ইহারা দুইজনেই কিঞ্চিৎ ভয় ভয়, বৈজুনাথ যাহার পিছনে গঙ্গা, তাহার দিকে তাকাইলেন।
বৈজুনাথ ইঁহাদের অবস্থা দেখিয়া খানিক বিশ্বাস লাভ করিয়া পুনরায় আরম্ভ করিল, “কত কটা ডাগর সতীদাহ হল বল, লোকে শাঁখ বাজালে, উলু দিলে, আমার শ্বশুর বলত শশয়ে গেছে, আমি যেখন এ ঘাটকে জামাই হই এলাম–তারপর কত কটা গেল” বলিয়া গঙ্গা ছাড়িয়া উঠিয়া আসিয়া থমকাইয়া দাঁড়াইল। তাহার মুখ লজ্জায় অথবা দুঃখে নীচু হইয়াছিল; একটি গভীর নিঃশ্বাস লইয়া, ঝটিতি মুখটি ঘুরাইয়া আঙুল দিয়া পশ্চাতের প্রবাহিণী গঙ্গাকে নির্দ্দেশ করত পুনরায় কহিল, “তাই বুঝি গঙ্গা, চোখের জলকে লোনা হল–কে জানে? বল ঠাকুর তোমরা পাঁচজন।” এরূপ কথা গল্প যখনই সে সুযোগ পাইয়াছে তখনই, হয় শবযাত্রীদের জাগাইয়া রাখিবার জন্য, নয় কেবলমাত্র অবসর বিনোদনের জন্য বলিয়াছে। হায়, শ্মশানেরও সুদীর্ঘ গল্প আছে। তথাপি এখন–তাহার কণ্ঠস্বরে এ কথা স্পষ্টতর হইল যে পৃথিবী বড় অন্ধকার আচ্ছন্ন, এ কারণে যে, তাহার বেদনায় নিয়মের প্রতি ক্ষোভ ছিল।
এ ক্ষোভ, নিমজ্জমান ব্যক্তির শূন্যতা আকর্ষণ উদ্যত হাতের মতই জ্যোতিষীর চোখে প্রতিভাত হয়, ফলে ভীত জ্যোতিষী আপনার শরীরকে মৃদু আন্দোলিত করিয়া কহিলেন, “থাম্ থাম্ বেটা চাঁড়াল, সে ঘাট কেন গেল, সে কথায় তোর কি দরকার।” একথা জ্যোতিষী শুধুমাত্র নিজেকে সহজ করিবার জন্যই আপনাকে আড়াল করিবার হেতু বলিয়াছিলেন, যেহেতু বৈজুনাথের বাক্যে ক্ষণিকের জন্য আপনার মোহ অহঙ্কার বিগত হয়, সেই হেতু সহসা এই সৃষ্টির রেখা সমূহ যাহা কখন ফুলে কভু ফলে, প্রায়ই শিশু আলিঙ্গনের বিচিত্র ভঙ্গিমায় প্রতিভাত–তাহা সকল বুদ্ধি হারাইয়া স্মৃতিকে ভ্রংশ করত অসংলগ্ন এলোমেলো হইয়া, অবশেষে–তাঁহার দৃষ্টির সম্মুখে অনাদি অনন্ত হইয়া দেখা দিয়াছিল। কিন্তু তিনি অতীব চতুর, পলকেই বেলাতটের অঙ্কে মনসংযোগ করিলেন।
“আঃ…রে” বলিয়া বৈজু জ্যোতিষীর কথা কয়টিকে যুত করত কহিল, “হায় কপাল, ছি ছি ছি গো আচাজ্জি” বলিয়া কেমন যেমন খুব সহজ নৃত্যের পদবিক্ষেপ একটু এদিক সেদিকে করিয়া পুনৰ্ব্বার কহিল, “সুতাহাট-থানার বাপ-মা তুমি মোড়ল, আমরা আবার কথা কইব কোন মুখে গো, ছোট জাত মোরাবল? আমরা গল্প বললাম হে। আমরা গল্প বলি। বুড়া ঠায় শুই আছে আর মড়াবসার গন্ধ, তাই বললাম হে…” বলিয়াই আপনার ভঙ্গিমায় বেলাতটের অঙ্ককে ভয়ার্ত করিল।
“থাক থাক, চুপ কর বেটা” লক্ষ্মীনারায়ণ বলিলেন, কেন না তিনি আশায় উত্তেজনায় অসহিষ্ণু হইয়াছিলেন, অবাধ্য অনন্তহরির অঙ্কের ফলাফলের প্রতি তাঁহার মন ছিল না।
তাঁহার ভর্ৎসনার সঙ্গে সঙ্গেই বৈজুনাথ উত্তর করিল, “আহা, নিজেকে রাগাইছ কেনে? বলি রাগ চাঁড়াল’?” বলিয়া কিশোরীসদৃশ হাসি হাসিল–তাহার বক্রোক্তি শুনিয়া অন্য দুইজন কিছুই করিতে পারিলেন না। বৈজুনাথ আবার সূত্র ধরিল, “আমার কথা মান কিন্তুক, শালা। এই ঘাট ভারী খানকী খচ্চর ঘাট! পঞ্চমুণ্ডী ছিলেন সে-ঠেন, মা গঙ্গার কাছে চালাকি, মাই বটে কোম্পানী, ডুবে গেল শালা পঞ্চমুণ্ডী”–এইটুকু বাক্যের মধ্যে সে উচ্ছ্বাসে স্ফীত বলীয়ান হইয়া উঠিয়াছিল, তবু এখন একটি নিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া অসহায়ভাবে–যে অসহায়তার মধ্যে গোধূলিলগ্নের অস্পষ্টতা, দূরাগত শঙ্খধ্বনির মায়া, বৎসহারা গাভীর আর্নরবের রেশ ছিল অথচ আর এক স্বরে বলিল, “জল যখন নেমে যায়, তখন কখনও কখনও সেই পাঁজা-মুণ্ডী গাঁথা পাঁজা দেখা দেয়, বলে কি জানো? বলে, ‘হেরে বেটা, ভাল করে চিতা সাজাস, আমার হাঁড়ি চড়বেক…’আমি শালা ডর করি না…দু শালা! মা আমার কোম্পানী, আমার আবার ডর কিসের…ভাবি দি শালা এক কুড়ল মেরে…শালা বলে কি না আমি তোকে শান্তি দেব, হা! শান্তি! ভাবি…থাক শালা চোখের জলের লোনা জলে ডুবে…এ ঘাটে বুড়োক না। শোয়ালেই পারতে গো।” এ কথা বলিতে বলিতে বৃদ্ধ সীতারামের মুখোনি তাহার মানসপটে ভাসিয়া উঠে। বৈজুনাথ নিশ্চয় শব সহ্য করিতে পারে কিন্তু মৃত্যু! আঃ পুনরায় ইহা একটি সুবৃহৎ গ্রন্থ–যাহাতে ফুলসকল লবণাক্ত, যাহাতে বিদ্যুৎ-দীপ্ত সবুজতার বিফলতার কথা, যাহা বৃত্তাকার ভ্রমণের অবশ্যম্ভাবী পরিপ্রেক্ষিত, যাহা দৃশ্যত নাই–তাহারই সূচনা করে। একারণে চাঁড়াল বৈজুনাথ কোনক্রমেই মৃত্যুকে সহ্য করিতে অক্ষম, কারণ তাহার আপনকার পূর্ণতা আর যে সেই হেতু সে বৃদ্ধকে এখনও পর্যন্ত ভাল। করিয়া দেখিতেও যায় নাই।
“জয় জয় মা…তারা ব্রহ্মময়ী গো” বলিয়া জ্যোতিষী উল্লাসে যেন বিদীর্ণ হইয়া গেলেন, হস্তস্থিত হুঁকা বেসামাল হয় এবং সত্বর উঠিয়া এক দৌড়ে, না লম্ফে, লক্ষ্মীনারায়ণের নিকটে প্রায় আসিয়া স্থির হইয়া বেলাতটের আঁকাজোকার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করিলেন, এসময় তাঁহার গভীর নিঃশ্বাস পড়িতেছিল, তাঁহার আপনার ছায়া অঙ্কের উপর বিস্তৃত, সে ছায়াকে অনভিজ্ঞ বালকের মত সরাইবার বৃথা চেষ্টা করিয়া এবার অন্য দিকে গিয়া তাঁহার মনঃ সংযুক্ত হইল। সীতারামের জীবন যে এইভাবে সংখ্যায় থাকিবে কে জানিত! সংখ্যার পিছনে আমি আছে, অহঙ্কার আছে, নিঃশ্বাসও বৰ্ত্তমান। বৈজুনাথ তাঁহার নিকটে আসিয়াছিল, অন্যত্রে লক্ষ্মীনারায়ণ খানিকটা উঠিয়া পুনরায় ধীরে ধীরে বসিয়া পড়িলেন। জ্যোতিষী আপনার হাতের কাঠি দিয়া কি যেন ঠিক দিবার পরে ক্রমে পিছু হটিতে হটিতে যেখানে আঁকজোক সমাপ্ত হইয়াছে, সেখানে কয়েক মুহূর্ত অতিবাহিত করিয়া কোন সত্য দুর্ধর্ষ অনিবাৰ্য্যতা ঘোষণা করিবার মানসে এখন তাহার দুইহাত খানিক উত্তোলিত হইল, এ সময় আপনকার ওষ্ঠদ্বয় খানিক খুলিয়া নিবিষ্ট মনে নিম্নে লক্ষ্য করিলেন।