“সুন্দরী তুমি” নিশির ডাকের মত আওয়াজ আসিল “চন্দন চাঁদ তোমার কাছে পোড়া কাঠ…গো…তুমি সত্যই সুন্দর, তুমি ত্রিলোকেশ্বরের ঘরণীর থেকে সুন্দর…তুমি…”। বৈজুনাথ এখন প্রায় যশোবতীর নিকটে আসিয়া পড়িয়াছিল। তাহার আর পিছু হটিবার পথ নাই, আকন্দ বৃক্ষ তাহা রোধ করিয়াছে, আর অল্প দূরে ঢাল-নিম্নে খালের মত, যাহা জলাশয়।
যশোবতী উন্মাদ কণ্ঠস্বরে ভাঙ্গিয়া পড়িলেন, “চণ্ডাল”–
“ওলো! ওলো! সরে আয়, ওলো, তোকে দেখে কনে বউ ভয় পাচ্ছে লো” বলিয়া এক হাতে নরকপালকে লইয়া প্রায় স্কন্ধের কাছে স্থাপন করিয়া কিঞ্চিৎ ঘুরিয়া দাঁড়াইল।
“তুমি কে?” ‘কি’ বলিতে গিয়া যশোবতী ‘কে’ প্রয়োগ করিলেন। তাঁহার কণ্ঠে ক্রন্দন ছিল।
“বড় আধ্যাত্মিক প্রশ্ন গো কনে বউ…শেষ নিঃশ্বাস নিয়ে যে জীব বেঁচে থাকে, আমি সেই জীব বটে গো…”
“পথ ছাড়…”
“কনে বউ, একে দেখে…কঙ্কাল দেখে ভয় পাচ্ছ কেনে? এ তো তোমার ভিতর আছে, তোমাকে খাড়া রেখেছে। একটু চেয়ে দেখ কত সুন্দর, কত মায়া, আকাশ বাতাস গঙ্গার থেকে এ বড় সুন্দর বটে…তুই খুব সুন্দর না রে,– বলিয়া তাহার চিবুক ধরিল।
যশোবতী বুঝিলেন, বৈজুনাথ মাতাল। তাহার গাত্র হইতে নরবসার গন্ধ, তাহার মুখে প্রকৃতির গন্ধ।
“চণ্ডাল ওটা ফেলে দাও…”
“সে কি গো আমার ঘরণী যে বটে, আমি গেরস্থ…ঘরণীকে ফেললে মহাপাতক হব যে…”
“চণ্ডাল!” এ স্বরে যশোবতীর ইহকালের প্রতি বাসনা ছিল।
“অমন কথা তুমি ব’ল না, তুমি কে? না সতী। তোমার নামে কুট সারবে…লে লে সতী মাকে গড় কর, সেবা দে বউ” বলিয়া তাঁহার পায়ের নিকটে নরকপাল রাখিতে গেল।
যশোবতীর ভয়ে যেন গায়ে কাঁটা দিল, “পিশাচ চাঁড়াল!”
বৈজুনাথ উঠিয়া দাঁড়াইয়া হাসিল, “ওগো সতী হুজুর, আমি মড়া পোড়াই, চাঁড়াল বটে, তবু পুরুষ মানুষের জান বটে, পুরুষের হৃদয়, এখানটা পুড়তে সময় লেয়, তোমার এখানটা পুড়তে সময় লেয়” বলিয়া আপনার উদর দেখাইয়া কহিল, “তুমি এখানের কথা কি জান, মনের জন্য পিশাচ আমি হই– এই আমার ঘরণী, তুমি যদি…বুড়ো যদি তোমার ইহকাল পরকাল হয়, এই বা কি দোষ করলে গো কনে বউ। লে লে বউ গড় কর, সবই মায়া বটে।”
“না না…” যশোবতীর কণ্ঠস্বরে যেন আকাশ বিদীর্ণ হইল।
“একটুক সিন্দুর দাও গোতোমার নামে এর গায়ে মাংস লাগবে…এই আবার ভাতে কাঠি দিবে, বিয়োবে, মাই দিবে গো। টুকুন সিন্দুর, সতীর সিন্দুর মেঙ্গে লে বউ…”
“চণ্ডাল…আমাকে কেন ভয় দেখাচ্ছ?”
“ভয় দেখাব কেনে, বউ দেখাই, সিন্দুর মাঙ্গি, এ শ্মশানে আর আমি পাব কোত্থাকে? এ শ্মশানে এক সিদ্ধ ছিল, মেয়েদের চুলের পৈতা ছিল, এক কঙ্কালকে ‘ওগো ভৈরবী গিন্নী’ বলে ডাকত যে হে…”।
যশোবতীর চর্ম লোল, জিহ্বা শুষ্ক হইয়াছিল। নরমুণ্ডের দিকে চাহিয়া রহিলেন। তিনি অনাদি অনন্তকালের দৃশ্য দেখিয়াছিলেন।
চণ্ডাল কহিল, “অনেক ভেবে চিন্তে আমি একে ঘরে তুলোম…আমি…তোমাকে কনে বউ, আগে বাঁচাতে চেয়েছিলাম…তুমি গালমন্দ করলে, তখন ভাবলাম এ আমি কি ভুল করছি। তোমাকে না বাঁচাবার সুকৃতি ফলে তুমি যে যে ঘরে জন্মাবে আমিও কাছে জন্মাব–এটা কি বেশী চাওয়া?”
যশোবতীর মনে, নিশ্চয় একথা সত্য যে, যিনি মায়া বহির্ভূতা তাঁহার মনে, তপোবন-বিরোধী বিকার উপস্থিত হইল।
বৈজুনাথ নরকপালে সস্নেহে হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিল, “না, সতাঁকে পেলে হনুমানের মত আয়ন ঘোষ হয়ে থাকতে হবে, বুড়ো তখন কেলে ছোঁড়া হয়ে” বলিয়া নরকপাল বংশীর ন্যায় ধরিয়া কহিল, “বাঁশী বাজাবে, তুমি জল আনতে ছুটবে–তার থেকে এই ভাল…”
যশোবতী এ ইঙ্গিত বুঝিতে পারেন নাই, একারণ যে তাঁহার ভীতি তখনও ছিল।
যশোবতী ইতিমধ্যে ক্ষিপ্রবেগে নরকপাল তাহার হাত হইতে ছিনাইয়া লইয়া উর্ভে ধারণ করিলেন,চণ্ডাল তাঁহাকে ধরিতে গেল, হাত দিয়া কঙ্কাল লইতে গেল। কোন মতে যশোবতী আকন্দ গাছ অতিক্রম করত পলায়ন করিতে গিয়া সহসা পড়িয়া গেলেন; এক হাতে নরকপাল জলাশয়ের করের মধ্যে প্রতীয়মান।
চণ্ডাল পশুর মত হাতে ভর দিয়া, হামাগুড়ি দিয়া স্থির।
উন্মাদহাস্যে কহিলেন “না”…তাঁহার একটি হাত নরকপালের কাছে যেখানে কর, যেখানে জলজ লজ্জাবতী, তাহার উপর অদ্ভুতভাবে আন্দোলিত হইল, লজ্জাবতী লতা ব্রীড়াবনত হয়।
চণ্ডাল তাঁহার একটি হাত ধরিয়াছে, সহসা কিসের শব্দ হইল।
.
বায়ু স্থির, পাখীরা উড়িয়া গেল, ধরিত্রীর বক্ষে কে যেন হাঁটু ডলিতেছে। ত্রিলোক এক হইয়াছে। ওজস্বিনী বিশাল তরল সমতল শ্মশান দাম্ভিকভাবে আসিতেছে, মহাব্যোমে স্ফুলিঙ্গ উদ্ধত।
চণ্ডালের ঘরণী করের মধ্যে ডুবিয়াছিল, ইন্দ্রিয়াসক্ত, সমগুণপ্রধাণা যশোবতী বেপথুমানা; মহা আবেগে মুষ্ঠিতে দূর্বাদল আকর্ষণ করিয়াছিলেন। নিঃশ্বাসে অজাগর ঠিকরাইতেছে। নীহারধূমাকানিলনলান খদ্যোৎ বিদ্যুৎ স্ফটিক শশীসম্ভব আলো আপনার কপালে খেলিতে লাগিল।
“কনে বউ…কোটাল।”
কপাল কুঞ্চিত করিলেন, সুখশয্যা ত্যাগ করিবার তাঁহার ক্ষমতা নাই। “কোটাল কোটাল” বলিয়া যেমন সে উঠিতে যাইবে, কনে বউ তাহার হাত বজ্রজোরে ধরিলেন। তিনি দেহাভিমানিনী, কেননা সম্ভবত অষ্টপাশ ছিন্ন হয়।
“কোটাল বান হে আসছে হে বুড়ো…”
“কনে বউ এসো…বুড়ো…তোমার বর।”
“মরুক…”
.
একটি নিঃশ্বাসের পরেই তিনি, যশোবতী, পরিশ্রান্ত ঘর্মাক্ত অশ্বের মত ছুটিয়া আসিলেন। ভেড়ী পথে উঠিলেন। এক দিকে বিগলিত লৌহের মত, জল-পৰ্বত আসিতেছে, নিম্নে ফুলশয্যা, আর অপেক্ষমাণ বৃদ্ধ স্বামী। ফুলহার সকল দোলায়মান, যাহা দূর হইতে বিছানা, ফুলহার, যেমন বা গোলাপশীতল পোম্পাইয়ের আতিশয্য।