.
সকলেই চলমান বৈজুনাথকে লক্ষ্য করিল, তাহার কোথায় যেন রঙের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস আছে–সে নিঃশ্বাস নেয়, না নিঃশ্বাস তাহাকেই নেয়–এ প্রশ্ন তাহাদের মনে উদয় হয়।
ইদানীং গঙ্গা, হাস্যময়ী, বহু বহুদূরে বজ্রমুষ্টি রক্তিম, বায়ুচিহ্ন–কোদাল কোপান যেমত ঢেউয়ে ঢেউয়ে ফুলমৃদু জাম রঙ। ক্রমাগতই জলজ পানা ভাসিয়া যাইতেছে, নিম্ন আকাশে ডানার হিলমিল, শূন্যতাকে অপহরণ করিতে আপনার সত্তা হারাইতেছে।
বৈজুনাথ গঙ্গার কিনারে দাঁড়াইয়া পৃথিবীর প্রত্যহের সূক্ষ্মতা দেখিল, বিস্মিত হইল, বার বার ডাকিল, “মা মা, মা গো।” তাহার কণ্ঠস্বরে শিশুহস্তের ছবি মুদ্রিত ছিল। ইহার পর শ্রদ্ধাভরে পুনৰ্ব্বার আপনার মস্তকে গঙ্গোদক লইয়া ছিটাইবার কালে মাতৃনাম উচ্চারণ করিল। মুখ ধুইল এবং এই সময়ে ঘাড় ফিরাইয়া কহিল, “ঠাকুর, বুড়ো কৰ্ত্তার কি দশা গো, গোণ ত পার করলেক, হে হে।”
যেহেতু এখন ফরসা হইয়াছে, ফলে এখন অক্ষর চিনা যায়, সংখ্যা স্বাভাবিক হয়। লক্ষ্মীনারায়ণ জ্যোতিষী অনন্তহরির সম্মুখে লম্বমান কোষ্ঠীপত্ৰ খুলিয়া ধরিয়া আছেন, কোষ্ঠী যেমত আয়না। জ্যোতিষী অন্যমনে বিচার করিয়া, কিছু পরে একটি কাঠি দিয়া নরম বেলাতটে কি লিখিতে লিখিতে অনেকখানি দূরে সরিয়া গিয়াছিলেন। এখন বৈজুনাথের প্রশ্নে একবার ফিরিয়া তাকাইলেন মাত্র, পরক্ষণেই লক্ষ্মীনারায়ণের দিকে চাহিয়া অন্যমনস্ক হইয়া হতবাক হইয়া রহিলেন।
লক্ষ্মীনারায়ণ তাঁহার বিচারের ফলাফল শুনিবার আশায় উদগ্রীব হইয়াছিলেন; এক্ষণে জ্যোতিষীকে এইভাবে তাকাইয়া থাকিতে দেখিয়া, যারপরনাই অস্বস্তি বোধ করত সহজ হইবার ভঙ্গী করিলেন। ইহাতে তাঁহার, লক্ষ্মীনারায়ণের, দেহ যেন বিকলাঙ্গ হইল। একদা তিনি গঙ্গার দিকে, যেখানে অন্যমনা হইবার অব্যর্থ সুযোগ স্রোতরূপে বৰ্ত্তমান, অন্যবার পরিক্রমণকারী, বৃত্তাকারে ক্রমাগতই, ভ্রাম্যমাণ কৃষ্ণকায় কীৰ্ত্তনের দলকে দেখিলেন। লক্ষ্মীনারায়ণকে দেখিলে সত্যই মায়া হয়, কালের প্রতি চোখমুখে কোথাও সম্মানের লেশমাত্র উল্লেখ নাই। কাহাদের জিহ্বার আস্বাদনের, তৃপ্তির শব্দ—চক্চক্ শব্দ তিনি বাতাসে বাতাসে শুনিতে পান। এই শব্দ তাঁহাকে একীভূত করে। অতিকায় হিম জলজ দুর্ভাবনায় তিনি মূর্খ। এখন, কোনক্রমে আপনার একটি পা, মাটি হইতে উঠাইয়া, বাঁকাইয়া, ছড়াইয়া, পক্ষীরা যেমত করে, কিছুটা অবশতা দুর করত পুনরায় জ্যোতিষীর প্রতি কহিলেন, “বৈজু চাঁড়াল বেটা কি বলছে গো” বলিয়া আপনার মুখ দিয়া বৈজুকে নির্দ্দেশ করিলেন, নিজের মনোভাব যাহাতে প্রচ্ছন্ন থাকে সে কারণে তিনি একথা ঈষৎ হেনস্থা সহকারেই বলিয়াছিলেন। তথাপি তাঁহার বাক্যসকল কিছু পরিমাণ আর্দ্র।
জ্যোতিষী অনন্তহরির স্থির মুখোনি কঠিন হইয়া উঠিল, কহিলেন, “আঃ, চুপ কর ত।” ইহার মুখমণ্ডলের কঠিনতা যেন অগ্রবর্ত্তী অন্ধকারকে চাপিয়া ধরিল।
লক্ষ্মীনারায়ণ ইহার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, তাঁহার দেহে এই বিরক্ত-উক্তি পাথরের মত আঘাত করে। ফলে মাথাটি নড়িয়া উঠিল। তিনি একটি শতছিদ্র সম্রম দিয়া নিজেকে ঢাকিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন এবং এখন সত্যই, মাত্র এখনই তাঁহার গাত্র সকালের শুদ্ধ শীতল হাওয়া স্পর্শ করিল।
বৈজুনাথ একদা স্রোত, অন্যপক্ষে শ্মশানভূমি দেখিয়াছিল। সে গঙ্গা হইতে উঠিয়া, নিৰ্বাপিত চিতা অভিমুখে গিয়া তত্রস্থ গহুর হইতে একটি কাঠকয়লা তুলিয়া লইতে তাহার দেহ অসম্ভব বাঁকিয়াচুরিয়া গিয়াছে, এখন ছাই কালোর উপরে দেখা যায় ভূমিস্পর্শরোদে তাহার পিঠ লাল, সে একটি অনিবাৰ্য্যরূপে প্রতীয়মান হইল; মুহূর্তের মধ্যেই একটি কাঠকয়লা বাছিয়া দাঁত মাজিতে মাজিতে বালকটির প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল; বালকের চোখে জল আছে তাহা সত্ত্বেও, তাহার, বৈজুনাথের, রীতিনীতি দেখিয়া বিস্ময়ও বর্তমান এবং বালকের সঙ্গীদল এরূপ কাৰ্যে বিশেষ আশ্চর্যান্বিত হইয়া মুখ বিকৃত করিয়াছিল, নিশ্চয়ই তাহাদের মনে হয়, যে সে মানুষের ভীতিজনিত শ্রদ্ধাকে অবমানিত এবং ভালমন্দের সাধারণ রৌদ্রবহুল বিচারকে নষ্ট করিতেছে। ইহারা যেন বলিতে চাহে, এ কি কর গো?
বৈজুনাথ হৃদ্বয় কুঁচকাইয়া তাহাদের বিস্ময়কে সকালের প্রথম সূর্যে শুকাইয়া লইল, কহিল, “কি, আমার গতিক দেখে বেজার নাকি!”
সম্মুখের লোকটি এখনও গভীরভাবে তাহার প্রতি চাহিয়া আছে, অন্যান্য সকলে বিদ্রুপের স্মিতহাস্য রেখা আপন আপন শুষ্ক ওষ্ঠে মিলাইয়া, গম্ভীর। কেননা বৈজু এখনও ছায়া, কেননা বৈজু এখনও ব্যতিক্রম, কেননা বৈজু এখনও স্বেচ্ছাচারিতার বেদনাদায়ক নাম।
বৈজু অল্প আয়াসেই অনাদৃত দেহভঙ্গিমায় ইতোমধ্যের কবিপ্রসিদ্ধ সেই মোহকে চূর্ণ করিয়া না দিয়া সহজ কণ্ঠে কহিল, কেননা সে রঞ্জিত স্তব্ধতার সহিত অমোঘ শুন্যতার, শূন্যতা বোধের পার্থক্য, পার্থক্যের মধ্যে যে যুক্তিপূর্ণ স্বাভাবিকতা তাহা সে অবলীলাক্রমেই বুঝিত। বলিল, “কেইবা বেজার গো, এ আগা দেখে তুমিও সন্ন্যাসী হও না, আমি ত বেজার নই, মনে পড়ে বকাধাম্মিকের পালা? তুমিও আবার নাচতে নাচতে লাঙল ধরবে, ছেলে দুখালে, বউকে বলবে, মাই দে না কেনে? হা হা তুমি বলবে, ‘হারে এত ডালপালা, দাঁত মাজতে একোটা ভাঙলে পাত্তিস রে’ কিন্তু ঘাটকে মড়া থাকলে ছেড়ে যাবার হুকুম নাই গো।”–এ কথার মধ্যে স্পষ্টত দেখা গেল, সে রক্তে না হৃদয়ে অথবা স্মৃতিতে, কোথাও না কোথাও স্থির হইয়াছে।