বয়সী সঙ্গীরা তাহাকে, এমত মনে হয়, যেন বা দাঁত দিয়া টানিয়া ধরিয়া আছে। সুতরাং সান্ত্বনা দিবার ভাষা থাকিলেও উপায় ছিল না। সকলেরই জিহ্বা কটু কোন স্বাদে লিপ্ত, মুখ বিকৃত। তথাপি শুধুমাত্র একজনা কহিল, “ছিঃ পাগল” একথা সংস্কারবশতঃই সে বলে।
এই ছোট মন্তব্যটি বালকের সম্বিৎ ফিরাইয়া দিল; চিন্তাপ্রসূত, উখিত ধূম্রজালের দিকে তাকাইয়া, অন্যেরা ভীতভাবে মাথা নাড়িল। বৈজু বালকের দিকে ব্যাকুলভাবে চাহিয়া ধীরে ধীরে বলিল, “হা রে ননু, খোঁকা গো, মন তোমার পুঁড়ে” এবং পরক্ষণেই অতিশয় কোমল কণ্ঠে উচ্চারণ করিল, “দেহ চিতায় মন পুঁড়ে গো” এ কথার আবৃত্তির রীতিতে মনে হইল, সে কোন এক গীতের প্রথম কলি উদ্ধৃত করিল।
সমবেত জনমণ্ডলী, অল্পক্ষণের জন্য ক্ষিতিতত্ত্বের অনিত্যতা হইতে মন ফিরাইয়া তাহার দিকে আগ্রহভরে দেখিতে লাগিল। ইহাদের সকলেরই আশা, সে কিছু বলুক, কেননা তাহাদের তালু শুকাইয়াছে, কেননা মনে নানাবিধ হাড় স্তূপীকৃত হইয়াছে, কেননা তাহারা অলৌকিক পথশ্রমে ক্লান্ত।
বৈজু পুনৰ্ব্বার বলিল, “কেঁদোনি খোঁকা, একটি গল্প শুন–যে দিলে সেই নিলে, তুমাকে ভাল’র মধ্যে লোভী করে দিলে, কি করবে হে”–তাহার গলার স্বরে সহজ ঠিকানা ছিল, ফলে বালক ডুকরাইয়া কাঁদিয়া ক্ষণিক জিহ্বা দ্বারা ওষ্ঠ বুলাইয়া, একহাতে চোখ কচলাইতে কচলাইতে আপনার পিতার দেহের দিকে চাহিয়াছিল। এবং ক্ষণেক পরেই বৈজুনাথের বিষাদক্লিষ্ট স্মিতহাস্যময় মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল।
অন্যপক্ষে বৈজু আপনার কণ্ঠকে ঈষৎ সরস করিবার মানসে একটি ঢোক গিলিয়া নিতান্ত মেটে হইবার চেষ্টা করে। কিন্তু বালকের লাল চক্ষুদ্বয়–যেখানে কোন ভোর নাই, তাহাকে বিভক্ত করিয়া দিয়াছে। সে বিমূঢ়, কোনরূপে আপনার লাঠিখানি তুলিয়া লইয়া মুখোনি নীচু করিল, হস্তধৃত লাঠিখানি সে মৃদু মৃদু মাটিতে ঠুকিতেছিল। একবার কি এক কথা বলিতে গিয়া মুখ তুলিয়াই তৎক্ষণাৎ নামাইয়া অতি ধীরে বলিল, “কেঁদনি গো, খোঁকা গো” এই কথার পর একটি বিদেশী নিঃশ্বাসের শব্দ পাওয়া গেল, এবং তদনন্তর আপনার রোমশ বক্ষে হাত বুলাইতে বুলাইতে সে কহিল, “ওগো বাবু ইঠাঁই একো জীব আছে হে, ধুক ধুক ধুক ধুক করে, আমার যেটা সেটা লোহার” ইহার পর আকাশের দিকে চাহিয়া বলিল, “লোহারই বা কেনে, দধীচির অস্তি দিই গড়া, পালোয়ান পালোয়ান বাজ দিই গড়া, গড়া হঁই গেল? আকন্দ ফুল এমন কি, আমি দেখলে চিনতে লারবো, টুকুন ভাত গরাসে মনে লেয় আকাশ খাইছি। তবু তোমার চোখের জলের ভূতে আমাকে পেল।…হারে বাবু মানুষ, দেখনা কেনে গ্রামে গাঁয়কে হলুদ নিশান দিইছে, ভারী গরম (কলেরা) হ’লতার উপর বলে কার্তিক মাস যমের দক্ষিণ দুয়ার খোলা, কত থানা মুলুক ঠেন মড়া এল, এই দেখনা কেনে দড়িতে গিটদি…” বলিয়া কোমরের দড়ি দেখাইয়া পুনরায় কহিল, “সব শালা গরমের দেনাদার প্রজাখাতক, কত যে অনাথ হইল তা পাইমাপে আসে না খোঁকা, তাদের দেখলে আর কানতিসনা গো…উই যে শালা উপরে, যে শালা সবার ভিতরে, তার কলম মানতে হবেক…সে বড় কঠিন প্রাণ গো, কোন বোধ নাই, কান নাই, হাত নাই…বিকার নাই–এতবড় সংসারটা…চালায় হে.আইগো কথা শুনছো তোমরা…মড়ার হাত যে…মাটি ছুঁতে চায়, মাটি হা হা মাংটি…”
এইদৃশ্যে তাহারা সকলে যারপরনাই তটস্থ হয়; কিন্তু দক্ষতা এবং দূরত্ব বিচার তখনও পরিচ্ছন্নভাবে আসে নাই, তখনও তাহারা ললাটে করাঘাত-সুখে অলস। ফলে বৈজুর সাবধান বাণী কাজে দেয় নাই।
“হে হে গো, বাবু গো, হাতকে ঠেকা দাও ঠেকা দাও, না হলে জীবন বড় লষ্ট করবেক হে” এ কথার পর খানিক দ্রুত অগ্রসর হইয়া অঙ্গুলী নির্দ্দেশ করিয়া বৈজুনাথ বলিয়াছিল।
হাতটিকে তুলিবার জন্য, একজন একটি বাঁশ দিয়া তুলিয়া ধরিবার চেষ্টা করিল, মৃত সাপের মত শ্লথ এ হস্ত-সৌহার্দ্য অভিমানী, এ হাতখানি ব্যগ্রতার স্থির নশ্বর রূপ! ইদানীং পুনৰ্ব্বার অগ্নিতে সে মনোরমত্ব ঠেলিয়া দেওয়া হয়, লাখ প্রবাদবচন এবং দিগদর্শন পুড়িয়া পুড়িয়া ছাই হইবে।
বালক এ হেন দৃশ্য যে সহিতে পারে নাই, তাহা বৈজুনাথের চোখ এড়াইল না। বালক দৃঢ় করিয়া আপনকার নয়নযুগল মুদ্রিত করিল, আপনকার মুষ্টির মধ্যে কাহার মুষ্টি প্রবলভাবে ধরিতে চেষ্টা করিতেছিল। তাহার দেহ প্রদীপের শিখাবৎ।
বালকের স্বভাব বৈজুনাথকে আমোদের সন্ধান দিল। সে হাসিয়া উঠিল–আর অন্ধকার নাই, ব্যাঘ্র দীন হয়। সে কহিল, “লাও গো মানুষ বাবু, ভয়ে না ভালবাসায় চোখ বুজলে, এমন যেন শত্রুর না হয় বলে সবাই শুরু করে, অথচক এমনি হয়।”
আর আর সকলেই তাহার ইত্যাকার বাক্যবাণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। সকলেই তাহাকে শক্ত করিয়া দেখিল, ইহাদের দৃষ্টিতে ভর্ৎসনা ছিল। বৈজুনাথ বুঝিল, মুখ দিয়া অনেকটা হাঁফ ছাড়িয়া কহিল, “হে গো, আমার কথা ধর না হে, কথায় আমার আঁকসাট নাই, আমি জাতচাঁড়াল গো, আমি তারাগুলা জলে দেখি আমার মাস শেয়াল শকুনে খায় না গো!”
এইটুকু মাত্র পদবিন্যাসে সকলেই মোহগ্রস্ত, এ কারণে যে তাহার বাক্যসমূহে জীবনের ক্লান্তি ছিল।
“মড়া দেখি দেখি আমি মাটি হইছি গো, আমি তো শব গো, বহুদিন মরে আছি হে…লাও বাবু মশায়, তোমাদেরই ই চিতা ত এখন গোড়া গাঁথছে, খোঁকাকে লিয়ে উ ঠাঁই বস গা, মনের কথা বল গা উ ঠাঁই…” বলিয়া বৈজু গঙ্গার দিকে অগ্রসর হইল।