বৈজু-আশ্রিত চাকচিক্য দুলিয়া উঠিল! বৈজু চাঁড়াল হাস্য সম্বরণ করিতে পারিল না। ভোরের হাসিতে যে ভাই-ভাই ভাবটুকু থাকে, সেইটুকু এ-হাসিতেও ছিল। কিন্তু বৈজু একটু বেশী রকমে অভিমানী, সে ‘নীচ কুলোব, পাছে তাহার হাস্যধ্বনি কাহারও দেহে লাগে সে কারণে সে উৰ্দ্ধ আকাশে হাস্যধ্বনি ছড়াইয়া দিয়া কহিল, “কেনে গো বাবুমশায়, এখনও (!) অবাক কি হেতুক, তোমার কি মনে লয়!” বলিয়া আয়ত নয়নে ঈষৎ বিস্ময় হানিয়া তাহার দিকে চাহিল।
বৈজুর হাস্যধ্বনি শ্রবণে লোকটি ভয়ার্ত হয়, অত্যধিক অস্বস্তি সহকারে তাহার প্রতি সকলেই তাকাইয়াছিল, কারণ এরূপ হাস্য স্থানকালপাত্র ভেদে যারপরনাই অসংযত বলিয়া মনে হয়। অন্যপক্ষে বৈজু চাঁড়াল বুঝিল, লোকটি এক্ষেত্রে ছায়াবৎ, কোন স্বাভাবিকতা নাই, এবং তাহার যাহা কিছু বোধ ছিল, তাহার কিছুটা শবদাহের সহিত পুড়িয়া ছাই হইয়া গিয়াছে। সুতরাং সে এই শ্মশানভূমি নির্দ্দেশ করিয়া কহিল, “তুমি কি ভাব মনে রাত্তদিন শুধু জোড় খায় ই ঠাঁই।” এই উত্তরে ভীত লোকেরা ধরা পড়িয়া গেল। “ই যে মহাটোল বটেক, কত ডাগর ডাগর পণ্ডিত আচাজ্জি ই ঠেন পাঠ দেয় গো, কত যুক্তি আঁটে, আমি শুনি …হ্যাঁ…আমি শুনলাম বটে, তত্ত্বকথা বেজায় জানি হে, আত্মার সাকিম কুত্থাকে তার থানা কোথা; আমি যে তার সরিক!” বলিয়া আনন্দে ডানহাতখানি বাঁ হাতের এবং বাঁ হাতখানি ডানহাতের পেশীকে চাপড়াইল। ইহার কিঞ্চিৎ পরে অত্যন্ত গোপন খবর দিবার মত করিয়া বলিল, “কলস? সে যে হ্রিদয়! ইটা যে স্মৃতি, সিকথা গোবিন্দ আচাজ্জি বললে, মড়া পুড়াতে এসে বললে, বৈজু এ-ইটা ঘটাকাশ, ভাঙলেই পটাকাশে মিলবে বটে, হিসাব মিলে যাবে, আমরা ভাবি কলসটা স্মৃতি… হে হে অমনভাবে না…না…গো বাবু মশায়।”
বৈজুর কথার মধ্যেই নিৰ্বাপিত চিতার নিকটে এক কলস জল রাখা হইয়াছিল, শ্মশান যাত্রীদের একজন এই কলসটিকে ভাঙিয়া, এই স্থান পরিত্যাগ করত চলিয়া যাইবে; যে জন ভাঙিবে সে বাঁশটিকে ঠিক যুত করিয়া ধরে নাই দেখিয়াই, বৈজু তাহার কথা থামাইয়া হাঁ-হাঁ করিয়া ছুটিয়া আসিল। পাছে চণ্ডালের ছোঁয়া লাগে তাই সকলেই যথাসম্ভব সরিয়া গেল। বৈজু আপনাকে সামলাইয়া বলিল, “খুব ডাগর জোর ধর হে বটে, এ হে বাবু…উ তো কলসী–তোমার মাগ লয়।” এবার মুচকি হাসিয়া কহিল, “আর কেনই বা তা লয়, হ্যাঁ জোর করি ধর, অন্যদিকে চাও, লাও মার শালা জোর গুঁতো, যাক শালা ঘটাকাশ পটাকাশে।”
রুদ্ধশ্বাস-স্তব্ধতা দেখা দিল, বৈজু পুনরায় বলিল, “ভাঙার শব্দ হলে ইদিক পানে আর চাহিবে না গো, শুধু হরি বোল দিবে…হরি বোল।”
এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে বিকট ভাঙার শব্দ হইল, শূন্যতা বাড়িল। এই সঙ্গে অযুত হরিধ্বনি শোনা। গেল, বৈজু তাহার কথা কয়েকটি বলিয়া মুখোনি অর্ধ-উন্মুক্ত করিয়া দাঁড়াইয়াছিল। সেও শব্দ শোনা মাত্র বলিয়া উঠিল, “সাবাস সাবাস” এবং ইহার ক্ষণেক পরেই, সে চকিত হইয়া বলিয়া ছিল, “হে রে রে রে…ই দিকে চেওনা…সোজা ঘরকে যাও…।”
তাহারা সকলেই ত্বরিত পদে, শ্মশান পরিত্যাগ করিয়া সুউচ্চ ভেড়ীপথে উঠিল, অদৃশ্য হইয়া গেল। ইহারা সকলেই–যে ইতিপূৰ্ব্বে ছিল–তাহার প্রমাণস্বরূপ বৃক্ষাদির পাতা কম্পিত হইতে লাগিল; কেননা তাহারা ভেড়ীপথ হইতে নামিবার কালে বৃক্ষের ডাল আকর্ষণ করত নামিয়াছিল।
কম্পমান পত্রাদির দিকে বৈজু কিয়ৎকাল চাহিয়া রহিল, কাহাকেও সে দেখিতে পায় নাই, সহসা নিৰ্বাপিত চিতার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল, এখন সে তাহার পৌরুষে দুর্ধর্ষ ঘাড়খানি ঘুরাইয়া দেখিল ছোট ছোট প্রজ্বলিত পাটকাঠির টুকরা মাটিতে পতিত হইয়া ক্রমে নিভিতেছে, এবং তৎসহ গম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণ উৎসারিত হয়, “যে তোমার শোক মোহ এ সকল গেল” (শুধু মাত্র প্রেম রহিল সম্ভবত)। বৈজুনাথ, চিতাপ্রদক্ষিণকারী বালকের হস্তধৃত মুখাগ্নিনিমিত্ত প্রজ্বলিত পাটকাঠির আলোকে ভাঙা কলসের অনেক টুকরার মধ্যে পুনরায় কি যেন অনুসন্ধান করিতে ব্যস্ত হইল।
দুই একটি সেই ভাঙা কলসের টুকরা পা দিয়া সরাইতেই, একটি রৌপ্যখণ্ড তাহার চোখে পড়িল, ইহাই সে খুঁজিতেছিল। সত্বর রৌপ্যখণ্ডটি কুড়াইয়া লইয়া মহাউল্লাসে এক কদম, বগল বাজাইয়া, নৃত্য করিতে গিয়া সে একীভূত স্থির!
ক্কচিৎ কখনও সেও স্থির হয়!
সমীপস্থ চিস্থিত মৃতের কণ্ঠলগ্ন ফুলমালা জ্বলিতেছে, আর অন্য পাশে, বালকের বিহ্বল বিমূঢ় সদ্য শুনছিন্ন অসহায় মুখমণ্ডল আর ইতিমধ্যেই অগ্নিশিখা, এবং বালকের সম্মুখে ঘূর্ণিহাওয়া যেমত আবর্তিত হয় তদ্রূপ সমস্ত সৃষ্টি ঘুরিয়া উঠিল। পরক্ষণেই, বাবা গো’ বলিয়াই বহ্নিমান চিতার দিকে সে ছুটিতে উদ্যত হইল।
বৈজুনাথ অন্যমনস্ক, তথাপি আপনার দায়িত্বজ্ঞানে হাঁ-হাঁ করিয়া বাধা প্রদান করিতে গিয়াছিল। বালকটির বয়সী সঙ্গীরা বালককে ধরিয়া ফেলিল; তবুও এখনও, বালক স্বীয় আবেগ সম্বরণ করিতে সমর্থ হয় নাই। একথা সত্য যে, মৃত্যুর গভীরতায়, এক মুহূর্তের জন্য চন্দ্র সূৰ্য্যকে হারাইবার মত স্থিরতা তাহার নাই। যদিচ, সবুজতা তাহার কাছে নিশুতি রাত্রের ঝিঁঝি স্বর এমত, যদিও আপনার নিঃশ্বাস পরিদৃশ্যমান আলোকে আড়াল করিয়াছিল, যদিও স্পর্শবোধ ভোরের পাখীর কণ্ঠস্বরে উধাও।