সে ক্রন্দন শুনিতে পাষাণ দ্রবীভূত হয়! কেদার দাস বলিয়াছিলেন এরূপ পাকা হাত ক্কচিৎ…একবার এক ছোকরা ডাক্তার এক পোয়াতি দর্শনে সেই গৃহস্থদের বলে,–যে মশাই কত বলিব–তোমরা গাছ চাহ না ফল চাহ…। আমার স্ত্রী বলেন তাহা শুনিয়া তাহার হাত অবশ। সেই বাড়ীর লোকেরা বলিল গাছ!
ঠিক এই সময়েতে নৃত্য উৎসবে বাড়ীর সিঁড়ির কাছে একটি ছোট ভীড় দ্বারা মধু মধুর হাস্য খেলিয়া উঠিল। যে বালিকা সেদিন চাননায়ার রোগা তীরে বালির বসত নির্ম্মাণ করিয়াছিল, আর যে, যে বালকের ভাগ্য, অপরূপ কান্তির নুড়ি সকল প্রাপ্ত ব্যাপারে, অতি অতি অতি শুভ সুপ্রসন্ন, আর এই বালকই বড় তীক্ষ্ণ তীব্র ভাবে চানোয়ার স্রোত দেখে, এবং এই দেখাঁটি ভবিষ্যতে যে কোন বহমানতা এমন কি নর্দ্দমার দ্রুত গতিপ্রবাহে আরোপিত হইবে, সে হাততালি দিয়া উঠিবেক, আঃ ঐ চানোয়া! ক্রমে ঐ ছবি তাহারই মধ্যে মরিয়া শুধু কম্পন হইবে কী?
আঃ কত বাস্তবতাই আমার রক্তে!
এখন ঐ বালিকা আর ঐ বালকের ছায়া সেই হাস্য-খর ভীড়কে শ্যামীকৃত করিয়াছিল; এবং মুরারীবাবু তদীয় (আমাদের মনগড়াই নহে) সব কিছু ঘোষণা করার মনোবৃত্তি হইতে অর্ধনিমীলিত চোখে হাস্যের প্রতি লক্ষ্যে আয়াস করিলেন।
এখন তাহার ঠাওর হইল, যে সিঁড়িতে, স্যর পি-র পরমা সুন্দরী নাতনি চতুর্দশী অলোকা! পিছনে জড়োয়া ক্যাপিটাল দেওয়া ফ্লটেড থাম–আর উপরে খিলানের রেখা; সামনে অলোকা; পাশেই তদীয় চমৎকার ‘সরাইল’ কুকুর (এরূপ নোবল কুকুর জাত খুব কমই) ও টর্চ হস্তে অলোকার পরিচারিকাবৃন্দ।
সে বেচারী অলোকা সদাই বিভীষিত, সর্প তাহার ভয়, উজর হাসনুহানা যাহার আতঙ্ক, স্ফূৰ্ত্তমান কামিনী গাছ দেখিলে যে নীল হইয়া যায়! ঐশ্বৰ্য্যময়ী অনলাকার মধ্যে তখনই চোরা-স্বেদ দেখা দেয়! তাহার অনামিকা যে নয় ক্যারেট হীরক খণ্ড ক্রমাগত ঐ সকল কিছুকে মহাস্পর্ধা শাসন করিতেছে, যে অলোকা চরাচরের দিকে চাহিয়া বলিতেছে, তোমরা আমাকে হে সৌরভিত বৃক্ষসকল, আর শঙ্কিত ভীত করিও না–তথাপি যে সেই অলোকাই ঐখানে থাকিয়া ঐ হাস্যে যোগ দিয়াছিল!
ঐ উদ্দীপনা এক শিশুকেন্দ্রিক।
অদূরে বিলি, যে এতাবৎ এক পেয়ারা গাছের একটি নমনীয় ডাল টানিতে থাকিয়া-ফলে তাহার দেহে আলোর হিলমিল আছে। নিজ জীবনযৌবনের উপাখ্যান কহিতে আছিল,–যে বহুতেই নিলর্জ হইয়াছে তাহার নিমিত্ত, এবং সে স্কুলে…যখন তখন টপসী (টমকাকার কুটির) ওরফে প্রমদা, যাহারে কাফ্রীর মত দেখিতে, যে তাহাদের ক্লাসে সর্বপ্রথম সাড়ী পরিতে বাধ্য হয়, যে তাহারে সে অনিমেষনয়নে দেখিত, প্রমদা রূপসী।
কিন্তু কি ভয়ঙ্কর তাহার ঠোঁট, গা কণ্টকিত হয়। এই বিবরণে শ্রোতারা ব্রীড়ায়ে চারিদিকের ঠিক লইয়াছে যে কেহ শুনিল কি! আরও আরও বিলি জ্ঞাপন করে, যে সে ইটুম্যান্ট বসের ডিভাইডারের কাঁটা দিয়া (তখনকার দিনে এমন লেখা খুব চলন ছিল) আপন হস্তে প্রমদার নামের আদ্যক্ষর ‘পি’ লিখিয়াছে, রক্ত পড়িয়াছে–ইহাতে যত কিছু ডাক বাবা-মা-ভাই ইত্যাদির স্বরভঙ্গ হইয়াছে–তবু সে মরিয়া!
ইতিমধ্যে ফ্রক পরা ও পুরুষ পোষাকে (যেহেতু তাহার মা ছেলে চাহে–হয় নাই বলিয়া তাহাকে পুরুষবেশী করে) একটি মেয়ের সান্নিধ্যে আসিতেই সে বলিয়াছে, অভাগীর স্বর্গ চমৎকার! কখনও ভগিনী নিবেদিতা, কভু পণ্ডিতানী রমাবাঈ, অতএব সে, বিলি, বহু প্রাচীন রীতির চতুর, বলিয়াছে, অজস্র শত চিঠি আমার নিকট জমিয়াছে…তাহা দিয়া আমি এলবামের মত(!) করিয়াছি…।
যে বিলি আবার আরম্ভিল যে একদা প্রমদার কুহকময়ী অগ্নি উদগার দেহ স্মরণে ‘এ কি এ কি!’ শব্দ উচ্চারিয়াছিল এবং যে তাহাতে ঘুম ছিল না! যে ইহা ভাবনা হইত তাহার নিজের দেহ যদি লীলা-র মত হয়, সত্যি যাহার বক্ষ সমতল ছিল! আমি রাতদিন ভগবানকে ডাকিতাম।
এ হেন যে বিলি সেও ঐ হাস্য খুসী উচ্ছাসে আকৃষ্ট হওয়ত-যে তখন বেচারী জানে নাই যে উহার কারণ কি, (আপন অনুগত) শিষ্যসমানদের লইয়া গ্রাভল পথে কর্কশ আওয়াজ তুলিয়া জলদিই এখানে, যেখানে মাধুৰ্য্য! এবং এই সময় এমন ঘটে–মনুশেফের স্ত্রী স্বীয় কন্যা অনুপমা–যে তাহার মায়ের অজস্র সঙ্কেত ইসারা দেখিয়াও দেখে নাই, যে বিলির সংস্পর্শ ত্যাগ করে না–পথ রোধ করিলেন।
অনুপমাকে কবলিত করিয়া তদীয় মাতা গোপনতা সৃষ্টি করত, উষ্মবর্ণ-প্রায় বাক্য উচ্চারণে তিরস্কার করিলেন,–রহ তোমার বাবাকে আমি বলিতেছি তুমি ওই ঢলানীর দুর্বিনীতার সহিত মাখামাখি। করিতেছ, উহার পদদ্বয়ের গড়ন বানরতুল্য! সে বিপথগামিনী, অনবরত মিথ্যাবাদিনী, বলে ডাইসেসন হইতে পাশ করিয়াছি, উহা মিথ্যা…কি এতেক তোমাদের কথা?
প্রথমে, এবম্প্রকার কটুবাক্যেও অনুপমার চোখ জোর হারায় নাই, যে সে বলিতে ইচ্ছুক যে বিলি খুব কালচারড, ফরওয়ার্ড! সে একা কলেজে যায়, সে আলোকপ্রাপ্তা!
অথচ এ সময় এবং তাহার কর্ণে বিলির শ্লেষ্ম-জড়িত স্বর ছিল, যথা প্রমদা বলিয়াছিল, বিবাহ না-হওয়া পর্যন্ত এ দেহ স্পর্শ করিতে দিবে না, বিবাহের পর যাহা খুসী যেখানে খুসী; এবং ইহা যে একদিন শিলা বৃষ্টিতে বিলির সারা অঙ্গে কিভাবে শিলা বাজিতেছিল!
এখন অনুপমার মৌনভঙ্গ হইল; তদীয় মাতাকে সে জানাইয়াছিল গত সরস্বতী পূজায় বিলির নিজেকে কি পর্য্যন্ত রমণীয় সুলক্ষণীয়া দেখিতে হইয়াছিল তাহারই কথা!