নতুন কনে ইন্দুবালার সঙ্গে মালপত্র হিসেবে এসেছিল বড় নক্সা করা একটি তোরঙ্গ। দানের বাসনের বড় ঘড়াটা। বাবার হাতে ছিল ওপারের বাজারের জোড়া ইলিশ। ভাইরের হাতে দইয়ের বড় হাঁড়ি। বাবু মাস্টার রতনলাল মল্লিকের হাতে ছিল বিয়ের ছাতা নিপাট ভাঁজ করা। কাঁধে ফেলা ছিল দানের শাল। হাতে চকচক করছিল আশীর্বাদের দু ভরি সোনার আংটিটা। স্টেশনে ট্রেন থামলে বরের বাড়ি থেকে লোক আসা দস্তুর ছিল। নতুন কনেকে যেভাবে গল্প শুনিয়েছিল তার বাড়ির লোকেরা, সে আরও অনেক কিছু ভেবে রেখেছিল। ব্যাণ্ড পার্টি। রঙ মশাল। ফানুস। কলকাতার রাজপথে শোভাযাত্রার মতো বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান। “তুই শুনলাম বনেদি বাড়ির বউ হলি ইন্দু। পা পড়বে তো মাটিতে”। ফুট কেটেছিল গাঁয়ের হিন্দু বাড়ির মেয়েরা। বন্ধুরা কেউ কেউ বলেছিল “আতসবাজি ফাটাবে নিশ্চয়। ঘোড়ার গাড়ি আসবে। ফুল ছড়াবে। আতরদানি থেকে আতর।” কিন্তু এইসবের ছিটেফোঁটাও ইন্দুবালার আশেপাশে ছিল না। নতুন বউকে নিয়ে যাওয়ার জন্য শ্বশুরবাড়ি থেকে কাউকে আসতে দেখেননি তিনি। বাবা একটু কুণ্ঠা নিয়েই জানতে চেয়েছিলেন “বাবা রতন… তোমার বাড়ির থেকে…?” কথা শেষ করতে দেয়নি মাস্টার রতনলাল মল্লিক। তাঁর সযত্নে লালিত বাবরি চুলের গোছা নেড়ে বলেছিলেন “তাই তো…তাই তো…এখন যে কী করি? বউভাতের যোগাড় যত্নে লেগে গেল কিনা লোকজন…। পুরুষ বলতে বাড়িতে আমি তো একাই…।” বাবা বিচলিত হতে বারণ করেছিলেন জামাইকে। তিনি থাকতে চিন্তার তো কিছু নেই। “শুধু এত জিনিস বলে লোকজনের খোঁজ করা। তা একটা কুলি নিলেই হয়ে যায় আর কি।” বাবা কুলি ডেকে তার মাথায় তুলে দিয়েছিলেন প্রায় সবকিছু। আর যেটুকু ছিল কুড়িয়ে বাড়িয়ে সবার হাতে হাতে ধরে গেল। কপোতাক্ষর গাঁয়ের মেয়ে যখন ভাগীরথীর পাড়ে এসে প্রথম পা দিলো তখন কেউ শাঁখ বাজালোনা। কালো পাথরের থালায় দুধে আলতা মিশিয়ে কেউ পা ছোঁয়াতে বললো না। ঈশ্বরী পাটনীর মতো কেউ আদর করে পার করে দিল না শ্বশুরবাড়ির দোরটা। কিন্তু সে গল্প আমাদের জানা। যতই মাস্টার রতনলাল মল্লিক বলুন না কেন বউভাতের আয়োজনে বাড়ির সবাই ব্যস্ত আছে। আমরা তো জানি ইন্দুবালার বউভাতই হয়নি। কাকপক্ষীটিও টের পায়নি ইন্দুবালার শাশুড়ি এক বংশ ঘটির মাঝে একটা বাঙালি মেয়ে বউ করে নিয়ে আসছেন। জানাজানি হলে মুশকিল হতো। আগের বউটা বাচ্চা হতে গিয়ে মরেছিল নাকি মাস্টার রতলনাল মল্লিক গলা টিপে খুন করেছিলেন সে নিয়ে বিস্তর কানাঘুষো আছে। তাই বাড়তি কোনো আয়োজনের দিকে যাননি শাশুড়ি। নতুন বউয়ের সাথে তার বাবা আর ভাইকে দেখে মেজাজ তিরিক্ষে হয়েছিল তাঁর। আপদগুলোর আবার আসার দরকার কী ছিল! মেয়েটাকেই চেয়েছিলেন তিনি। পরিবারকে নয়। আর ইন্দুবালা দেখেছিলেন বাড়ির সামনে থেকে বাবা ছোট্ট ভাইয়ের হাত ধরে চলে যাচ্ছেন অপমানিত হয়ে। তাদের কেউ একটু জল-মিষ্টি খাওয়ার কথা দূরে থাক বসার জন্য পর্যন্ত বলছে না। ছেনু মিত্তির লেনের গলিটা দিয়ে যেতে যেতে ভাইটা কাঁদছে। বাবা ফিরে ফিরে তাকাচ্ছেন। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। তখনও জানেন না ইন্দুবালা এই তাঁর শেষ দেখা বাবার সাথে। এরপর আর কোনোদিন দেখতে পাবেন না বাবাকে। ইন্দুবালার বাড়ি ছেড়ে আসার বছর কয়েকের মধ্যেই মারা যাবেন বাবা। ঠাম্মা নাতনির মুখটা দেখতে চেয়েও পাবেন না। শেষ কদিন ইন্দু ইন্দু করে ঢলে পড়বেন চিরঘুমে। আর মায়ের কথা? সেগুলো যত্ন করে ইন্দুবালা শাড়ির ভাঁজে, আঁচলের ছোঁওয়ায় তুলে রেখেছেন। যেমন পঞ্চ প্রদীপের তাপ আঁচলে পুইয়ে গিঁট বেঁধে রাখতেন মা ঠিক তেমন করেই। ভাইটা তারও অনেক পরে যোগ দিয়েছিল স্বাধীনতার যুদ্ধে। চিঠি পত্রের আদান প্রদান অল্প বিস্তর যা ছিল যুদ্ধ শুরু হলে সেসবের পাটও চুকলো। জন্মভূমির সাথে যোগাযোগ একেবারে ছিন্ন হলো ইন্দুবালার।
কলকাতা শহর তখন বেশ সরগরম। মিছিলের পর মিছিল চলেছে রাস্তা জুড়ে। মানুষের পাতে ভাত নেই। মনে সুখ নেই। খাবার নিয়ে যে আন্দোলন হতে পারে ইন্দুবালা জানতেন না এই শহরে না এলে। স্টেশনের বাইরে থেকে অনেক দরদাম করে বাবা একটা ট্যাক্সি ভাড়া করেছিলেন। সেই ট্যাক্সির মধ্যে ইন্দুবালা, ভাই, বাবা আর মাস্টার রতলনাল মল্লিক ঠিক এঁটে গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল সেইসব জিনিসগুলো যা আজ ধনঞ্জয় কুড়িয়ে বাড়িয়ে ফেলে দিতে চাইছে। ও কতটুকু জানে এইগুলোর মাহাত্ম? গজগজ করতে করতে বুড়ি ভাঙা তোরঙ্গটার সামনে বসেন। ততক্ষণে ডালে ফোড়ন পড়েছে। নটা বাজতে চললো। কলেজের ছেলেগুলো খেতে এলো বলে। ইন্দুবালার কাজের তাড়া পড়ে যায়।
ট্যাক্সির জানলার পাশ আর ট্রেনের জানলার ধার ঠিক এক জিনিস নয়। ট্রেনের জানলার ধারে কত গ্রাম, নদী, জলা, জঙ্গল আর ট্যাক্সির পাশে শুধুই শহর। খেতে না পাওয়া মানুষের মিছিল। তখনও প্রথম ট্রেনে ওঠার ঘোরটা যেন কাটেনি ইন্দুবালার। অল্প অল্প মাথাটাও কি টলছিল ট্রেনের দুলুনির সাথে? তার রেশ রয়ে গিয়েছিল অনেক দিন। কলকাতায় এসেই লুকিয়ে মনিরুলকে একটা না পাঠানো চিঠি লিখেছিলেন ইন্দুবালা। “জানিস মনিরুল ট্রেন যে কী ভীষণ বস্তু তোকে না বলে বোঝাতে পারবো না। আমাদের সেই বাঁশ গাছে দোল খাওয়ার মতো। তুই নিশ্চয়ই এতদিনে ঢাকায় পড়তে চলে গিয়েছিস। অনেক কিছু দেখা হয়ে গেছে তোর। অনেক নতুন বন্ধু হয়েছে। আমার কথা মনে পড়ে আর? বোসদের পুকুর? খানার ধারের ল্যাঙড়া..? গাজনের মাঠ..? কপোতাক্ষের ঘাট? আমি কিছু ভুলিনি মনিরুল। এখনও কি নানি সন্ধ্যে হলে বিষাদসিন্ধু পড়েন? তুই কি এখনও রাতের আঁধারে বাঁশি বাজাস? লণ্ঠনের আলোয় পড়িস নক্সীকাঁথার মাঠ? ঢাকাতে কি তোর দেখা হলো আমাদের প্রিয় কবি জসীমউদ্দীনের? আমার যে সব কথা…সব কিছু বড় জানতে ইচ্ছে করছে মনিরুল…। আমি যে তোকে…।” এরপর আর লেখা এগোতে পারেননি ইন্দুবালা। তিনি মনিরুলকে কী? ভালোবাসেন? পছন্দ করেন? একসাথে থাকতে চেয়েছিলেন? নিজের কাছে উত্তরগুলো স্পষ্ট নয়। যেমন ঠিক স্পষ্ট নয় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা আদৌও হয় কিনা। কিংবা ভালোবাসার অপর নাম শুধু শরীর কিনা। যে শরীরটাকে মাস্টার রতনলাল মল্লিক তার কয়েক বছরের বিবাহিত জীবনে তিন তিনটে বাচ্চার মা বানানোর ফ্যাক্টরি করে দিয়ে হঠাৎ উবে যাবেন কর্পূরের মতো হাওয়ায়। শরীরের সেই না পাওয়া কিংবা প্রচণ্ড পাওয়া কষ্টগুলো নিয়ে ইন্দুবালাকে বেঁচে থাকতে হবে দিনের পর দিন। তাও মলিন হবে না স্মৃতিগুলো। মানুষগুলো।