“কি গো…”
“তুমি ভুলে গেছ…”
যশোবতী ভ্রূ কুঞ্চিত করিলেন।
“তুমি ভাবছ বুড়ো বরের আবার অতশত…”
“আহা বল না কেনে…”
“ফুলশয্যা…”
যশোবতী জিব কাটিয়া গণ্ডস্থলে অঙ্গুলিপ্রদান করত কহিলেন, “আই গো, দেখেছ…মরণদশা, আমার একেবারে খেয়াল নেই গো…ছিঃ…”
“চুলটা বেঁধে লাও”,বৃদ্ধের স্বর গদগদ হইল।
“না, সন্ধ্যে হয়ে এল, গাছে হাত দেওয়া যাবে না…কৰ্ত্তা আমি দুটো ফুল নিয়ে আসি।”
“কি ফুলই বা পাবে…”
“তোমার পূজার ফুল সব ঠাঁই জন্মায় গো, কেনে আকন্দ। তুমি ত শিব…। না পাই বেলপাতা।”
বৃদ্ধ আচম্বিতে তাঁহার হস্তধারণ করিয়া আপনার কম্পন অনুভব করিয়াই স্থির, এই মুহূর্তে আসন্ন সন্ধ্যায় দুজনে দুজনের প্রতি গভীরভাবে দেখিলেন। দুজনে দুজনকেই পান করিলেন। সম্বিৎ ফিরিয়া আসিল। নববধূ আর দেরী করিলেন না।
যশোবতীর দেহ যেমত জ্বরে উষ্ণ; গায়ে জল বসিয়াছিল অথবা যোগনিদ্ৰাপ্রসূত দেহ ভারাক্রান্ত। তিনি ধীর পদক্ষেপে ভেড়ীপথে উঠিলেন, চারিদিক প্রেক্ষণ নিমিত্ত লক্ষ্য করিলেন, সম্মুখে চারিদিকে শ্মশান, শায়িত স্বামী, নিম্নে গঙ্গা। অন্যত্রে ধান্যক্ষেত্র, বহুদূরে গ্রাম, রাখাল গোরুসকল লইয়া ফিরিতেছে, এমত সময়ে তাঁহার শ্রবণে আসিল ক্রমাগত ‘আয় আয়’ ধ্বনি। সম্ভবত বুনো স্ত্রীলোকেরা তাহাদের পালিত পশুপক্ষীকে প্রত্যাবর্তন করিতে বলিতেছে। এই ‘আয় আয়’ ধ্বনি তাঁহার দেহের নিকটে আসিয়া পরিক্রমণ করিতে লাগিল। তিনি আপনার দেহের উষ্ণতা অনুভব করিলেন। অধৈৰ্য্য হইয়া ভেড়ীর ঢাল বাহিয়া দ্রুতপদে নামিলেন, নামিবার কালে তিনি বৃক্ষাদি ধরিয়াছিলেন, যাহাতে অসাবধানতাবশতঃ পদস্খলন না হয়। এবং ঝটিতি একটি কচু পাতা লইয়া ফুল চয়নে ব্যাপৃত হইলেন। এখনও শুনা যায় ‘আয় আয়’ ধ্বনি।
ফুল লইয়া আসিয়া মালা গাঁথিলেন–চাঁদোয়ার খুঁটি মালার হারে সজ্জিত হইল। সীতারাম যশোবতাঁকে দেখিলেন, আর তিনি দেখিলেন পিছনে লাল চাঁদ। মিলনের অভিলাষে নববধূ পূর্ণাঙ্গ। ফুল অনটন হইল। ফলে, যশোবতাঁকে পুনরায় ফুল আনিতে যাইতেই হইল। এই সেই লতাবিতান পরিমণ্ডিত উৎকৃষ্ট কানন, এখানে নববধূ আরবার ফুলচয়নে ব্যাপৃতা।
‘আয় আয়’ ধ্বনি তাঁহার গাত্রে যেমত লাগিয়া যাইতেছে, তিনি বিরক্ত একারণে যে, বড়ই তাঁহার অসোয়াস্তি হইতেছিল, এবং ঠিক এই সময়ই কাহার গলার স্বর, ক্রমাগত কথার স্রোত শুনিয়াই সচকিত হইয়া প্রথমে নির্লিপ্ত, পরে আগ্রহের সহিত অনুধাবন করিতে সচেষ্ট হইলেন, তাঁহার কর্ণমূল রক্তিম হয়। দেখিলেন, চণ্ডাল বৈজুনাথ, মনে হয় শায়িত, গাছে গাছে অনেকটা অদৃশ্য, কিন্তু তাহার মুখমণ্ডল সম্পূর্ণ দেখা যায়, হস্তদ্বয় উত্তোলিত। ইহাতে মনে হয় কাহাকে যেন ঊর্ধ্বে ধারণ করত সে এ-সকল কথা কহিতেছে। এখন বৈজুনাথ বলিল, “তুমি কি গো, তোমার মন কি গো; মোষের শিঙে সরষে দাঁড়ায় না, তার বেহদ্দ গো ধনি।”
যশোবতী ইত্যাকার বাক্যে অন্ধ হইয়া গেলেন, নথ কম্পিত হয়, তাঁহার রাশ আন্দোলিত।
বৈজুনাথ ছড়া কাটিল–
“হেই বড়াই, হে বড়াই মেরো না আমলার ছড়ি,
কাটান কাটায়ে দিব খাজনার কড়ি,
ঘরকে ঠায় নিমগাছটি নিম ঝুরঝুর করে,
সদাই বিড়ালী বিটি লিওলিয়াই করে,
ফল লিবি না কোদাল লিবি সত্যি করে বল,
নয়ত ভাশুর ভাতার ধর”
ইহার সহিত তাহার উচ্চ হাস্যধ্বনি শোনা গেল।
“কুত্থাকে ছিলে হে ধনি এতে কাল, মনের মানুষকে ভুলে, কত আকাশ গেল, বাতাস গেল, এতদিন পরে–তবু ভাল হে, তবু ভাল হে–বিনিসুতোর মালা গাঁথুনী মালিনী গো।”
এক একটি কথা এমন যেন বা উহা কর্দমের ঢেলা, ক্রমাগত তাঁহার দিকে আসিতেছে, আর যে, তিনি, যশোবতী, কোনক্রমে আত্মরক্ষা করিতেছেন। কখনও বা গাছের সঙ্গে মিশিতেছেন; এখন হস্তচ্যুত ফুলগুলি কুড়াইতে বসিয়া মুখ ঘুরাইয়া যাহা দেখিলেন, তাহা বীভৎস এবং পলকের জন্য জ্ঞানশূন্য হইলেন।
এ সময় চণ্ডাল বৈজুনাথ ঝটিতি আপনার মুখের সম্মুখে একটি নরকপাল আনিল, যাহার সহিত এতাবৎ কথা কহিতেছিল।
চণ্ডাল নরকপাল লইয়া মহা আদর করিতেছিল, কাকুতি মিনতি করিতেছিল, বাক্যের দাসখত দিতেছিল। “তুমি ত আমার সব গো–এখন এত কথা বলছি? বেঁচেছিলাম কি করে? কেনে? ডিমের মত নড়ন নাই চড়ন নাই, ধুক ধুক নাই…পায় পড়ি গো…প্রত্যয় যাও–ওমা”, অতঃপর সহসা সে মুখ ঘুরাইয়া কপট আশ্চর্য সহকারে কহিল, “ওমা, কনে বউ যে!”
এই ডাকই তাঁহার সম্ভ্রম নষ্ট করিল, তিনি আত্মরক্ষায় প্রয়াসী হইলেন।
“দে দে, ঘোমটা দে লোলোকে বলবে কি? হায়া নাই সরম নাই, কোথাকার খড়মপেয়ে, খোয়াড়ে লিয়ে যাবে হে…কনে বউ…” বলিয়া উচ্চৈঃস্বরে কহিল, “আমার বউ এসেছে গো এতদিন বাপের ঘরে হাঁড়ি ঠেলত, ধান ভানত…লে লে শালী আবার হায়া কি গো–ই ছি ছি তোমায় দেখি সরমাইছে, হারে কপাল বৃষভানুনন্দিনীর আবার সরম–মেয়েমানুষ শালী পুরুষের হাড় লিয়ে খেল মাঠে বসি যখন, ডুগডুগি বাজাতে যখন, এত হায়া কোথায় থাকে…হে হে…বিবাহ এক রক্তের লেশা–” বলিয়া নরকপালে ঠোনা মারিল, নাচাইল।
যদি নির্ম্মাল্যবৎ যশোবতীর অনেক অভিজ্ঞতা হইয়াছিল, চৈত্র প্রান্তরের ঘূর্ণি হাওয়ার ন্যায় সোজা হইয়াছিলেন, এরূপ কাণ্ড তিনি আশা করেন নাই, সংক্রান্তির সাগরসঙ্গমের হিম হাওয়া তাঁহার গায়ে বিষক্রিয়া করিতেছিল। চণ্ডালের হস্তে নিঃসঙ্গ চালোকে মধ্যরাত্ৰ খেলিতেছিল।