অসহায়ভাবে চণ্ডালের প্রতি চাহিয়া কহিলেন, “না আমি কি খেলা…”
“এ যে গঙ্গার জল বাড়ান কথা গো, জমি-হাঁসিল কথা বটে তোমার মুখে…কনে বউ, ড্যাঙায় দাঁড়িয়ে বল, লাও চল…”
“না আমি মরব…”
“কোন দুঃখে! মরতে পারলে তুমি বাঁচতে…”
তাঁহাকে প্রদক্ষিণ করত কহিতে লাগিল, “এখন খ্যান (ক্ষণ) আসে নাই…বললেই হল হে–চল চল-হরগৌরী দেখে আমাদের পাপ যাবেক গো…”
“না…”
“শেষ মেষ কি আমায় ধরতে হবে হেবামুনের মেয়ে আমার পাপ বাড়িও না। লাও মাথা খাও তোমার পায়ে পড়ি, চল…”
দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিয়া ঝটিতে উল্টাইয়া সাঁতার কাটতে লাগিলেন। তীরে উঠিয়া অবনতমস্তকে স্বামীর নিকটে আসিলেন।
যশোবতী সিক্তবসনে দণ্ডায়মানা, আপনকার অঙ্গুলিতে তাঁহার দৃষ্টি, নিম্নেই বৃদ্ধ স্বামী। বৃদ্ধ অন্যদিকে চাহিয়া অনুযোগ করিলেন, “তুমি না আমায় ছেড়ে যাবে না…ছোট ছেলে মাকে হয়ত মারলে…তাতে মা তাকে ছেড়ে যাবে…আমি বুড়ো…” বলিয়া সীতারাম দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিলেন, ইহার পর কহিলেন, “তা ছাড়া এই শ্মশানে মড়ার গন্ধে আমি কি আর আমি আছি বউ…”
যশোবতী ইত্যাকার কথায় ব্যথিত হইলেন, তিনি ক্ষণেকের জন্য চারিদিকে অনুভব করিলেন, নিজের চিতা-চিহ্নের দিকে নজর পড়িল, তথাপি স্বামীর জন্য ব্যাকুলতা ছাড়া আর কোন ভাবান্তর আসিল না।
“তুমি রাগ করলে গো, সীতাকে কিন্তু তুমি ত জান…”
“জানি…”
“তবে? রাম তাকে দুষ্ট বললেন, তবু তিনি…আমার কথা…দেহের বিকার গো…”
যশোবতীর দেহলগ্ন বস্ত্র শুকাইতেছে, মনোবেদনা ক্ষয় হইতেছিল, পুনরায় সমলোষ্ট্ৰাশ্মকাঞ্চন বুদ্ধির প্রত্যাবর্তন হইল; কেবলমাত্র নাসার বেসর চমকিত, নিঃশ্বাসে কম্পিত। তিনি যে দেহ বহিয়া বেড়াইতেছিলেন, সে দেহ শূন্য কলসের মত–তবুও তাহার গুরুভার ইদানীং জ্ঞান হইতেছিল– ক্লান্তিতে তাঁহার আঁখিপক্ষ্ম নামিয়া আসিতেছিল। মধ্যে মধ্যে ভিজা চুল এলো করিয়া দিয়াছিলেন।
“বউ কিছু খাও…”
“ভাল লাগছে না…”
“কেউ ত এল না–তাহলে তুমি চাট্টি ভাত খেতে…তারা কখন আসবে…”
“কি জানি…”
“তুমি রাগ করছো…”
“না গো…”
“আমায় ছুঁয়ে বল।”
“সত্যি …”
“তুমি আমার কে জান না…তুমি এই আকাশ ঢেকে দাঁড়াবে…তুমি শ্মশানকে…”
যশোবতী সনাথ হইলেন। বৃদ্ধের পার্শ্বেই ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলেন।
.
বেলা যখন প্রায় লাল হইয়াছে, তখন যশোবতীর নিদ্রা ভঙ্গ হইল। চক্ষু মেলিয়া সহসা কি জানি কেন গাছ পাতা নদী জলকে তাঁহার বড় পরিচিত বোধ হয়। ইহা সেই বৃদ্ধের দেখা পৃথিবী মনে হইল, তাহাদের তিনি যেন নিঃশ্বাস দান করিতেছেন। শ্মশানের বহু কিছুই তাঁহাকে বিকল করিল না, আবালবৃদ্ধবনিতা যেরূপ এ শ্মশানকে মহৎ বোধে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে, সেইরূপ শ্মশানকে, তাঁহার, মহৎ বোধ হইল না–এই তিনি শ্মশান দেখিলেন, আর এক প্রসূতিগৃহে যাহা কূট গতিস্পন্দনে অধীর, যাহা মৃচ্ছকটিকসদৃশ ওঙ্কার, যাহা জাতিস্মর স্তব্ধতা।
তবু মাত্র চঞ্চল পদধ্বনি শ্রুত হয়, অষ্টসাত্ত্বিক বিকার সম্ভব মহাপ্রসাদের গন্ধ নরবসার গন্ধে, ভরপূর বহু মেঘমালার সখেদ ক্রন্দনধ্বনি, কভু, এ ক্ষেত্রে, সবুজতা আনিতে সক্ষম হইবে না। স্বাহাবিরহী লেলিহান শিখা দিণ্ডলে পরিব্যাপ্ত, লক্ষ মায়া ছাই হইয়া গিয়াছে, লক্ষ ক্রোড় খার হইয়া যায়–শোণিতস্রাবী বজ্রযান অন্ধকার। এ শ্মশানে শিব শব হইয়া আছেন, মহাবিদ্যা–আলুলায়িত। কেশরাশি যাঁর, তিনি আনন্দে শিহরিত। কারণ সলিল বাষ্প হইয়া যায়–শ্মশানকে মণ্ডলাকারে অমর হ্লাদিনী শক্তি পরিক্রমণ করিতেছে। ঘুম মৃত্যুর নির্জন প্রতিবিম্ব–মৃত্যুর ভালবাসা, ঘুমই সে-ভালবাসা বিলায়, জীবনে ফুলকারী সোহাগ আনে। যশোবতী ঘুম চোখে দেখিলেন, যেখানে তিনি অমর।
সহজেই যশোবতীর মনে হইয়াছিল, এ দেহসকল দৃশ্য–আমি তাহার সাক্ষীস্বরূপ।
তিনি সন্ন্যাসিনীর ন্যায় সকল কিছুই আলো এবং অন্ধকার দেখিলেন। সদ্য নিদ্রোখিতা হওয়ায় তাঁহার ভ্রম হয়, ইদানীং অপরাহুকে তাঁহার অকারণেই মনে হইল যে, পুনরপি ভোর হইল। যেমন বা তাঁহার জন্মান্তর আসন্ন, বহু প্রাচীনতম ‘আমি’ ক্রমে ক্ষীয়মাণ হইতেছে। যশোবতী বৃদ্ধের দিকে চাহিলেন।
“বউ ঘুম ভাঙল…”
যশোবতী অল্প হাসিলেন। “বউ আমার উপর রাগ নেই ত?”
“না গো তুমি আমায় অন্যায় কিছু ত বলনি” বলিতে বলিতে এতক্ষণ পরে তাঁহার শ্মশান দর্শনের ভীতি হইল।
“আমায় দুঃখু দিও না” দীর্ঘশ্বাসকে সংযত করিতে করিতে বৃদ্ধ বলিলেন, “তুমি আমায় ছেড়ে যাবে না ত?”
সঙ্গে সঙ্গে যশোবতী তাঁহার মুখ চাপিয়া ধরিলেন। কিন্তু পরক্ষণেই তাঁহার চম্পকসদৃশ হস্তকে ক্রমে ক্রমে ঠেলিয়া কয়েকটি কথা আসিল, “আমার কেউ নেই।”
“আমি আছি কৰ্ত্তা তুমি ছাড়া আমি কই” বলিয়া পুনৰ্ব্বার যশোবতী সেই অব্যবহিত অহৈতুকী অবিচ্ছিন্ন মনে বৃত্তি লাভ করিলেন। ললাটে স্বেদবিন্দু দেখা দিল। দেহের রুক্ষতাকে চমকিত করিয়া যৌবন চঞ্চল হইল।
অনুক্ষণ ডাক ছাড়িয়া কে যেন বলিতেছিল, “আমি আছি–” মধ্যরাত্রে সে স্বর ধৈবতে দুঃখিত হইয়া, গান্ধারে কাঁদিয়া পুনরায় বিদ্যুৎ রেখাব দেখিয়া শুদ্ধ স্বরে ফিরিয়াছিল।
বৃদ্ধের চোখে জল আসিল। আপনাকে সম্বরণ করিয়া কহিলেন, “বউ চুল বাঁধবে না…”
“হ্যাঁ…”
বৃদ্ধ কি যেন বলিতে গিয়া থামিলেন।