“আমায় সত্যিই সুন্দর দেখতে, না…”
“হ্যাঁ…”
“তুমি…ঠাট্টা? আমায় রাজপুতুল বলত…”
যশোবতী করুণ স্বরে উত্তর দিলেন, “কেন এ কথা বলছ গো”
বৃদ্ধ রূঢ়ভাবে তাঁহার দিকে কটাক্ষপাত করিয়া একটি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিলেন। যশোবতী বুঝিলেন স্বামী মনঃক্ষুণ্ণ হইয়াছেন; কি ভাবে যে বুঝাইবেন তাহা ভাবিয়া পাইলেন না, অবশেষে তাঁহার বক্ষ স্পর্শ করিয়া কহিলেন, “মিথ্যা বললে পাপ হয়, আমার মরণে মিথ্যা নাই গো…সত্যিই তুমি সুন্দর”
বৃদ্ধ আনন্দে বিহ্বল হইয়া কি যে বলিবেন স্থির করিতে পারিলেন না, “জরা যেন কে নিয়েছিল?”
“তোমার তো জরা নেই, যদি থাকে জরা সে তো আমি, আবার জন্মাবে আবার আসব…” বৃদ্ধ পত্নীর আশা শুনিয়া কহিলেন, “আমাকে তোমার মনে ধরেছে…” “মনই তো সব।”
৭. জলের আয়নার প্রতিবিম্ব
এখনও জলের আয়নার প্রতিবিম্ব বৃদ্ধের অঙ্গে খেলিয়া উঠিতেছিল। যশোবতী খোলামকুচি দিয়া অন্য মনে নির্লিপ্ত ভাবে এতল-বেতল খেলিতেছিলেন। বৃদ্ধকে এই ক্রীড়া উৎসুক করিয়াছিল, তিনি নিবিষ্ট মনে তাহা লক্ষ্য করিতেছিলেন, তদবস্থায় কহিলেন, “মানুষ এমন ঘুরে ঘুরে আসে…” একটি শ্বাসের শব্দ শোনা গেল, শূন্যতা সৌখীন হইল। যশোবতী নিমেষের জন্য খেলা স্থগিত রাখিয়াছিলেন, পর মুহূর্তেই আরম্ভ করিলেন।
বৃদ্ধ খেলা দেখিতে দেখিতে প্রস্তাব করিলেন, “এস এস আমরা বাঘবন্দী খেলি…”। খেলিবার কালে কতবার যশোবতাঁকে, “জুয়াচোর, এ খুঁটি কি করে এল” ইত্যাকার দোষারোপ করিয়াছিলেন। এমত সময় ঘোর হরিধ্বনি শোনা গেল। বৃদ্ধ কর্ণে হস্তপ্রদান করিলেন।
“তুলা দি…”
“না…”
“ধর আমি যদি যাই, তুমি…” বলিয়া বৃদ্ধ একটি চাল দিলেন।
যশোবতী একদৃষ্টে স্থির থাকিয়া স্মিতহাস্য করত মস্তক আন্দোলিত করিয়া আপনার দৃঢ় সংকল্প প্রকাশ করিলেন, “জাল ছিঁড়ে যাবে, পুকুর ছেড়ে ত যাবে না।”
“না, ওটা দিও না তোমার খুঁটি মার খাবে…ভয়…করবে না।”
“তুমি আছ আমার ভয় কি…আমি যে তোমার মধ্যেই সরলভাবে যশোবতী একান্ত নির্ভরতা প্রকাশ করিলেন।
তথাপি বৃদ্ধের মন মানিল না, খুঁটি ধরিয়া কহিলেন, “টক্কা না ফক্কা…”
“টক্কা…”
দেখা গেল বৃদ্ধের হাতে খুঁটি রহিয়াছে; বৃদ্ধ আনন্দে আটখানা, “তাহলে বাঁচবো গো…আবার মড়া পোড়ার গন্ধ আসছে, বাঁচবো? তুমি ধর।”
যশোবতীর ক্ষেত্রে দেখা গেল সেখানেও একই ফল। উল্লাসে বৃদ্ধ বলিলেন, “আর ভাবনা নেই…আমি কিন্তু পাল্কীতে যাবো…তুমি আমার কাছে…বড্ড খিদে পাচ্ছে গো।”
“চিঁড়ে ছাড়া…”
“দ্যুৎ–দুধ”
“কোথায় পাব গো…”
“আমার বাড়ীতে কত গোরু…তুমি উঠে দেখ না, মাঠে কত…চণ্ডালকে ডাক না…”
“আমি ডাকবো কি করে?” বলিয়াই যশোবতী আপন অন্তরে শিহরিত হইলেন।
“তাতে কি…”
ক্রমে বৃদ্ধ অবোধ হইয়া উঠিলেন। “একটু দুধ তা-ও” হুঁ হুঁ করিয়া কান্নার শব্দ আসিল। যশোবতীর তাঁহাকে বুঝানোর চেষ্টা বিফল। তবু বৃদ্ধ পুনঃ পুনঃ আবৃত্তি করিতে লাগিলেন, “দুধ না হলে জোর পাব কি করে? তুমি যোগাড় কর…”
যদিও স্বামীর জন্য নববধূ কাতর হইয়াছিলেন, তথাপি কহিলেন, “আমি বউ মানুষ…তারা এখুনি আসবে, তখন নয়…লক্ষ্মীটি অমন ক’র না…”
“আমি আমি…”
যশোবতী অগত্যা উঠিলেন, ভেড়ীপথের উপর হইতে দেখিলেন অনতিদূরে বুনোদের বাড়ী, কিছু উত্তরে। তিনি ভেড়ীপথ ধরিয়া গিয়া দাঁড়াইলেন, এখান হইতে বুনোদের গৃহপ্রাঙ্গণ দেখা যায়। যশোবতী ভেড়ীপথেই–তাহাদের গৃহসম্মুখে দাঁড়াইয়া, একটি স্ত্রীলোককে তিনি ইঙ্গিত করিয়া ডাকিলেন, তাঁহার ক্ষুদ্র কলসটি দেখাইয়া কহিলেন, “একটু দুধ দেবে…” বলিয়া তাহার দিকে একটি সিক্কা পয়সা ফেলিয়া দিলেন। স্ত্রীলোক সিক্কা পয়সা কুড়াইয়া লইয়া দুধ আনিয়া দিল, দুধ তিনি কাঁখে লইতে শুনিলেন, “কি কনে বউ?”
যশোবতী কিঞ্চিৎ বিচলিত হইলেন। যাহা কিছু ঘটিয়াছে তাহা এতক্ষণ মনেই ছিল না, এবং তাহার কোন কিছুই তাঁহার স্মরণ ছিল না। চণ্ডালকে আপাদমস্তক দেখিয়া চিনিতে পারিলেন, গুণ্ঠন টানিয়া চলিতে শুরু করিলেন।
“দুধ আনতে এসেছিলে…হে হে আমি ছিলাম ঠায়, আমাকে বললে না কেনে, পাঠিয়ে দিতাম গো…তুমি বউ মানুষ,– চণ্ডাল কহিল।
“এলাম…”
“এখন বুড়ার গায়ে গত্তি লাগবে বটে…এ হে হে এখানে লামছ কেনে গো…”
তাহার কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই যশোবতী ভেড়ীপথ ভাঙ্গিয়া নামিয়া পড়িলেন। অল্প দুধ ছলকাইল, চণ্ডাল পিছু ছাড়িল না।
এক্ষেত্রে যশোবতী তাহাকে কিছু বলিতে চাহিলেও লজ্জায় বলিতে পারিতেছিলেন না। কখনও তাঁহার গতিকে দ্রুত করিয়াছিলেন, কিন্তু তথাপি চণ্ডাল তাঁহার পিছু পিছু আসিতেছিল।
“কয়েক প্রহর বাদে গো, এসব মাটি নিয়ে খেয়োখেয়ি হবে গো”–বৈজুনাথ নিজের দিকে চাহিয়া বলিল।
যশোবতী চলিতে লাগিলেন।
“হে গো আমার কথার উত্তর দাও না কেনে…”
“এখন যাও…”
“আহা” বলিয়া বৈজুনাথ কিঞ্চিৎ সহজ হইবার চেষ্টা করিল।
“চণ্ডাল…”
“তোমার কথায় কনে বউ আমার জন্মান্তর হল, আমি এখন…”
“এখন যাও…”
চণ্ডাল বৈজুনাথ স্থির হইল; তাহার পর, তিনি অগ্রসর হইলেন। এ সময় সত্বর চণ্ডাল তাঁহাকে অনুসরণ করিতে গিয়া পিছলাইয়া পড়িতে যশোবতী এ শব্দে সচকিত হইয়া ঘুরিয়া হাস্য সম্বরণ করিতে পারিলেন না।
বৃদ্ধের কর্ণে একটি হাস্যের শব্দ আসিল। তিনি কোথা হইতে হাস্যধ্বনি আসিতেছে তাহা অনুধাবন করিবার চেষ্টা করিয়া, বক্রদৃষ্টিতে দেখিলেন; দেখিলেন, যশোবতী এবং চণ্ডাল। সীতারাম অসম্ভব চঞ্চল হইয়া উঠিলেন, শিরা-উপশিরা স্ফীত হইল, অভ্যন্তরে কে যেন ধূম্রজালের সৃষ্টি করিল, আপনকার মাড়ি ঘর্ষণ করিলেন, ইহার শব্দ শয্যার খড়ে প্রতিধ্বনিত হইয়াছিল। যুগপৎ বিস্ময়ে ঈর্ষায় বার্ধক্য যেন যৌবদশা প্রাপ্ত হইল। তিনি ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিলেন। ভাবিলেন, আমার আকাশই ভাল; কিন্তু সহস্র ধিক্কার তাঁহাকে মাটিতেই ধরিয়া রাখিল। চক্ষুর্ঘয় কোনক্রমেই বন্ধ রাখিতে পারিলেন না। আক্ষেপে ক্ষোভে অভিমানে তিনি পুড়িতে লাগিলেন। একবার মাত্র কহিলেন–”তুমি না বামুনের বউ, ছিঃ” বলিয়া, ক্ষোভে দুঃখে অন্যদিকে মুখ করিয়া রহিলেন, তাঁহার শরীর তরঙ্গায়িত, সম্মুখে শ্মশান।