিয়েছিল কি? বকেছিল খুব? মনে করতে বসেন ইন্দুবালা। নাকি তিনি নিজেই মিথ্যে বলেছিলেন মাকে? ভাইয়ের জন্য রুমাল করেছেন। ভাই সেই রুমালে সারাদিন নাক ঝেড়ে ঝেড়ে ভর্তি করেছিল। আর ইন্দুবালা পড়েছিলেন জ্বরে। বেজায় শরীর খারাপ হয়েছিল সেবার। সারছিলো না মোটেই। সাতদিনের মাথায় পথ্যি পেয়ে তবে মেয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছিল। গ্রীষ্মের রোদে ঘর থেকে বেরিয়ে মন ভালো হয়ে গিয়েছিল ইন্দুবালার। ঠাম্মা ততদিনে সেই ঝড়ে কুড়োনো আমগুলোকে কেটে, ধুয়ে হলুদ নুন মাখিয়ে কিছুটা আচার করে ছিলেন আর বেশ খানিকটা আমতেল বসিয়েছিলেন রোদে। সুয্যিদেব গোটা গ্রীষ্মকাল জুড়ে রোদে তাতিয়ে তেলে মিশিয়ে কাঁচা আমগুলোকে জারিয়ে দেবেন। তারপর সেই তেল দিয়ে সারা বছর যা খাওয়া দাওয়া চলবে তার কোনো হিসেবের কুল কিনারা পাওয়া যাবে না। আম তেল মুড়ি দিয়ে মাখা হবে। গরমভাতে ঘিয়ের বদলে খাওয়া হবে। মাছের ঝোলে বিশেষ করে সরল পুঁটিতে আমের গন্ধ দেওয়ার জন্য আমতেল ব্যবহার হবে। আর গ্রামে পোয়াতির সংখ্যা নেহাৎ কম থাকে না সম্বৎসর। তারাও পাবে। পাতা কুড়োতে এসে খেন্তির মা পাবে। টিফিনে মনিরুল পাবে। ফকিরি গান গাইতে আসা অন্ধ কানাই পাবে। চুরি করে ঠাম্মার আম তেল আর আচার খেতে খেতে গরমের ছুটির দুপুরগুলো কেটে যাবে।
বৃষ্টিটা সবে ধরেছে। তবে হাওয়ার বেগ এখনও বেশ ভালোই। ঝিরঝিরে জোলো বাতাস চারিদিকে যেন ঘুরপাক খাচ্ছে। ইদানিং হয়েছে কী, কলকাতার এই ধরনের হুট করে আসা বৃষ্টিতে সবাই কেমন যেন তালকানা হয়ে যায়। ট্রাফিক সার্জেন্ট থেকে শুরু করে অটো চালক- সবাই। ইন্দুবালার বড় ছেলে প্রদীপ হঠাৎ নিজেই ড্রাইভ করে মায়ের সাথে দেখা করতে এসেছে। অন্যান্য বার আগে ফোন করে জানিয়ে রাখে মাকে কিংবা ধনঞ্জয়কে। এবার সেসব কিছুই করেনি। ভেবেছিল মাকে একটু চমকে দেবে। সদর দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বলবে, “আজ কিন্তু বাড়ি যাবো না মা। থাকবো তোমার কাছে।” এমন কথা শুনলে তার মা কী বলবে এই বুড়ো ছেলেকে সেটা জানার জন্য তার খুব ইচ্ছে করছিল। যদিও জানে প্রদীপ, মা তাকে কোনোদিনই বউ বাচ্চা ছেড়ে থাকতে দেয়নি। এমনকি অন্যান্য মায়েরা যেমন খুব আদিখ্যেতা করে বাচ্চাদের আদর করে, খাওয়ায়; ইন্দুবালা তাঁর ছেলেদের বা মেয়েকে কোনোদিনই তেমন করে বড় করেননি। কিন্তু তাঁর ভালোবাসা ছিল চোরাস্রোতের মতো। সেটা তিন ছেলে মেয়েই খুব ভালো করে টের পেতো। শরীর খারাপ করলে, জ্বর হলে ঠায় মাথার কাছে বসে থাকতেন। সারা রাত জাগার পর আবার সারাদিন হোটেলে ওই গনগনে উনুনের সামনে রান্না করা। মায়ের কষ্ট তারা বুঝতো। তাই জীবনের প্রথম চাকরির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে পেয়েই প্রদীপ মাকে হোটেল বন্ধ করতে বলেছিল। দিল্লিতে যে কোয়ার্টারটা সে পাবে তাতে সবাই মিলে থাকা যাবে। ইন্দুবালা হাসি মুখে শুধু বলেছিলেন “এবার তুই ছেনু মিত্তির লেনের মায়া কাটিয়ে নতুন জীবন শুরু কর বড় খোকা”।