মাঝে মাঝে এইসব জিনিসপত্র নিয়ে যে গোল বাধে না তেমনটা নয়। বেশ ভালোই চিৎকার চেঁচামেচি হয়। ধনঞ্জয় তখন তোক ডেকে নিয়ে এসে রেগেমেগে কিলো হিসেবে বিক্রি করে সব কিছু। বুড়ি ঘুরঘুর করে চারপাশ। “ওরে মূর্খ তুই কী করে জানবি .. ঠাম্মা বলতো বাড়ির আগাছাটাও তো দরকারি। নাহলে হরিমতি খাবে কী? আর দুধ দেবেই বা কী করে?” ধনঞ্জয় কাঁই মাই করে ওঠে। “বারবার তোমার খুলনার কলাপোতার গল্প শুনিও না তো মা। এখানে তোমার কোথায় হরিমতি? পোড়া দেশলাইয়ের কাঠি তোমার কাছে আগাছা? এই এত এত ঘিয়ের খালি শিশি? রঙ চটে যাওয়া টিনের বাক্স?” টান মেরে উঠোনে ফেলেছিল ধনঞ্জয়। কেমন যেন আর্তনাদ করে উঠেছিল সেই কতদিন আগের ফুলছাপ তোরঙ্গটা। ডালাটা হাঁ করে খুলে পড়েছিল উঠোনে। ঠিক মরে যাওয়া মানুষের মতো। তার মুখ দিয়ে কিলবিল করে বেরোচ্ছিল আরশোলা। তারাও যেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম খুলনার কলাপোতার স্বপ্ন নিয়ে বংশ বিস্তার করে চলেছে। “এটা তুই কী করলি ধনঞ্জয়? আমার এত দিনের জিনিসটা তোর কাছে পুরোনো মনে হলো?” ইন্দুবালা এগিয়ে যাচ্ছিলেন একটু একটু করে তোরঙ্গটার দিকে। ধূসর হয়ে যাওয়া সবুজ রঙের ওপর লাল লাল ফুল। সেগুলোও কেমন যেন ঝরে পড়ার আগে তাকিয়ে আছে ইন্দুবালার দিকে। “আমার বিয়ের সময় বাবা কিনেছিলেন ঢাকা থেকে। তারপর তিনটে নদী পার করে নিয়ে গিয়েছিলেন খুলনা। সেখান থেকে এই কলকাতা।” ধনঞ্জয় ক্ষয়ে যাওয়া নারকেল ঝাঁটায় আরশোলা মারতে মারতে বলে “তাহলেই বুঝে দেখো আর ওর জেবন প্ৰেদীপ থাকতে পারে? নিবে গেছে গিয়ে কবে।” ছ্যাঁৎ করে বুকে বাজে যেন ধনঞ্জয়ের কথা। তোরঙ্গের জীবন প্রদীপ নিভতে পারে তাহলে ইন্দুবালার নয় কেন? তাঁরও তো কম পথ অতিক্রম করা হলো না। এখনও কোন মায়ায় আটকে আছেন তিনি? কেনই। বা আছেন? কেমন যেন দম বন্ধ লাগে তাঁর। ঘাড় তুলে তাকান ইন্দুবালা এক টুকরো আকাশ দেখার জন্য। কিন্তু এখানে আকাশ কোথায়? ওই তো চার কোণের চৌখুপ্পি। তার ওপরে বাড়ির পেছনের আম গাছটা ঝাঁকড়া হয়ে এসে পড়েছে খানিকটা ভেতরে। কাঁচা আম গুলো পুরুষ্টু হয়েছে গ্রীষ্মের রোদের খর তাপে। মন খারাপটা যেন কোথাও ঝুপ করে গায়েব হয়ে যায় ইন্দুবালার। আম দেখার আনন্দে এগিয়ে যেতে গিয়ে পায়ে কিছু একটা ঠেকে। নীচু হয়ে কুড়িয়ে নেন। সেই কবেকার প্রথম ট্রেনে চড়ার টিকিট!
“বিলাতি আমড়া খাবে গো নতুন বউ? বিলাতি আমড়া?” ফেরিওয়ালা হাঁক দিয়ে যায় ট্রেনের কামরায়। মুখের সামনে এনে দেখায় আমড়াগুলো। ততক্ষণে ইন্দুবালার কপালের চন্দন ফিকে হয়ে গেছে। গলায় রজনীগন্ধার মালা বাসি। চোখের কাজল কিছুটা ধেবড়ে গেছে। বাকিটা রাখা আছে বিস্ময়ে মাখামাখি হয়ে। মাথা নাড়েন ইন্দুবালা। না, তিনি খাবেন না। জানলার দিকে তাকিয়ে ভাবেন এই ফল আবার কিনে খেতে হয় নাকি? তাঁদের গ্রামে ফেলা-ছড়া যেত। কাঁচা কাঁচা পেঁসো আমড়া পেড়ে আনতো ভাই। মা চাটনি করতো। নুন দিয়ে কুটি কুটি করে কেটে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে দিদি ভাইতে খেতো বোসদের পুকুর পাড়ে বসে। বৃষ্টির জল মেখে আমড়া পাকতো অম্বুবাচি পার করে। সেই সময় ঠাম্মার প্রায় সারাদিন উপোস। এক বেলা ফলাহার। কখনও ছাতু ভিজে। কিংবা সারাদিন মিছরির জল। বাবা এনে দিতেন সন্দেশ, কলা। সেইসব মুখে তুলতেন না তিনি বড় একটা। সব যেত নাতি নাতনির পেটে। অত বার চা খাওয়া যার অভ্যেস ছিল, সেও ওই কটা দিন চা না খেয়ে দিব্যি কাটিয়ে দিত। ইন্দুবালা বিধবা হবার পর এতসব কিছু মানেননি। তাঁর পক্ষে সম্ভবও ছিল না। আর লছমী থাকতে তা করতেও দিত না। মাস্টার রতনলাল মল্লিক তাঁকে অনেক ছোটো বয়সে বিধবা করে কেটে পড়েছিলেন পরপারে। দায় ফুরিয়েছিল তাঁর। বড় ছেলেটাও এত ছোট তখন যে মালসায় ফুটিয়ে হবিষ্যির ভাত খাবে কী করে! মাঝরাতে মরেছিলেন মাস্টার রতনলাল মল্লিক। সকাল গড়িয়ে গেলেও কোনো আত্মীয় কুটুম কেউ খোঁজ নিতে আসেনি। এমনকি যাদের সাথে নেশা করে ভাসিয়ে দিতেন সেই ইয়ারদোস্তরাও না। মাছ বিক্রি করতে এসে দরজা ধাক্কিয়ে ছিল লছমী। নীচে সাড়া শব্দ না পেয়ে সটান ওপরে উঠে এসেছিল সে। দেখেছিল মরা আগলে বসে আছে মল্লিক বাড়ির বাঙাল বউ ইন্দুবালা। দৃষ্টি স্থির। চুল এলোমেলো। চোখে জলের আভাসটুকু পর্যন্ত নেই। পাথরের মতো বসে আছে একটা মানুষ। মড়ার পাশেই ঘুমোচ্ছে তিন-তিনটে বাচ্চা। লছমী ডেকেছিল “মা..”। ইন্দুবালা ফিরে তাকিয়ে ছিলেন তার দিকে। সেই চাহনি দেখে লছমী কী বুঝেছিল কে জানে? বাজার থেকে জড়ো করে নিয়ে এসেছিল লোক। তারাই খাট, ফুল, খই জোগাড় করেছিল। শ্মশানে গিয়েছিলেন ইন্দুবালা তিন ছেলে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে। নিজে হাতে স্বামীর মুখাগ্নি করেছিলেন। শ্রাদ্ধও।
নিয়মভঙ্গের দিন লছমীর এনে দেওয়া ট্যাঙরা মাছ আর বাড়িতে দেওয়া বড়ি দিয়ে একটা তরিজুতের ঝোল বেঁধেছিলেন। অনেক দিন পর ছোটো ছোটো ট্যাঙরার মাথাগুলো চুষে চিবিয়ে খাওয়ার সময় মনে পড়েছিল ঠাম্মার কথা। অম্বুবাচিতে সারাদিন উপোস করে থাকার পর ছাতু খেতে খেতে তাঁর যখন আর কিছু মুখে রুচতো না তখন খোসা ছাড়িয়ে পাকা আমড়া মুখের কাছে ধরতেন ইন্দুবালা। ঠাম্মা চুষে চুষে সেই বুনো ফলের সব রসটুকু খেয়ে নিতো। সারা ঘর ম ম করতো পাকা আমড়ার গন্ধে। এসব কথা কোনোদিন ইন্দুবালা কাউকে বলতে পারেননি। এমনকি ছেলে-মেয়েদেরকেও না। নাতি নাতনি তো অনেক দূরের কথা। কিছু কিছু জানতো মাছওয়ালী লছমী, কিন্তু সে তো আজ কোন সুদূরের অতিথি।