ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ির একটি জনপ্রিয় সামাজিক উপন্যাস বই। ইন্দুবালা ভাতের হোটেল বইটি সুপ্রকাশ প্রকাশনী ২০২০ সালে প্রকাশ করেছেন। বইটি বাংলার ঐতিহাসিক সামাজিক খাবারের গল্প নিয়ে রচিত হয়েছে। আপনে “ইন্দুবালা ভাতের হোটেল” উপন্যাসটি এখানে কোন প্রকার সমস্যা ছারাই পড়তে পারবেন। তাই আর দেরি না করে উপন্যাসটি পড়তে শুরু করুণ।
ইন্দুবালা ভাতের হোটেল বইয়ের বিবরণঃ
- বইয়ের নামঃ ইন্দুবালা ভাতের হোটেল
- লেখকের নামঃ কল্লোল লাহিড়ী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. কুমড়ো ফুলের বড়া
১. কুমড়ো ফুলের বড়া
জানালার কাছে বসন্তের নরম রোদে সার দিয়ে সাজানো আছে কাঁচের বড় বড় বয়াম। মুখগুলো ঢাকা আছে পরিষ্কার সাদা কাপড়ের ফেট্টিতে। বয়ামগুলোকে বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যায় না তার মধ্যে কী রসদ লুকিয়ে আছে। কিন্তু যারা এই বাড়িতে রোজ ভাত খেতে আসে তারা ঠিক জানে। ভাতের পাতে লেবু, নুন, লঙ্কা দেওয়ার পাশাপাশি উড়ে বামুন ধনঞ্জয় একটু করে শালপাতায় ছুঁয়ে দিয়ে যায় বয়ামের সেই লুকোনো সম্পদ। কামরাঙা, কতবেল, জলপাই কিংবা কোনোদিন পাকা তেঁতুলের আচার। নতুন কাস্টমাররা অবাক হয়ে যায়। আর পুরোনো লোকেরা ভাবে আজ কোনটা পাতে আসবে? শুধু আচারের টানেই না, এই হোটেলে ভিড় লেগে থাকে পুব বাংলার এক বিধবা মহিলার হাতের রান্না খেতে। ইন্দুবালা কবে যে এই ভাতের হোটেল শুরু করেছিলেন আর কেন করেছিলেন নিজেও ঠিক মনে করতে পারেন না। তবু ভাসা ভাসা ছবির মতো মনে পড়ে অনেক কিছু। শুধু সেবার যখন কোলের এক মেয়ে আর ছোট্ট দুই ছেলেকে নিয়ে বিধবা হলেন, সেদিন থেকে বুঝতে শুরু করেছিলেন যারা এতদিন ঘিরে রাখতো তাঁদের, যারা সুযোগ সুবিধা ঠিক মতো আদায় করে নিয়ে যেত, তারাই এখন ছায়ার মতো সরে যাচ্ছে। স্বামীর জুয়া আর মদের নেশায় এতদিন যারা আট-কপাটি পর্যন্ত বিক্রি করায় সায় দিয়েছিলো তাদেরও আর দেখা গেল না বড় একটা। বরং সবাই কেমন যেন হারিয়ে গেল চারপাশ থেকে। বলা যায় ছেড়ে চলে গেল।
তখনও খুলনা থেকে মাঝে মাঝে ভাই এসে খোঁজ খবর নিয়ে যেত ইন্দুবালার। মা পোঁটলা করে পাঠাতো ভাজা চিড়ে, মুড়ি, বাড়ির সজনের ডাটা, চুইঝাল। তারপর সেটাও বন্ধ হলো। যুদ্ধ বাধলো। বাড়ির অনেক দিন কোনো খোঁজ পেলেন না। একদিন সকাল বেলায় গাঁয়ের থেকে পালিয়ে আসা এক পাগলাটে লোকের কথায় জানতে পারলেন পুড়িয়ে দিয়েছে সব কিছু পাকিস্তানি মিলিটারি খান সেনারা। ভাই বাড়ির লোকজন আর কেউ বেঁচে নেই। এমনকি ভিটেটাও না। বাড়ির সামনের রাস্তাটায় বসে যুদ্ধের বীভৎসতার তাপ পোয়ানো লোকটা বিড়বিড় করে বকছিল। আর ইন্দুবালা তাঁর সমস্ত সত্তা নিয়ে মন দিয়ে শুনছিলেন কয়েকটা প্রিয় মানুষের তাঁর চারপাশ থেকে চিরকালের জন্য হারিয়ে যাওয়ার গল্প। ইন্দুবালা একা হয়ে পড়ছিলেন। বড় একা। একটা শহরে তিন ছেলে-মেয়ে আর পুরোনো বাড়িতে নিজের শরীরের সমস্ত যৌবন নিয়ে এক্কেবারে একা। না ইন্দুবালা কাঁদেননি। কাঁদার মতো সময় তাঁর ছিল, কিন্তু পরিস্থিতি ছিল না। ভেতর থেকে কেমন যেন শুকনো হয়ে গিয়েছিল সব কিছু। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা যেদিন উড়লো সে দেশের মাটিতে, এদেশে ইন্দুবালা ছেনু মিত্তির লেনের নীচের ঘর ঝাঁট দিয়ে উনুন ধরালেন। ভাঁড়ারে চাল ছিল বাড়ন্ত। ছেলেমেয়েগুলো খিদের জ্বালায় তারস্বরে কাঁদছিল। পাওনাদারের দল দাঁড়িয়েছিল রাস্তায়। লছমী মাছওয়ালী শেষ বাজারে একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরছিল। আর থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল নোনা ধরে ক্ষয়ে যাওয়া দোতলা বাড়িটার সামনে। লছমী দেখেছিল একটা বছর পঁচিশের মেয়ে সদ্য বিধবার সাদা ধবধবে শাড়িতে এলোচুলে চুপ করে বসে আছে ধরে ওঠা উনুনটার সামনে। উনুনে গুলের আঁচে ফর্সা মেয়েটার মুখ লাল হয়ে আছে। ওদিকে দূরে দাঁড়িয়ে আছে চিল শকুনের মতো পাওনাদাররা। লছমীর যেন কী একটা মনে হয়েছিল সেই মুহূর্তে। এই বাড়িতে মাছ বিক্রি করেছে সে বহুদিন। এই বাড়ির নুন খেয়েছে সে। একটুও সময় নষ্ট করেনি লছমী। সোজা এসে দাঁড়িয়েছিল ইন্দুবালার সামনে। গ্যাঁট থেকে দু টাকা বার করে মেঝের ওপর রেখে দিয়ে বলেছিল, “আজ তোমার বাড়িতে দুটো ভাত মুখে দেব মাজি। কছু মনে করো না। বারোটা পঁচিশের ক্যানিং লোকাল ছুঁড়ে গেল যে। এখন দুটো পেটে না পড়লে বাড়ি ফিরতে সাঁঝ হয়ে যাবে। আর শলীল চলবে না মাজি”।
ইন্দুবালা হ্যাঁ না কিছু বলেননি। তাঁদের খুলনার বাড়িতে অতিথিরা কোনোদিন ভাত না খেয়ে যায়নি। আজও তিনি লছমীকে ফেরত পাঠাতে পারলেন না। বলতে পারলেন না তাঁর ভাঁড়ারে ফোঁটাবার মতো চালটুকু নেই। লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে এক আনাও নেই যা দিয়ে তিনি তাঁর দোরে আসা লছমীকে মুড়ি কিনে খাওয়াতে পারেন। সাত-পাঁচ না ভেবে একটু কুণ্ঠা নিয়েই ইন্দুবালা লছমীর দেওয়া টাকাটা আঁচলে বাঁধলেন। উনুনে চাপালেন এক হাঁড়ি জল। ছোটো মেয়েকে দোতলার ঘরে ঘুম পাড়িয়ে এসে বড় ছেলে প্রদীপকে পাঠালেন সামনের মুদিখানার দোকানে। খিড়কির দরজা খুলে নিজে বাড়ির পেছনের বাগান থেকে নিয়ে এলেন সবে কচি পাতা আসা কুমড়ো শাক। গাছের পাকা লঙ্কা। শাশুড়ির আমলের পুরোনো ভারী শিলটা পাতলেন অনেক দিন পরে। যত্ন করে ধুয়ে সেই কবেকার প্রাচীন হিমশীতল পাথরটার ওপর রাখলেন সর্ষে দানা। শিল আর নোড়ার আদিম ঘর্ষণে খুলনা থেকে পাঠানো মায়ের শেষ সর্ষেটুকু বেটে ফেললেন ইন্দুবালা অল্পক্ষণের মধ্যেই। লোহার কড়াইতে জল মরতে থাকা সবুজ ঘন কুমড়োশাকের ওপর আঁজলা করে ছড়িয়ে দিলেন সর্ষের মণ্ড। কয়লার আঁচে টগবগ আওয়াজে ফুটতে থাকলো কচি শাকগুলো। তার নরম পাতাগুলো। সাঁতলানোর ঝাঁঝ ছড়িয়ে পড়লো গোটা বাড়িতে। দোতলার ঘরে খুকি চোখ মেলে হাত পা নেড়ে খেলতে থাকলো। ছোটো দুই ছেলে গরম ভাত খাওয়ার বাসনায় থালা নিয়ে এসে বসে পড়লো রান্নাঘরের দরজায়। তখনও লাল লঙ্কা গুলোর গা থেকে ঝাল মিশছে কুমড়ো শাকের হালকা সবুজ মাখো মাখো সর্ষে ঝোলে।