টগবগ করে ভাত ফোটে। ডাল ফোটে। মাছের ঝোলে মাছগুলো যেন ফুটতে ফুটতে ফড়ফড় করে নিজেদের মধ্যে কথা বলে। তিন তিনটে উনুন জ্বেলে সেই স্মৃতি সম্ভাষণের আসন সাজান ইন্দুবালা।
নতুন যে দেশটায়, শহরটায় তিনি এসে পড়লেন, এই দেশ নিয়ে, শহর নিয়ে এর আগে তিনি কম গল্প শোনেননি। বাবার বাবা মানে ইন্দুবালার দাদু এক সময়ে নাকি কাজ করতেন কলকাতার বন্দরে। সেখানে সাহেব সুবোর খাতা লিখে তাঁর দিন গুজরান হতো। বড় বড় জাহাজে করে কত শত যে জিনিস আসতো তার কোনো ইয়ত্তা ছিল না। মেমসাহেবের ছোট্ট চিরুনি থেকে বেলজিয়াম কাঁচের আয়না। ইন্দুবালার গ্রামের বাড়িতে ঠাকুর দেবতার যা মূর্তি ছিল লক্ষ্মী থেকে শুরু করে শিব সব কিছু তার দাদুর আনা। চিনেমাটিতে বানানো সব হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি। কলকাতার বড়লোক বাড়িতে ছেলে মেয়েদের খেলার জন্য বিদেশ থেকে আনা হতো। অনেক সময় বিয়ের তত্ত্ব যেত এইসব পুতুল সাজিয়ে। প্রত্যেকটা পুতুলের গায়ে লেখা থাকতো মেড ইন জার্মানি। বেশ নামডাক ছিল এই শিল্পের। এগুলো বাড়িতে রাখাও সম্মানের ব্যাপার ছিল তখন। ঠাম্মার খেলার জন্য দাদু এইসব পুতুল মাঝে মাঝে নিয়ে গেলেও ঠাম্মা সব কিছু সাজিয়ে রাখতেন পুজোর ঘরে। লক্ষ্মী, শিব, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর নিয়ে কেউ খেলে নাকি? শুক্রবার হলেই দাদু বাড়ি ফিরতেন শিয়ালদহ স্টেশন হয়ে খুলনায়। একটা সবজেটে ট্রেন দাদুকে নামিয়ে দিত কপোতাক্ষের ওপারে। শনি রবি বাড়ি থেকে আবার সকালের ট্রেন ধরে কলকাতায়। বাবাও দাদুকে অনুসরণ করেছিলেন। দাদুর কাছে কাজ শিখতে শিখতে কলকাতায় পড়াশুনো চালিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ মাঝখান থেকে দেশটা স্বাধীন হলো। শুধু স্বাধীন হলো তাই না দেশটা দু-টুকরো করে ভাগ করা হলো। দেশের নেতারা সেই দেশে বসবাসকারী সাধারণ মানুষদের কাছে অনুমতি নিল না, জানতে চাইলো না। এক মুহূর্তে ভিটে মাটি সব কিছু হয়ে গেল বিদেশ। রাতের আঁধারে, দিনের আলোয় মানুষ দৌড়াদৌড়ি শুরু করলো। কে কোন অংশে যেতে পারবে তার যেন মারাত্মক মরিয়া প্রতিযোগিতা। তার সাথে বাধলো দাঙ্গা। রক্তক্ষয়ী। ভাই ভাইয়ের বুকে ছুরি মারলো। মেয়ে লাঞ্ছিত হলো পড়শির কাছে। গোটা ভূখণ্ড জুড়ে চললো নরহত্যা। তিনশো বছরের ইংরেজ রাজত্বের পর স্বাধীনতা উদযাপনের সে কী ভয়ঙ্কর উৎসব।
নীল আকাশে আগুনের লেলিহান শিখা দেখে দাদু প্রশ্ন করেছিলেন “এই স্বাধীনতাই কি চেয়েছিলাম আমরা? এই স্বাধীনতার স্বপ্নই কি দেখেছিলেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার অভ্যুত্থানের বীর শহীদ মাস্টারদা সূর্য সেন?” ফাঁসিতে ঝোলানোর আগে যাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল? তারপর দড়িতে ঝুলিয়ে দেহটাকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল বুড়িগঙ্গার গভীর জলে? অত ছোট্ট মেয়ে প্রীতিলতাকেই বা মরতে হলো কেন? এত এত শহীদ কেন দ্বীপান্তরে গেলেন? জাতীয় পতাকা যদি সেই উড়লো দেশের স্বাধীন ভূমিতে তাহলে তখন দেশ বলে গড় করতে পারলাম না কেন? মনে অনেক প্রশ্ন, কষ্ট আর হতাশা নিয়ে দাদু ফিরে এলেন খুলনার কলাপোতায়। স্টেশনে আসার পথে দেখেছিলেন একদল লোক চিৎকার করে স্লোগান দিচ্ছে “ইয়ে আজাদি ঝুঠা হ্যায়”। খাবার নেই, জল নেই, নিজেদের বলতে কিচ্ছুটি নেই। হাতের সামনে যে যা পেরেছে শেষ সম্বলটুকু নিয়ে উঠে পড়েছে ট্রেনে। কোথায় যাচ্ছে, এরপরে কীভাবে থাকবে তার কিচ্ছুটি জানা নেই কারও কাছেই।
বাবা আসতে চাননি কলকাতা ছেড়ে। তাঁর কাছে তখন নতুন দুটো ভূখণ্ড ভারতবর্ষ আর পাকিস্তান। বাবা থেকে যেতে চেয়েছিলেন ভারতবর্ষে। আর দাদু চেয়েছিলেন যে গ্রামের মাটিতে তাঁর বাবা, মা পূর্বজরা পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে আছেন, যে নদীর জলে ডুব দিলে জীবনে শান্তি পাওয়া যায় সেই কলাপোতায়। তখনও হয়তো তিনি মনে মনে বিশ্বাস করতেন এটা মানুষের সাময়িক ভ্রম। দেশ নেতাদের অলীক কল্পনা। “দেশ কখনও ভাগ করা যায় নাকি? এটা কি তোমার লাউটা, মুলোটা কাটলেই ভাগ হয়ে গেল?” সামনের বর্ষার দিকে তাকিয়ে থাকতেন তিনি। “বৃষ্টির জলে ধুয়ে যাবে দুই দেশের সীমানা। তখন দেখো আবার আমি কেমন করে শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে করে স্টেশনে নামি। বাড়ির দোরে এসে ডাক দিই…কোথায় ব্রজের মা…? হাতের ব্যাগখানা ধরো দেখি। তোমার জন্য বড় বাজারের মশলা আর ভীম নাগের সন্দেশ আছে।” বর্ষার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দাদুর চোখে ছানি পড়েছিল। কিন্তু দুটো দেশ জোড়া লাগেনি। বাবা বুঝতে পেরেছিলেন দাদুকে একা রেখে এইভাবে তিনি ইণ্ডিয়া চলে যেতে পারবেন না। কাজেই অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও তাঁকে থেকে যেতে হয়েছিল। তার মধ্যে বুদ্ধি খরচ করে তিনি দাদুর জমানো টাকায় বেশ কিছু জমি কিনে নিলেন। চাষবাস দেখাশুনো করতে শুরু করলেন। আর দাদুর জন্য খুলে দিলেন একটা টোল। সেখানে দাদু পড়াতে শুরু করলেন গ্রামের বাচ্চাদের। না হলে মানুষটার সময় কাটবে কী করে? ভাবতে ভাবতে শেষকালে পাগল হয়ে যাবে না তো? টোল থেকে কোনো কোনো দিন দাদু বাড়ি ফিরতেন না। সবাই জানতো তিনি এখন চুপ করে বসে আছেন কপোতাক্ষের ধারে। ওপারের দিকে তাকিয়ে। মাঝিদের জিজ্ঞেস করতেন ওদিকের ট্রেন চলতে শুরু করেছে কিনা। এইসব ইন্দুবালা দেখেননি। শুনেছিলেন সব সেই ছোট্ট থেকে। শ্রুতিমালার সেই গল্পগুলো রয়ে গিয়েছিল তাঁর মনে। দাদুকে তিনি যখন দেখেছিলেন তখন বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে মানুষটা। তবুও তাঁর সেই টোলের বারান্দায় চুপ করে বসে থাকা, মাঝে মাঝে দিদিভাই বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ভুলতে পারেননি ইন্দুবালা। এখন ভাবেন এত কষ্ট নিয়ে কী করে বেঁচে ছিলেন দাদু? বন্ধু বান্ধব যা ছিল সবই ওপারে। আর এপারে ছিল প্রতিশ্রুতির বন্ধন। দাদু তাঁর বাবাকে কথা দিয়েছিলেন থাকবেন তিনি এই পিতৃপুরুষের ভিটেতেই। সেই কথার খেলাপ তিনি কোনোদিন করেননি। অসম্মান তো দূরের কথা। তার অবিচল সিদ্ধান্ত থেকে কেউ টলাতে পারেনি। তাহলে যেখানে সবাই রয়ে গেল ওই পারে, সেখানে একমাত্র ইন্দুবালা তাঁদের পিতৃপুরুষের স্মৃতি তর্পণের জন্য কেন রয়ে গেলেন এপারে? কেন বাবার মনে হয়েছিল একমাত্র ইন্দুবালাকেই ওপারে পাঠাতে হবে? অনেকের মতো কেন বাবা নিজেও সিদ্ধান্ত নিলেন না এপারে চলে আসার? ইন্দুবালা জানতেন বাবা শিকড় ছাড়া হতে পারতেন না। মাও না। ঠাম্মাও না। আর ভাই? তার কথা সোনার আখরে ইতিহাসে না লেখা থাকলেও ইন্দুবালা জানেন ওই যে মুক্তোর মতো বর্ণপরিচয়, সেখানেই লুকিয়ে আছে তাঁর ভাই। ভাষা শহীদ হওয়া কি মুখের কথা? সে তো জন্ম জন্মান্তরের পুণ্যের ফল। তাঁদের গোটা পরিবারের মাতৃভূমির কাছে ঋণ মোচন।