“তাই বলে…?” লোকটি বলিয়াছিল।
ইহাতে সত্যই তাহাকে পীড়া দিয়াছিল। সে নিশ্চয়ই দুঃখী, ক্ষণেকেই ইতস্ততোর মধ্যে আপনাকে দেখিতে পায়; বুঝিল পৃথিবীটা তাহার আপন নয়, আপনার নহে; এ কথায় সে যেমত বা ঈষৎ স্ফীত, সে কারণে তাহার অধিকারের চারিদিকে পলকে, ঝটিতি, আপনাকে সামলাইয়া ভ্রুকুটি সহকারে তাকাইয়া একটি নিঃশ্বাস গ্রহণ করিল, এখানে সকালের গাঙ্গেয় শৈত্যে দ্রবীভূত বাতাস আপনকার চরিত্র, নিঃশ্বাসের কারণে হারাইল না–অন্তরীক্ষে হানা দিয়া ফিরিল। হায়, তাহার কোন দেবতা নাই, যে তাহার সহিত শুইয়া শুইয়া প্রীতিপদ, সুন্দর, সবুজতার, সন্ধ্যার, নক্ষত্রনিচয়ের, তীরদর্শনের, পক্ষিকুলের অবিমৃষ্যকারিতার, মিনতির, রাখালের গল্প সুর সংযোগে সূক্ষ্মতম নিঃশ্বাসের আওয়াজ করিয়া যাইবে। হায় সে বড় একা! বৈজুনাথ কয়লায় কালো তর্জ্জনীটা তুলিয়া উত্তর করিল, “বাবু বলি এক কথা, আচাজ্জিরা (আচাৰ্যরা) সতীদাহে যখন হাঁক তুলে, এয়োরা তোমরা সোনা দাও, স্বগ্যে সোনা ছাড়া কিছুই যায় না, স্বগ্যে যায় না–তা পরে চিতা লিভিয়ে সোনা তুলে তখন…” বলিয়াই বাঁচাল বৈজুনাথ দ্রুতপদে সে-স্থান পরিত্যাগ করিল।
সে এত দ্রুত গতিতে আসিয়াছিল যে আর একটু হইলেই অনন্তহরির অঙ্কের উপর পা পড়িত। লক্ষ্মীনারায়ণের হুমকিতে সে কোনরূপে আপনাকে সামলাইয়া কহিল, “ই গো ঠাকুর, পুণ্যাত্মা বুড়ার দশা কি গো?”
লক্ষ্মীনারায়ণ বলিয়া উঠিল, “হে বেটা চাঁড়াল, তুই বড় জ্বালাস দেখছি…যা বেটা…”
কাঠকয়লালিপ্ত হইলেও মুখোনিতে বোকা অপ্রস্তুতের ভাব লক্ষিত হইল। কাহারও গোণা কয়েকটি নিঃশ্বাসের পথ সে যেমত বা ভুলক্রমে রোধ করিয়া দাঁড়াইয়াছিল।
এমত সময় অনন্তহরি কহিল, “আর একটু বাঁকি ওকে বল…”
লক্ষ্মীনারায়ণ ভয়মিশ্রিত চোখে ভিখারীর মত কিয়ৎক্ষণ জ্যোতিষীর দিকে চাহিয়া থাকিয়া, আর খানিক বৈজুর দিকে চাহিয়া বলিলেন, “আর একটু বাঁকি।”
লক্ষ্মীনারায়ণ আকাশের দিব্যভাবের দিকে চাহিলেন। তাঁহার দেহ যেন গীতার উক্তি, অথবা পুরাণে লিখিত। গ্রহনক্ষত্রের সাক্ষাৎ নাই, তবু সৌরজগতের ভার তাঁহাকে দিকভ্রান্ত করিয়া দিল, রহস্যময় পরিক্রমণ বহুদূর হইতে নামিয়া আসিয়া তাঁহাকে কেন্দ্র করিয়া ইদানীং আবেগ সঞ্চারী; আপনার বদ্ধতাকে লইয়া কে মহা উল্লাসে খেলা আরম্ভ করে; ফলে আপনার ভার অনুমান ও উপলব্ধি করার মধ্যে যে ত্রাসের সঞ্চার অতীব সাধারণ, তাহা তাঁহার হইয়াছিল। এই উপলব্ধি হইতে পরিত্রাণ পাইবার নিমিত্ত কোন এক সূত্রে হঠাৎ তিনি বলিয়া ফেলিলেন, “আ মর, তু বেটা জাত জন্ম খোয়াবি? সরে দাঁড়া না মরণ!”–ইহা বলিতে লক্ষ্মীনারায়ণ রাগতভাবে স্ত্রীলোকের মত ঢং করিলেন, তাঁহার ব্যবহার অনেকাংশে ভাঁড়ের মতই।
বৈজুনাথ তাঁহার বাক্যে থতমত তূপীকৃত, কেন না বিচারের আঁচড় ইকড়ি ছাড়িয়া বেশ কিছুটা দুরে সে দাঁড়াইয়াছিল, এবং পরে, অতর্কিত কিছুটা দূরে পুনরায় সরিয়া গিয়া বলিল, “বিধান বল?…কাঁহাতক বুড়া মানুষটা হিম খাবে গো, আর মড়াবসার, মড়া পুড়ার গন্ধ শুকবে…বড় পুণ্যাত্মা গো.শুকনা ডালে পাখী দুটো বড় হিমসিম খায়।” বুড়া অর্থে গঙ্গাতীরে আনীত সীতারামকে উদ্দেশ্য করিয়াই, বৈজু এ সকল কথা বলিয়াছিল। তাহার এহেন সরল শেষ উক্তিতে পুরাতন মধুর পত্রের মায়া ছিল; সময় যেখানে শেফালি, সময় যেখানে অল্পবয়সী, সময় যেখানে হস্তীশাবকের ন্যায়…দর্শনের উপমা নহে– সত্যই পদ্মবনে জলকেলী করিতেছে। বৈজু একথা বলে নাই, সে আবৃত্তি করিয়াছিল, রমণীর বস্ত্রাঞ্চল যে বিশেষ মনোভাব প্রকাশের বাক্যরূপ, সেই গভীরতার, বাস্তবতার অনুভবের আস্থার হৃদয়াবেগের আদ্য অক্ষর এখানেও অস্থির, কেননা এই সূত্রে সূক্ষ্ম রেখার তথা সনাতন সৌন্দর্য্যের শুভ্র মাধুর্যের আখ্যানের ইঙ্গিত, প্রাকৃতজনের মঙ্গলজনক ইঙ্গিত সে করিয়াছিল। আঃ সে এক অপূর্ব আখ্যান! তাহা আদি-অন্তহীন উষ্ণতাকে কাব্যময় এবং উপত্যকা হইতে উপত্যকা অন্তরে তাহাকে বহন না করিয়া, যেখানে সুউচ্চ গৈরিক স্বর্ণাভ শীর্ষযুক্ত পৰ্ব্বতের ছায়া চলমান স্রোতধারার উপর বিস্তৃত, তাহারই তীরে স্থিত করত উপলব্ধি করে। লক্ষ্মীনারায়ণের ইহা ভাল লাগে নাই, তখনও তিনি আপনার দেহস্থিত অন্ধকারে ছুটাছুটি করিতেছিলেন। তিনি বিরক্তি সহকারে কিছু বলিবার পূর্বেই জ্যোতিষীর কথা শোনা গেল।
“ভবিতব্য…ভাগ্য” বলিয়া জ্যোতিষী অনন্তহরি হাতের কাঠি তুলিয়া, প্রাচীন একটি হাসি হাসিলেন–কিছুদূর পর্যন্ত পথ অনুধাবন করার এ হাস্য, এ হাস্যের বাস কোথায় কে জানে, তবে একথা আমরা জানি, এ হাস্য রাত্রের অন্ধকার দিয়া তন্তু প্রস্তুত করে, এবং যাহা নিষ্ঠুর হইলেও অমোঘ। এ হাসিকে কোন হাতই বুঝিয়া লইতে তথা প্রকাশ করিতে অদ্যও পারে নাই। কহিলেন, “ওরে চাঁড়াল, শিবের কলম মানবে না? কি! চন্দ্র সূৰ্য্য সব কিছুকে আক্কেল দিয়েছে রে,…তা ছাড়া তুই জানি না এ বড় পুণ্যের ঘাট, পঞ্চমুণ্ডীর ঘাট। এখানে বুডোর বাপ-ঠাকুরদা সব গঙ্গা পেয়েছে, তাই সে…”
পঞ্চমুণ্ডীর নাম শ্রবণ মাত্র বৈজুনাথের ঈষৎ রোমহর্ষ হয়। এ দেহের পৃষ্ঠদেশ সত্যই কি কিছু পূৰ্ব্বে লাল হইয়াছিল, যে চন্দ্র সূৰ্য্যকে সাক্ষ্য করিয়া অনেকবার আপনার বজ্রমুষ্টি দেখাইয়াছে, পৃথিবীতে সে সহজেই অযাচিতাবলম্বী হইয়া, কৌতুক পরতন্ত্র হইয়া অন্ধকারকে আপনার খেলার সঙ্গী হিসাবে আমন্ত্রণ করিয়াছে–সে এখন একীভূত; তাহারও সংস্কার ছিল, যুক্তি যেখানে কুসুমাদপি কোমল, অবশ। পঞ্চমুণ্ডী নামে সে চোখ দুইটি বড় করিয়া যেন বিপদ গণিল, ইহার পর জ্যোতিষীর পাশ দিয়া গঙ্গায় মুখ প্রক্ষালন করিতে করিতে আপন মনে কহিল, “পুণ্য না শালা হাতী”–তাহার পর হঠাৎ সে জ্যোতিষীকে উদ্দেশ্য করিয়া কহিল, “অত পুণ্যের ঘাট ত গঙ্গা খেলে কেনে গো” বলিয়া নিজের বিদ্রুপে নিজেই হাসিয়া উঠিল, এবং কেহ উত্তর করিল না দেখিয়া নিজেই উত্তর করিল, “গঙ্গা খেলে। কেনে, বলব? সে ঘাটকে গঙ্গা থাকতে দিবে কেনে, কত কটা মানুষ জলজ্যান্ত ধাঁই ধাঁই পুড়ল বল”–এই উত্তর, তাহার আচারের প্রতি যাহাদের কোন বিশ্বাস নাই, তাহাদেরই যেন বা ঘোর। অভিমানে বলিয়াছিল।