এতদপ্রবর্ত্তীত, সমীপবর্ত্তী মলিন চ্যাগড়া গাত্রে উন্মাদকে করজোড়ে এবং জানাইলেন, আপনি অনন্যসাধারণ, হে নরোত্তম আপনি ধন্য, আপনার নিঃসঙ্গতা ভাগবত কথিত, আপনি গোপনতা বহন করেন–গোপনতার গোপনতা! আপনকার বিচ্ছিন্নতা নজরে যে বালক নিজ অবস্থা সত্ত্বেও থ; যে, নির্ঘাত বুঝে সেও ক্রমশ গোপন হইয়া যাইতেছে, ক্ষণেক পাংশু হইয়াছে; কোনমতে সে সোজা ছিল, যদিও যে আপনার মুখে হাস্য ছিল তথাপি সে আপনাকে বেচারী বলিয়াছে, যে যেমন আপনিও হারাইয়া গিয়াছেন, হায় আপনি থানা পোস্ট অফিস ভুলিয়াছেন, মাঠে ঘাটে ষড়ঋতু খেলা আপনি ভুলিয়াছেন; বালক ইহা অবিদিত যে, মহা ব্যোম আপনকার বৈভব; এবং যে রোরুদ্যমান সেই রিখিয়ার ছেলেটি, আপনার দৃশ্যত-আধিভৌতিক দুঃখে বড়ই বিকল, যে আপনার কেহ নাই, এখন আপনার দিক বিচারও নাই; এরূপে সে নির্ভয়েই আপনাকে দেখিতে থাকে, হঠাৎ সে আতঙ্কিত হইল, সে ত্রিকূট পাহাড়ের দিকে চাহিল এবং স্থান ত্যাগ করে…তাহার বিষয়ে কিছু বলিবেন। আর যে সেই বদ্ধ উন্মাদের তর্জ্জনী সঙ্কেত আশায়ে ক্ষণকাল বিলম্ব করিলেন। সম্মুখের পাগলামী অন্তর্হিত হইল।
বেশ খানিক দূরের পথিপার্শ্বস্থিত উত্তম তিলক-সেবা মণ্ডিত গোখুর শিখাযুক্ত জনৈক গণৎকার দর্শনে মনিব মহাশয়ের ঔৎসুক্য উপজিল, তিনি নিকটে যাইলেন এ কারণ যে এই গণৎকার কিয়ৎ অভিনব পন্থীর, ইহার সমক্ষে বিচিত্র সাজ সরঞ্জাম, অক্ষ, চিত্র ইত্যাদি, নভোমণ্ডলে গ্রহনক্ষত্র পরিস্ফুট চিত্র, শনির পরমদ্ভুত সন্ত্রাসপ্রদ কুটিল শুধুমাত্র মুণ্ড অঙ্কিত, ও যন্ত্র সকলের ছক। যখন সুঘরাই এখানে সে ঐ গণৎকার ইনি এক বর্ষীয়সীর করকোষ্ঠি স্বাধ্যায়ে নিমগ্ন, চমকে তিনি খড়ি পাতিলেন, স্মিতহাস্যে ঊর্ধ্বে হস্তসঙ্কেতে মৌনভঙ্গ যেক্ষণে করিবেন, তৎকালেই–ইতিপূৰ্ব্ব হইতে যে অস্পষ্ট গোলমালের শব্দ হেথা হইতে শোনা যাইতে আছিল, তাহার বেশ দূরে এক জনসমাবেশ দেখা গেল, সামনের কয়েকজন ঈষৎ ধীরগতি, পশ্চাতে বিক্ষুব্ধ অনেকেই।
কাহাদের পুলিশ ধরিয়া আনিতে আছে; বাম পার্শ্বে এক রোগা লোক, তদীয় হস্তষ্কৃত সাঁড়াশী কজায়ে একটি মুচি (সোনাগলানর আধার), ইহার গর্ভ হইতে একটি স্বর্ণ সর্পের মস্তক উত্তোলিত ত্রিশূলের শীর্ষ, এগুলি মুচিতে খানিক গলিত পিণ্ডে আটকান; দক্ষিণে একজনা সুবেশী পিছনে একজন গামলা-উনুন, কেহ হাফর ইত্যাদি বহিতেছে, কিছু অন্তরে মত্তমাতঙ্গপ্রায় জনতা যাহাদের দন্ত বিকট প্রকটিত, বলিতেছিল,–শালাদের আমাদের হস্তে অর্পণ কর।
কেহ কেহ প্রস্তরহস্তে রোষামর্ষ চক্ষু ঘুরাইয়া কহিতেছিল,–আমরা ঐ শনৈশ্চর নরাধমদিগের রক্তে কপালে ফোঁটা কাটিয়া পুণ্য অর্জন করি, কি ভয়ঙ্কর ইহারা!
কেহ বলিতেছিল,–ইহারা কাহারা ইহারা গাছকে গাছ জলকে জল বলে কি, ইহাদের ঘুম কি পাতাল প্রবেশ করিয়াছে!
কেহ বলিল,–আমাদের হাত কাজে অতীব শক্ত কড়া পড়িয়াছে, হৃদয় বুক আমাদের বাবার কৃপায়ে এখনও ছাগল ছানা!
কেহ, এবম্বিধ হট্টগোলে আকৃষ্ট হওয়ত, এরূপ ব্যাপার সাক্ষাতে বিভীষিত,পাপ! পাপ! বলিতে থাকিয়া কান নাক মলিয়া একটি করজোড় মস্তকে ঠেকাইয়া, সত্ত্বর শিবগঙ্গায় স্নান উদ্দেশ্যে, পাপমোচন উদ্দেশ্যে গেল।
অসমাপ্ত স্নানার্থীরাও পুনরায় স্নানে যায়, সেই দৃশ্যে রমণীমণ্ডল চক্ষু আনত করে দ্বিচারিণী হইবার ত্রাসে! এই বিবিধ উদ্বেগের মধ্যে হঠাৎ এক প্রস্তরখণ্ড আসিয়া লাগিল সুবেশী লোকটির ললাটে; রক্ত কিঞ্চিৎ পুলিশের জামায় ও স্বর্ণকারের মুচিস্থ রূপগুলিতে! রমণীরা চোখ ফিরাইল; এ সময় শহরের এক ডাক্তারবাবুর পাল্কী-গাড়ী এই ঘটনার সন্নিকট হয়, তিনি গাড়ী হইতে নামিয়া–উৎক্ষিপ্ত জনতা যাহারা বাবা বৈদ্যনাথের জয়ধ্বনি দেয়, আর মার মার বলে–তাহাদের ভেদ করত যাইলেন, আশ্চৰ্য্য মুচিস্থ অবস্থা দর্শনে তিনি সত্বর সেই দিকে হস্তের গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগ খুলিতে ক্কচিৎ থমকাইয়া এবার সুবেশধারী লোকটির সাহায্যের নিমিত্ত প্রস্তুত।
সুঘরাই এ সকল কিছু দেখিতে থাকিয়া উৎচকিত, তাহার কণ্ঠের শিরাউপশিরা কোন এক চীৎকার নিমিত্ত স্ফীত, এখানে সেখানে দৃষ্টি সঞ্চালন করিল, মনিব মহাশয় হয়ত কাছেই কোথাও–এই অসম্ভাবিত ব্যাপারে মর্মাহত তিনি অবশ্যই–এই জনপ্রবাহ বেশ দূরে যায় যখন সুঘরাই ইহা বিবেচনা করে।
২. সুখ দুঃখ চক্রবৎ
গণৎকার তখন কহিতেছিলেন,–সুখ দুঃখ চক্রবৎ…দুঃখ যাইবেই, আবার দুঃখ তোমার গৰ্ব্ব হইবে, তুমি অপেক্ষা কর, তোমার স্বামীর এত দুশ্চিন্তার কোন কারণ দেখি না, পুত্রের পুনরায় বিবাহ অহেতুক, তোমাদের সলিতা আসিতেছে, তোমাদের কখনই অন্ধকারে ভ্রমণ করিতে হইবে না, পুত্রবধূ বীজ ধরিয়াছে…তোমাদের ধর্ম্মকর্ম যথেষ্ট দানধ্যান আছে…!
সুঘরাই নভোস্থলের প্রতি মন রাখিতে বাধ্য হয় কেননা গণৎকার ছোট একটি ছড়ি দ্বারা উর্ধের ঐ লোক দর্শাইয়া গ্রহর গতিবিধি উল্লেখ করিতেছিলেন, অতএব সে ইহাতে সেই ছবির নীল রঙকে স্পন্দিত অনুভব করিয়া রোমাঞ্চিত।
সুঘরাই, কল্পনা করিল–এখন মনিব মহাশয় এই গণকারকে শুধাইলেন,–মহাশয়, আপনি যখন এক মহিলার সংশয় দূর করা নিবন্ধন, ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান বলিতেছিলেন, ঠিক যখন পুলিশ কর্তৃক ধৃত সেই স্বর্ণকার ও সেই ধৰ্ম্ম-বৈপ্লবিক নেতাকে লইয়া যাওয়া হইতেছিল, তখনই আমি দূর হইতে দেখিলাম একটি বালক এখানে আপনার ক্রিয়াকলাপ দেখিতে উদগ্রীব, ক্ষণেকেই মহা হট্টগোল শ্রুত হয়, পথের সকলেই সেইদিকে মুখ ফিরায়, আমিও চাহিলাম, আমার আর ডাকা হইল না, পরক্ষণেই আমি আপনার সান্নিধ্যে ভীড় কাটাইয়া আসি, দেখি বালক নাই, একবার মনে হইল আমি কি ভুল দেখিলাম, না, তাহা নহে; তখনই ঐ ভীড়ের মধ্যে অনুসন্ধানক্রমে যাইলাম উচ্চৈঃস্বরে ডাকিলাম! সেই দুইজন ব্যক্তির কদর্য্য কাণ্ডে আমি সম্বিৎশূন্য, অনতিবিলম্বে ঐ সুন্দরগুলির পাষণ্ড পরিণতিতে আমি হতস্নায়ু, মুচিস্থ ভক্তি-নিদর্শনগুলি আমারে আঁচড়াইতেছিল, কেন না সেখানে প্রাণিপাত যোগভ্রষ্ট হইয়াছে, চেতনা রেখা-ছাড়া হওয়ত পিণ্ড, সঙ্গে সঙ্গে মদীয় খোঁজার প্রেরণা যুক্তি, আরোহীপ্রথা দারুভূত, কেন না ঐ দৃশ্য সর্বৈব সংজ্ঞা-বিঘাতক!