যশোবতী স্বভাবসুলভ স্থিরভাবে, দুধের কলস রাখিয়া নিকটে ভেড়ীর খাঁজনে, ঝিক্ করিয়া পালা দিয়া, তুষের মালসা হইতে অগ্নিসংযোগ করত দুধ গরম করার পর বৃদ্ধের নিকট আসিয়া বলিলেন, “দুধ পাওয়া গেল” বলিয়া স্বামীর প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া দেখলেন, তিনি যেমত বা মৃগী রোগাক্রান্ত। তিনি তাঁহার গায় ব্যাকুল চিত্তে হস্তপ্রদান করিবামাত্র বৃদ্ধ মহারোষে তাঁহাকে নিবৃত্ত করিতে চেষ্টা করিলেন। যশোবতীর তাহাতে কোনরূপ মান হইল না। স্বামীর জন্য চিন্তাকুল হইয়া পুনরপি সস্নেহে তাঁহার সেবা করিবার জন্য তৎপর হইবামাত্র বৃদ্ধ যেন রাগতস্বরে এক কালেই অজস্র কথা বলিয়া গেলেন–কহিলেন, “কোথা মরতে গিয়েছিলে?”
“দেরী হয়ে গেল বড়, না গো…”
পত্নীর সরল কণ্ঠস্বর তাঁহাকে, বৃদ্ধকে, অতিমাত্রায় কুপিত করিল। “খাব না ও দুধ…”
“সে কি…”
“না” বলিয়া আরবার মুখ ফিরাইলেন।
“আর দেরী হবে না…লক্ষ্মীটি…তুমি যদি রাগ কর তাহলে আমি যাই কোথা…রাগ ক’র না…।” বৃদ্ধ স্বামীর রাগের কারণ বুঝিয়া, অভাগিনী তাঁহাকে তুষ্ট করিবার মানসে যত্নবান হইলেন। অঙ্গুলিপ্রদান করত বুঝিলেন, দুধ প্রায় ঠাণ্ডা হইয়া যায়।
“দুটি পায়ে পড়ি…দেরী…”
“ফেলে দাও দুধ…”
যশোবতী তাঁহার পদদ্বয় ধরিয়া অনেক কাকুতি মিনতি করিতে লাগিলেন। বৃদ্ধ কহিলেন, “মরণকালে আমার এই ছিল! ছুঁয়ো না আমাকে…হারামজাদী নষ্ট খল খচ্চর মাগী…”
হরিণনয়না যশোবতী, পবিত্র যশোবতী স্বামীর পদদ্বয় হইতে মস্তক তুলিয়া বিস্ময়াবিষ্টের মত তাকাইলেন। তাঁহার চক্ষুদ্বয় যেন কাঁচে রূপান্তরিত হইল। যেন দ্রুতগতি অসংখ্য পতঙ্গ তাঁহার কানে গুঞ্জন করিতে লাগিল। সত্ত্বরজস্তম গুণাবলী হইতে কে যেন তাঁহাকে অব্যাহতি দিল।
বিকৃত মুখব্যাদান করত কহিলেন, “রাক্ষুসী ন্যাঙনী মাগী-লেথিয়ে তোর মুখ ভাঙ্গি…”অনেকবার তাঁহার কুৎসিত মাড়ি বাহির হইল, যাহা বন্যবরাহের মুখগহ্বরসদৃশ রেশমী, অনেকবার তাঁহার গাল-চোষার বিকৃত আওয়াজ শোনা গেল।
ভগবান! তুমিও বোধ করি অদ্যাবধি এত গঞ্জনা শোনো নাই। এ হেন অশ্রাব্য ঘৃণাসঞ্জাত কুকথায় বাত্যাক্ষুব্ধ লতিকার মতই যশোবতী থরহরি। অধর দুটি আপনাদের আকর্ষণ অমান্য করত মুক্ত হইতে চাহিতেছে, কে যেন বা তাঁহার কর্ণে, ‘তোমরা আমাকে কি পেয়েছে, তোমরা কি!’ বাক্যাবলী বলে।
সম্মুখে উৎক্ষিপ্ত বৃদ্ধ সরলরেখা। ক্রোধে হস্ত মস্তকের নিকটে–এবং কেশ বর্তমান এরূপ জ্ঞানে আকর্ষণ করিয়া ফিরিতেছিল। মধ্যে মধ্যে ‘ওহো হো হো’ শব্দ।
.
নদীসৈকত, শ্মশান, অশরীরী মায়া এই নির্মমতা পর্য্যবেক্ষণ করিতেছিল!
যশোবতী স্বামীর দুর্বল একটি পা, বক্ষে স্থাপন করত কি যেন বলিতে চাহিয়াছিলেন, ইহাও সত্য তাঁহার মধ্যে কে যেন একটি শ্লোক জপ করিতেছিল—’ন পতিঃ সুখমেধত যা স্যাপি শতাত্মজা।’ পরক্ষণেই বিশুদ্ধস্বভাবা, নিষ্কলুষ, পাপবিরহিতা যশোবতী ইত্যাকার শ্লোক শ্রবণ কালে, আপনার অভ্যন্তর বিহ্বল লোচনে নিরীক্ষণ করিয়াছিলেন, সেখানে অল্পবয়সী ঘুম ছিল, সেখানে ঘোর জটাজাল আবৃত মধ্যরাত্র। কোন এক দুবৃত্ত তস্কর ছিদ্র করিতে যত্নবান, ক্রমাগত খর খর শব্দ। তাঁহার শিরাসমূহ টঙ্কার দিয়া উঠিল। স্বামীকে তিনি তবু শুধু মাত্র বলিলেন, “বাঁচাও বাঁচাও…” কিন্তু শোনা গেল “ওগো ওগো…”
বৃদ্ধ তখনও ক্ষান্ত হন নাই।
“আমায় আর কষ্ট দিও না–আমার…” একদা তিনি শ্মশানের দিকে ভয়ঙ্করভাবে চাহিলেন। সেখানে আবছায়া চণ্ডাল, বুক যেন তাহার অধিকতর স্ফীত, যেন ব্যাঘ্ৰ খেলিয়া ফেরে, যেখানে চালোক উৎসবে লতাপত্রের ছায়া ছিল।
সীতারামের পদদ্ধয় অশ্রুসিক্ত, তবু, তাঁহার ক্রোধে যেমন বা নূতন করিয়া দন্তপাতি দেখা দিয়াছে। তিনি পৈতা ছিঁড়িয়া অভিশাপ দিতে গেলেন। দুগ্ধপাত্র স্থানচ্যুত হইল। এখন কাক আসিয়া সেই দুগ্ধ পানে ব্যাপৃত।
অভিশাপের উত্তরে যশোবতী বলিলেন, “আর জন্মে যেন তোমাকে পাই…” আপনার সত্ত্বগুণকে রক্ষার নিমিত্ত এ আপকালেও ক্রমাগত অনেক কথার মধ্যে এই কথা বলিয়াছিলেন যে, “সমুদ্র যেমন তীরভূমিকে লঙ্ঘন করে না, তেমনি আমিও আপনাকে কখনই লঙঘন করিব না।”
“মাগী…পটানি ফাজিল–গঙ্গা ডুবে মর গা–”
এসময় বৃদ্ধের মুখের কষের পাশেই মাড়ি, কিছুটা নাসা-গহ্বর এবং অদূরে সুন্দর পবিত্র মুখোনি দেখা গেল।
“বেশ আমি যাচ্ছি…তাই যাব…”
“মর মর…মরগে…”
স্খলিত জড়িত পদে যশোবতী কয়েক পদ বায়ুতাড়িত–গঙ্গাতীর ঢাল বশে–তাঁহার গতি দ্রুত হইল। হাহাকার করত গঙ্গার দিকে ছুটিয়া গেলেন।
সীতারামকে এই দৃশ্য প্রবুদ্ধ করে। শায়িত দেহ যেন ঊর্ধে লক্ষ্যপ্রদান করিল–চক্ষে উল্কার বেগ, তিনি উচ্চৈঃস্বরে থমকাইয়া বলিলেন, “বউ বউ চণ্ডাল চণ্ডাল” বলিয়াই মুখ হাঁ করিয়া আপনার সহধর্মিণী যশোবতীর নীতিজ্ঞানহীন সংকল্প দেখিতে লাগিলেন।
এবম্প্রকার দৃশ্যে চণ্ডাল বৈজুনাথ স্থির, তর্জ্জনী তুলিয়া দিনির্ণয় করিতেছিল, না হিসাব করে তাহা প্রমাণসাপেক্ষ, এখন সে স্বর-বৈষম্য শুনিল, গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়া এক দমে দুঃখিনী যশোবতীর নিকটে গিয়া পড়িল। যশোবতী তখন ডুবিতে গিয়া ক্রমাগতই ভাসিয়া উঠিতেছেন।
“কনে বউ…লাও চল…তুমি কি আর গঙ্গায় ডুবতে পার গো? গঙ্গা যে তোমার মধ্যে ডুববেক…হে হে গো…লাও চিৎ সাঁতার দাও গো-কেঁদে কেঁদে দম নাই তোমার যে,– বৈজুনাথ কহিল।