এইসব কিছু ভাবলে এখনও চিকচিক করে ওঠে ইন্দুবালার চোখ। মাথা ঢিপ ঢিপ করে। শরীর করে আনচান। মনে হয় প্রেশারের ওষুধ খেতে বুঝি ভুলে গেছেন। বেতের ছোট্ট ঝাঁপি খোলেন। ওষুধ খান। ওপরের জানলা দিয়ে সকালের বাগানটাকে এই ছেনু মিত্তির লেনেও স্বপ্নের মতো মনে হয়। রান্নাঘর ভরা খাবার শাশুড়ি দেখাতে পারেননি ঠিকই। কিন্তু তাঁর দূরদৃষ্টি ছিল প্রখর। বুড়ি হাত ধরে নিয়ে এসেছিলেন নতুন বউকে বাড়ির পেছনের বাগানটায়। বলেছিলেন, “চোখ ভরে দেখ বউ। কেমন উপোছাপা হয়ে আছে আমার সংসার। বেধবা মানুষ আমি। শুভকাজে ভাতের হাঁড়ি চাপানোর অধিকার নেই আমার। নিজের সংসারে অমঙ্গল করতেও চাইনে। বাগান থেকে নিজের ইচ্ছে মতো যেটা মনে হয় সেটা তুলে আন গে। নিজের বউভাতের রান্নাটা যে আজ তোকেই করতে হবে”। কেমন যেন চমকে ওঠেন ইন্দুবালা। এর আগে কলাপোতায় রান্না করেননি এমনটা নয়। জোর করে ঠাম্মা রান্না করাতো নিজের কাছে নিয়ে বসে। কখনও সখনও নিজেরও ইচ্ছে করতো। ভাইকে বলতেন “যা তো কলাপাতা কেটে নিয়ে আয়। আজ চড়ইভাতি হবে”। ভাই আরও কয়েকজনকে জুটিয়ে একগাদা শুকনো খেজুরের পাতা টানতে টানতে নিয়ে চলে আসতো। খেজুরের শুকনো পাতার আঁচে ইন্দুবালা খুদ জাল দিতেন। ছোটো ছোটো আলু কেটে, নতুন ওঠা পেঁয়াজ কুচো করে, লঙ্কা চিরে লাল করে ভাজতেন। সবাই মিলে উঠোনে বসে যেন অমৃত খাচ্ছেন বলে মনে হতো। কিন্তু তাই বলে শ্বশুরবাড়িতে ঢুকতে ঢুকতেই তাকে রান্না করতে হবে? এমনকি নিজের বউভাতের রান্নাটাও? এই যে বাবা বলেছিল ছেলে নাকি মাস্টার? শিক্ষাদীক্ষা আছে। দোতলা পাকা বাড়ি। জমিদারের বংশ। রাজ্যের চাকর-ঝি। “আমাদের ইন্দু খাটের ওপর পা তুলে বসে খাবে”। খুব একটা বেশি দিন লাগেনি নিজের শ্বশুরবাড়ির স্বরূপ চিনতে ইন্দুবালার। যে স্বামীকে ‘মাস্টার’ বলে পরিচয় করানো হয়েছিল মেয়ের বাড়িতে সম্বন্ধ পাতানোর সময়, তিনি মাস্টার ছিলেন বটে তবে তাস, পাশা, জুয়ার। চিৎপুর যাত্রা পাড়াতেও বেশ যাতায়াত ছিল তাঁর। রথের পরে পরেই আর ঘরে মন টিকতে চাইতো না। মুখে বলতেন পালাকার। কিন্তু আদপেই তার ধারে কাছে কোনো কলম কোনোদিন দেখেননি ইন্দুবালা। এমনকি এক ছত্র লিখতেও না। কাজেই স্বামী মাস্টার রতনলাল মল্লিক যাই বলতেন তাই যে ইন্দুবালা বিশ্বাস করে যেতেন তেমনটা নয়। কিছুটা বিদ্যে তাঁর পেটেও ছিল। শুধু প্রথম যেদিন তাঁর সামনে কাবুলিওয়ালা রতনলালকে পিটলো সেদিনই সব কিছু আরও পরিষ্কার হল। হেন নেশা ছিল না যা স্বামী করতেন না। এপাড়া বেপাড়ায় তাঁর ভালোবাসার মানুষের অভাব ছিল না। শুধু তারা ভালোবাসতো টাকার বিনিময়ে। আর টাকা যেত ইন্দুবালার গয়না বিক্রি করে। কাবলিওয়ালা যখন বাড়ির সামনে অমন বড় মানুষটাকে বেধড়ক জুতো খুলে মারছে কেউ এগিয়ে যায়নি। অন্য শরিকরা মুখ চাপা দিয়ে হাসাহাসি করছিল। শাশুড়ি গিয়েছিলেন গঙ্গা স্নানে। ইন্দুবালা কী করবেন বুঝতে না পেরে মাথায় ঘোমটা টেনে সটান রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। কী মনে হয়েছিল কাবলিওয়ালাটার কে জানে। রতনলালকে ফেলে রেখে দু দিনের নোটিশ দিয়ে চলে গিয়েছিল সে। যাবার আগে বলে গিয়েছিল “এমন ছ্যাঁচড়া আদমির সাথে আছিস কী করে মা তুই?” সেদিনই মাস্টার রতনলাল মল্লিকের অন্য নামটাও জেনে যান ইন্দুবালা। সবাই তাকে অলক্ষ্যে ছ্যাঁচড়া বলে ডাকে। দৈব্যের কী পরিহাস বিয়ের পরে প্রথম দিন শ্বশুরবাড়ির ছোট্ট বাগানে শাশুড়ি যখন ইন্দুবালাকে একা দাঁড় করিয়ে দিয়ে চলে গেলেন তখন ইন্দুবালা দেখেছিলেন মাচার ওপরে পুঁইশাকের নতুন পাতা ওঠা ডগা। মাথা উঁচু করে যেন আকাশ দেখতে চায় তারা। ঝুড়ি ভরে পুইশাঁক তুলে নিয়ে এসেছিলেন মনের আনন্দে। কারণ তিনি জানতেন বাবা মেয়েকে দিয়ে যাওয়ার সময় মিষ্টি, কাপড় আরও অনেক কিছুর সাথে দিয়ে গেছেন দুটো বড় ইলিশ। ইলিশের মাথা আর পুঁইশাক দিয়ে অসাধারণ ছ্যাঁচড়া রান্না করেছিলেন সেদিন ইন্দুবালা। অত বড় ডাকাত চেহারার স্বামী আধ কড়াই ছ্যাঁচড়া একা নিজেই সাবাড় করেছিলেন। প্রথম রাতে তাই সোহাগ উঠেছিল তার দিক থেকে মাত্রা ছাড়া। ইন্দুবালা এত সবের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। যখন ঘাড়ের ওপর ওই দশাসই চেহারা চেপে বসে একটু একটু করে কৌমার্য শুষে নিচ্ছিল তাঁর, তখন একবারের জন্যেও মনিরুলকে মনে পড়েনি ইন্দুবালার। ব্যথায় চোখ বন্ধ করলে উঠোনের জোনাকি গুলোকে দেখতে পেয়েছিলেন স্পষ্ট। পুকুর পাড়ের কাঁচা মিঠের আম তার ডালপালা নেড়ে ফিসফিস করে বলেছিল “নিয়তি…ইন্দুবালা..নিয়তি…”।
সামনের ভটচাজ বাড়ি থেকে গিন্নি তাঁর নাতনি রাকাকে পাঠিয়েছে। সে নাকি এবার সায়েন্স না কীসব নিয়ে পড়ছে। কলেজে ভর্তি হয়েছে। একটা সুন্দর দেখতে ট্যাব তার হাতে। ইন্দুবালা আঁচলে চশমা মোছেন। এগিয়ে আসেন রাকার দিকে। এক্কেবারে মায়ের মুখ বসানো। থুতনি ধরে চুমু খান। “ভালোই হয়েছে। ভাগ্যিস শান্টুর মতো হোসনি। যা দস্যু ছিল ছেলেটা। মেয়েরা মায়ের মুখ পেলে জীবনে শান্তি পায়। জানিস কি সেটা?” রাকা মাথা নাড়ে। এইসব কিছুই সে জানে না। জামশেদপুরে থাকতো। বাবা কলকাতার কলেজে ভর্তি করে দিয়ে বললো এখানেই পড়াশুনো করো। পড়াও হবে আর দাদু-ঠাম্মাকে দেখাও। হাসেন ইন্দুবালা। “তা ভালো। তারা ছাড়া আর ওদের কেই বা আছে বল? তা সায়েন্স নিয়ে পড়ছিস। অতবড় কলেজ। আমি তোকে কী পড়াবো? ছেলেদেরই আমি পড়াতে পারিনি কোনদিন। সব লোক রাখতে হয়েছিল। ইতু তো দাদাদের কাছেই পড়েছে। আমি কী শেখাবো বলতো তোকে?” আমতা আমতা করে বলেন ইন্দুবালা। এমনিতেই গা টা ম্যাজম্যাজ করছিল বলে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে। আচারের বয়ামগুলো জানলার রোদে রাখেন। মাথার ওপর কাপড়ের সাদা ঢাকনাগুলোকে পালটান। ধনঞ্জয়কে উনুন ধরাতে বলেন। রাকা পেছন পেছন ঘুরঘুর করে। ভালো লাগে ইন্দুবালার। নিজের নাতি-নাতনিগুলোর থেকেও বয়সে কত ছোটো। বাড়িতে এমন একটা কেউ না থাকলে চলে? কেমন যেন ছেলেগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। মেয়েটার কথাও। নাতি নাতনি-নাতবউ ভরা সংসার তাঁর। কী এমন ক্ষতি হতো এই বাড়িটায় সবাই মিলে একসাথে থাকলে? ঠিক আছে। না থেকেছে ভালো হয়েছে বাবা। তারপর সেই তো কাটাকাটি, লাঠালাঠি। কম ঝক্কি পোহাতে হয়েছে এক সময়ে এই বাড়ির ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে। ভাগ্যিস উনি বেঁচে থাকতে থাকতে ব্যাপারটা সেরে গিয়েছিলেন না হলে তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে গঙ্গায় গিয়ে ডুবে মরতে হতো। ভালোবাসতেন কি বাবু মাস্টার রতনলাল ইন্দুবালাকে? জিজ্ঞেস করেননি কোনোদিন ইন্দুবালা। স্বামীর সাথে কথা হতো কতটুকু? শুধু শেষ কয়েকদিন বিছানার সাথে যখন মিশে গিয়েছিলেন নিজের মায়ের মতোই, পেটটা ফুলে উঠেছিল বেঢপ। ডাক্তার বলেছিল জল জমেছিল পেটে। অথচ মধ্যরাতে যখন গঙ্গার জল খেতে চেয়েছিলেন, ইন্দুবালা জল গড়িয়ে এনে দেখেছিলেন সব শেষ। বাচ্চাগুলোর তখনও বোঝার বয়েস হয়নি কী ক্ষতি হল তাদের জীবনে। নাকি এই নরক থেকে চিরকালের মুক্তিলাভ!