বিয়ের অনেকদিন পরে শাশুড়ি যখন আর নেই। স্বামীর বাইরে থাকা এবং নেশার মাত্রা পাল্লা দিয়ে যখন আরও বেড়েছে। সংসারের হাল হয়েছে না খেতে পাওয়া মানুষগুলোর মতো। ইন্দুবালা হিমশিম খাচ্ছেন ছোট্ট দুটো ছেলে আর কোলের মেয়েকে নিয়ে, তখন একজন ভদ্রলোক দেখা করতে এলেন তাঁর সঙ্গে। সন্ধ্যের আলোতে জীবনের প্রথম প্রেমকে চিনতে একটুও দেরি হয়নি তাঁর। মনিরুলকে আরও সুন্দর লেগেছিল সেদিন। চশমা পরে চুপটি করে দাঁড়িয়েছিল দরজার সামনে সে। হাতে ছিল একটা চিরকুট। সেখানে পেন্সিলে অস্পষ্টভাবে লেখা ছিল ছেনু মিত্তির লেনের ঠিকানা। এত গল্প করা ছেলেটা এত শান্ত হয়ে যায় কী করে? বাড়ির ভেতরে এনে বসিয়েছিলেন মনিরুলকে। রান্নাঘরে ঢুকে আতিপাতি খুঁজছিলেন কী দিতে পারেন খেতে। অসহায় লাগছিল তাঁকে। বড়। কৌটোর তলানিতে পড়েছিল একটু চিড়ে সেইটুকুই ভাজলেন। সঙ্গে দিলেন চা। মনিরুলেরও বসার সময় ছিল না সেদিন। আত্মগোপন করে আছে যে সে কলকাতায়। পাকিস্তানের ঝানু গুপ্তচর ঘুরছে তাদের পেছনে। বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্যে একটা বড় দায়িত্ব নিয়ে এসেছে সে ইণ্ডিয়ায়। বালিগঞ্জের কোথাও ওরা একটা রেডিও স্টেশন খোলার চেষ্টা করছে। স্বাধীন বাংলাদেশের বেতার। ইণ্ডিয়া সরকার তাদের সব রকম সাহায্য করছে। “একটা স্বাধীন দেশ পেতে চলেছি ইন্দু.. আর কোনো ভাবনা নেই…।” চোখ মুখ যেন জ্বলজ্বল করছে মনিরুলের। ইন্দুবালারও কি ইচ্ছে হচ্ছে না? আজ ওর হাত ধরে যদি সে সত্যিই বেরিয়ে যেতে পারতো। দেশের কাজে। কী ভালোই না হতো! কিন্তু যে চক্রব্যুহের মধ্যে তিনি তখন আটকে পড়েছেন সেখান থেকে বেরোবেন কী করে? একদিকে মাতাল নেশাতুর স্বামী। অন্যদিকে ছোটো ছোটো তিন ছেলে মেয়ে। ইন্দুবালার জগৎ তখন অন্য। মল্লিক বাড়ির বউ তিনি। চলে যাবার আগে ইন্দুবালার হাতে মনিরুল দিয়ে গিয়েছিল ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’ বইটা। তার প্রথম পাতায় সই করে লেখা ছিল “ইন্দুকে..জসীমউদ্দিন”। চোখে জল ভরে এসেছিল ইন্দুবালার। এমন উপহার আজ পর্যন্ত কেউ তাকে দেয়নি। মনিরুল বলেছিল কবির সাথে দেখা হওয়ার বিস্তারিত গল্প। বলেছিল ইন্দুবালার বাড়ির কথা। তাদের ছোট্ট গ্রাম কলাপোতার কথা। তাল পাটালি আর তিলের নাড়র কথা। কবির চোখে যেন জল দেখেছিল মনিরুল। সঙ্গে সঙ্গে লিখে দিয়েছিলেন তিনি। এখনও মনে আছে তাহলে সব কিছু মনিরুলের? ভোলেনি সে কিছুই? না, মনিরুল ভুলে যায়নি। মনিরুল ভুলতে পারে না। বিয়েও করেনি সে। করতে পারতো না মণিরুল। রূপাই কি বিয়ে করেছিল আর? কবরে মাথা রেখে মরেছিল সে। মনিরুল মরবে দেশের জন্য। স্বাধীনতার জন্য। বাংলা ভাষার রাষ্ট্র গড়ার জন্য। এটা তার ভালোবাসার দিব্যি। এত কথা সেদিন মনিরুল ইন্দুবালাকে বলে আসতে পারেনি। বলে আসা যায় না। কিছুটা সঙ্গোপনে বয়ে বেড়াতে হয়। আর কিছুটা হারিয়ে যায়। মনিরুল সেটা জানতো। এরপর থেকে ইন্দুবালা পাগলের মতো খুঁজে চলতেন স্বাধীন বাংলার রেডিও স্টেশন। পেয়েও যেতেন মাঝে মাঝে। বাঁশির সুরে চিনতে পারতেন মনিরুলকে। হঠাৎই মনে পড়ে যেত কপোতাক্ষের ঘাট। সন্ধ্যেতে বাড়ির দাওয়া। স্কুলের মাঠ। বিশালাক্ষী তলা। মনিরুলকে ভোলা যায় না। মনিরুলকে ভুলতে পারেননি ইন্দুবালা। কিন্তু সেই মনিরুলও সত্যি সত্যি হারিয়ে গিয়েছিল একদিন চিরকালের মতো। যাওয়ার আগে শেষবারের মতো দেখা হয়েছিল ইন্দুবালার সাথে। সে তো আরও একটা ভুবন কাঁপানো গল্প। সেদিকে এখন প্রবেশ করলে ইন্দুবালার প্রথম জীবন অধরা থেকে যাবে। সংসারটা আর যে আর ঠিক করে করা হয়ে উঠবে না।
সেই যে এক ভরা বর্ষায় বিয়ে হয়ে ছেনু মিত্তির লেনের স্যাঁতসেঁতে বাড়িটায় ঢুকলেন তারপর তো আর কোথাও যাওয়া হয়নি তাঁর। একটিবারের জন্যেও না। বাপের বাড়ি যাওয়া কঠিন ছিল। খরচ ছিল, ভিসার ব্যাপার ছিল। এক এক করে সব গয়না বিক্রি করে সংসার চালাতে গিয়ে নিজের দেহকে অলঙ্কারহীন করে ফেলেছিলেন ইন্দুবালা। মায়ের সামনে দাঁড়ালে তক্ষুনি বুঝে যাবে যে। তাই বিয়ের পর একমাত্র গঙ্গাস্নান ছাড়া আর কোথাও যাননি ইন্দুবালা। সেই যে এসে মল্লিক বাড়ির রান্নাঘরে ঢুকেছিলেন আজও আছেন। কিন্তু তার জন্য কোনো খেদ নেই তাঁর মনে। বিয়ের পরে নতুন বউকে স্বামীর বাড়িতে এসে প্রথম দিনই দেখতে হয় রান্নাঘর ভরা আছে তোলা তোলা খাবারে। ডেকচি ভরা ডাল। কড়া ভরা মাছ। হাঁড়ি ভরা ভাত। দই, মিষ্টি। পেতলের পাত্র থেকে উথলে ওঠা দুধ। চারিদিকে ভরা ভরা সব কিছু। ভরা দেখলে তবেই না গেরস্থের সংসার সব ভরে উঠবে। কোলে-কাঁখে মা ষষ্ঠী কৃপা করবেন বছরের পর বছর। “শ্বশুরবাড়িতে প্রথমে রান্নাঘরে গিয়েই যেন হ্যাংলার মতো চোখ বড় বড় করে সব কিছু দেখো না।” পাখি পড়ানোর মতো শিখিয়ে দিয়েছিলেন মা। “যা লোভী মেয়ে একটা। হয়তো দেখা গেল রান্নাঘরে ঢুকেই শুক্তোর পাত্র নিয়ে বসে গেল। পাঁচ ভাজা থেকে নারকেলগুলো তুলে তুলে খেতে শুরু করলো। আনারসের চাটনি আর কারোর জন্যে একটুও রইলো না। তখন কি বেইজ্জতিটাই না হতে হবে কুটুম বাড়িতে।” ছোটো ভাই পাশ থেকে বলে “আর রসগোল্লা মা? কলকাতার বড় বড় মিষ্টি। সেগুলো দিদিভাই খাবে না? কিরে খাবি না?” বিরক্ত হয়ে উঠে গিয়েছিলেন ইন্দুবালা। বয়ে গেছে তাঁর একটা অপরিচিত বাড়িতে গিয়ে শুক্তোর হাঁড়ি নিয়ে বসতে। নারকেল ভাজা খেতে। কত যে আনারসের চাটনি করো? ওই তো গাছেই পচ্ছে ফলগুলো। বয়ে গেছে… বয়ে গেছে… বয়ে গেছে। খাবেন না ইন্দুবালা কিছু। সামনে এসে বাবা, বাছা করলেও নয়। তখন অবশ্য বুঝতে পারেননি এতসব কিছু ইন্দুবালার কপালে জুটবে না কোনোদিন। প্রথম বউ মারা যাবার এক বছরের মধ্যে বিয়ে হচ্ছে বলে সব কিছু লুকিয়ে রেখেছিল শ্বশুরবাড়ি। এমনকি বিয়েটাও। হঠাৎ হয়ে গেলে যেমনটা হয় ঠিক তেমনটা। অথচ এইভাবে কলাপোতায় বিয়ে হয়নি ইন্দুবালার। রীতিমতো জাঁক করে তিন গ্রামের মানুষ খাইয়ে নিজের মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন ব্রজমোহন। ঠাম্মা সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। বরযাত্রী বলতে বরের সাথে মোটে চারটে মানুষ এসেছে? পুরোহিত, নাপিত আর বরের দুই বন্ধু? ব্যস? বাবা বলেছিল “বুঝতে পারছো না কেন মা পাসপোর্ট ভিসার খরচ নেই? ওদিকেও তো ওদের অনুষ্ঠান আছে নাকি?” কিন্তু এদিকে সত্যিই কোনো অনুষ্ঠান ছিল না। কোনো লোকজন আসেনি। সানাই বাজেনি। একটা ন্যাড়া বাড়ি দেখে বাবার শুধু চোখ উজিয়ে জল এসেছিল। বাড়ির বাইরে থেকে মেয়েকে বিদায় জানিয়ে ভাইয়ের হাত ধরে তক্ষুনি ফিরে গিয়েছিলেন দেশে। মেয়ের মুখের দিকেও তাকাতে পারেননি। হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন কী মারাত্মক ভুলটা সত্যি তিনি করে ফেলেছেন এই বাড়িতে মেয়ের বিয়ে দিয়ে। ইন্দুবালার ইচ্ছে করছিল ছুটে চলে যান বাবা-ভাইয়ের সাথে। যেতে পারেননি। তারও বেশ কিছুদিন পরে পোস্টকার্ডে পেয়েছিলেন বাবার মৃত্যু সংবাদ। তখন আর যেতে পারেননি। শাশুড়ি ছিলেন অসুস্থ। গয়না বিক্রি করে যাওয়ার মতো অবলম্বনটুকুও ছিল না। নদীর ধার থেকে বিদায় দিয়ে এসেছিলেন মা-ঠাম্মাকে। বাবাকে বিদায় দিয়েছিলেন শ্বশুরবাড়ির দরজায়। ভাই এসে দিদিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু সেও জানে কোথায় নিয়ে যাবে তার দিদিকে? আর কীভাবে? ততদিনে যুদ্ধের দামামা বেজে গেছে। একের পর এক গ্রাম জ্বলছে। ভাইকে সেবারে ঠিক মতো খাওয়াতেও পারেননি ইন্দুবালা। কবেকার সেই পুরোনো কথা এখনও এঁটুলির মতো আটকে থাকে ইন্দুবালার সাথে। সবাইকে হারিয়ে এখন তিনি একা। তার কলাপোতার ভিটেবাড়ির মতো। ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের মতো। বাগানের পেছনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা নারকেল গাছটার মতো একা।