সেদিনের সেই ট্রেনের কামড়ায় বিলাতি আমড়াই শুধু উঠেছিল তাই নয়। তার সাথে ছিল চিরুনি, পাতাবাহারে ফুল গাছ, সূঁচ, বশীকরণের ওষুধ, কৃষ্ণনগরের সরভাজা, বসিরহাটের কাঁচাগোল্লা আরও কত কিছু। ভাই মাঝে মাঝে বাবার কাছে বায়না করে খাচ্ছিল। কিন্তু ইন্দুবালার নিজের খেতে ইচ্ছে করেনি কিছু। এমনকি নতুন জরির চুল বাঁধার ফিতে দেখেও কিনতে ইচ্ছে হয়নি। জানলার পাশ দিয়ে তখন বেরিয়ে যাচ্ছিল মাঠ-ঘাট, নদী, নৌকা, গ্রাম। ইঞ্জিনের কয়লার কালো ধোঁয়া। চোখ বড় বড় করে দেখছিলেন তাঁর বয়সী মেয়েরা কাজে যাচ্ছে। কলেজে যাচ্ছে। ইন্দুবালা কলেজ যেতে চেয়েছিলেন। পড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু কোথা থেকে যে কী হলো! মনিরুলের সজল কালো চোখ দুটো বাঁধা থাকলো তাঁর অন্তরে। নক্সী কাঁথার মাঠের সাজুর মতো তাকে সব স্মৃতি উপড়ে নিয়ে চলে আসতে হলো এপারে। রূপাই থেকে গেল অনেক দিনের পুরোনো অতীত হয়ে।
ট্রেনটা জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো কোন একটা স্টেশনে। কান ফাটানো আওয়াজ শোনা গেল বোমার। পুলিশের বন্দুকের। ঝুপ ঝুপ করে ট্রেনের জানলাগুলো পড়তে শুরু করলো। ইন্দুবালা তারই মধ্যে দেখলেন একদল ছেলে-মেয়েকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ লাঠি চালালো। কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়লো। এইসব চেঁচামেচিতে পাশে বসে ঝিমোতে থাকা মাস্টার রতলনাল মল্লিকের ঘুম গেল ভেঙে। তিনিও বিরক্ত হয়ে ইন্দুবালার সামনের জানলা ফেলে দিলেন। গোটা কামরায় অসহ্য গুমোট গরম। বাইরে চোখ জ্বালা করা ধোঁয়া। কানে এলো গর্জনের মতো স্লোগান “পুলিশ তুমি যতই মারো/মাইনে তোমার একশো বারো।” আবার একটা কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটলো। কামরার ভেতরের লোকগুলো কেমন যেন ভয়ে কুঁকড়ে গেছে। তারই মধ্যে কয়েকটা ছেলে মেয়েকে হুড়মুড়িয়ে ট্রেনের কামরায় উঠতে দেখলেন ইন্দুবালা। ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেনটা আবার চলতে শুরু করলো। এক নতুন দেশে বউ হয়ে আসার প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা বেশ মনে রাখার মতো হলো তাঁর। যে ছেলে-মেয়েগুলো হুড়মুড়িয়ে ট্রেনে উঠেছিল তাদের মধ্যে একজনের মাথা ফেটেছে। কোনো রকমে সে হাত দিয়ে চেপে আছে ক্ষত জায়গাটা। রক্তে ভাসছে জামা কাপড়। তারই পাশ থেকে একটা ছেলে চিৎকার করে বললো, “ভয় পাবেন না বন্ধুরা..যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দিনে একবেলা করে খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে নিজের ক্যাবিনেটের মন্ত্রীদের পেট ভরাচ্ছেন সেই শাসনের অবসান চাই আমরা। যে তীব্র খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে গোটা রাজ্য জুড়ে সেটা আর যাই হোক এই সরকার সামলাতে অপারগ…তাও আমরা যারা দুবেলা দুমুঠো এখনও খেতে পাচ্ছি.. রেশনে গিয়ে পচা চাল আর গম কিনতে পারছি; তাঁরা যদি এগুলো যারা একদম পারছেন না তাদের সাহায্যে কিছু দান করেন তাহলে লোকগুলো না খেয়ে অন্তত মরবে না। দয়া করে ভুলে যাবেন না এখনও এই দেশে একবেলাও খাবার না-জোটা লোকের সংখ্যাটা অনেক।” একটা ছিপছিপে ছেলে এতক্ষণ পুলিশের সাথে লড়ে শিরদাঁড়া সোজা করে বলে চলেছিল কথাগুলো। আর তারই বন্ধুরা ট্রেনের যাত্রীদের সামনে গিয়ে হাতে একটা টিনের কৌটো নাড়িয়ে অনুদান চাইছিলো। সবটাই ইন্দুবালার কাছে নতুন। ধনধান্য পুষ্প ভরা গ্রাম থেকে এ কোন দেশে এলেন তিনি, যেখানে সরকার বলছে একবেলা খাও! পাশ থেকে খবর কাগজ পড়া মধ্যবয়স্ক লোকটা মাস্টার রতনলাল মল্লিককে বললেন, “খাদ্য আন্দোলন চলছে বুঝলেন কিনা। আইন হবে নাকি একবেলা ভাত আর এক বেলা রুটি খাবার। সরকার চাকরিও দিতে পারছে না। খেতেও দিতে পারছে না। দেশটার কী অবস্থা হয়েছে বুঝুন তাহলে…।” মাস্টার রতলনাল মল্লিক লোকটাকে পাত্তা দিলেন না। দ্বিতীয় বিয়ের ধাক্কা সামলাতে তিনি বেশ ক্লান্ত। ট্রেনের দুলুনির সাথে আবার ঝিমোতে শুরু করলেন। একজন তারই বয়সী মেয়ে ইন্দুবালার সামনে এসে যখন অনুদানের কৌটো ধরলো তখন খুব ইচ্ছে করলো মেয়েটির সেই কৌটোতে দু আনা হলেও দিতে। কিন্তু সেই মুহূর্তে ইন্দুবালার কাছে কোনো নয়া পয়সাও ছিল না। অথচ গা ভর্তি ছিল সোনার গয়নায়। হকৌটো ধরা মেয়েটা কেমন অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল ইন্দুবালার দিকে। একটা বালা কিংবা হার খুলে যদি দিতে পারতেন তিনি। মানুষগুলো না খেয়ে আছে যে।
তাঁর গ্রামে কপোতাক্ষের জল ঢুকে পড়লে বন্যা হতো। স্কুল বাড়ির পাকা দাওয়ায় গিয়ে উঠতো লোকজন। ঠাম্মা বাবাকে দিয়ে তার অনেক আগে থেকে চাল, ডাল পাঠিয়ে দিতেন বাড়িতে যা থাকতো। গ্রামের লোকেরাও মজুত করতো। সবাই এক সাথে রান্না খাওয়া হতো তখন। কত দূর দূর থেকে বুক পর্যন্ত জল ঠেলে মানুষগুলো খিচুড়ি নিতে আসতো। বড় যত্ন করে রাঁধতেন ইন্দুবালার ঠাকুমা। “অন্ন হচ্ছে লক্ষ্মী। মানুষের পাতে তুলে দিলে পুণ্যি হয়। যে দেশের সব মানুষ দুবেলা দুটো অন্ন পায় সে দেশের ভাণ্ডার ধন ধান্যে পূর্ণ হয়” বলেছিলেন ঠাকুমা। ইন্দুবালা সবেমাত্র তাঁর হাতের বালাটা খুলতে যাবেন বলে মনস্থির করছিলেন আর ঠিক সেই সময়ে তাঁর স্বামী মাস্টার রতনলাল মল্লিক খিঁচিয়ে উঠলে সরে গিয়েছিল অনুদান চাইতে আসা মেয়েটা। খারাপ লেগেছিল ইন্দুবালার। মানুষগুলোর পেটের ভাতের জন্য ওরা রাস্তায় নেমেছে। ভিক্ষে করছে। তারা যদি দুবেলা ভরপেট খেতে পারে তাহলে যে দোরগোড়ায় এসে অভুক্ত দাঁড়াচ্ছে, সে পাবে না কেন? সেই ইন্দুবালা তখনও জানতেন না তিনি একদিন একটা ভাতের হোটেলের মালিক হবেন। দুবেলায় তাঁর হোটেলে পাত পড়বে অসংখ্য মানুষের। সেই হোটেল থেকে বিনা পয়সাতেও খাবার বিলির বন্দোবস্ত থাকবে। সেটা সত্তরের জ্বালাময়ী দিনগুলোতেই হোক কিংবা তারও অনেক পরে মানুষগুলোর কাজ হারানোর সময়, সবাই জেনে গিয়েছিল এই একটা জায়গায় এমন এক অন্নপূর্ণা আছেন যাঁর ভাতের হাঁড়ি কারও জন্যে কোনোদিন খালি হয় না।