.
ক্রমাগত পাখী ডাকিতেছে, হাওয়া ছিন্নভিন্ন; সীতারাম যেন প্রাণ লাভ করিয়া সটানা কণ্ঠে ভোরাই গাহিতেছিলেন, “রাই জাগো রাই জাগো।” যশোবতী, শ্রান্ত, ঝড় বিলুণ্ঠিত বৃক্ষ বা, ঘুমে অচৈতন্য। ক্রমাগত গীত আসিতেছিল, ক্রমে তিনি নয়নযুগল উন্মীলন করিলেন; যে পৃথিবী প্রাণময়, যে পৃথিবী প্রতিবিম্বময়, তাহা রঙীন হইল; স্বামীর গান তাঁহাকে মোহিত করিয়াছিল। ভাবের ভাবি করিতেছিল। ভালো লাগিতেছিল।
“বউ ভোর গো”…
যশোবতী কোনমতে স্বামীর কানের তুলা খুলিয়া, “এখানে শ্বশুর শাশুড়ী ত কেউ নেই, ঘুমোই না” শিশুর মত কহিলেন।
“ঘুমাও ঘুমাও”…
“না গো, আমি” বলিয়া উঠিয়া বসিলেন, আলস্য বিদূরিত করিবার পর স্বামীর প্রতি চাহিলেন।
“বল তুমি আছ বলে বড় বাঁচবার সাধ হচ্ছে…”
“কি করে এত স্পষ্ট বলছ গো, ওমা…”
বৃদ্ধ হাসিলেন। “তোমার জন্য বাঁচবার…”
“ঠাকুর ঠাকুর…তোমাকে বাঁচতেই হবে।”
“তোমার উপর বড় মায়া পড়ে গেছে, মায়া হয়…বুক চিরে দেখাব…”
যশোবতী অবাক হইলেন, নিঃশব্দে কহিলেন, “ঠাকুর ঠাকুর…”
.
“আমার বড় খিদে পাচ্ছে…” বৃদ্ধ কিছু পরে কহিলেন।
“চিঁড়ে খাবে? পারবে?”
“হ্যাঁ!…আচ্ছা আমায় তোমার মনে ধরেছে…”
“ছিঃ ছিঃ…কি যে…”
“আমার বড় আয়না দেখতে সাধ হয়।”
“ফর্সা হোক…”
অনেকক্ষণ পর ইতস্ততঃ করিয়া সহসা কি যেন বা তাঁহার, বৃদ্ধের, স্মরণ হয়; ফলে তিনি অবিচারিত চিত্তে বলিলেন, “আচ্ছা বউ, আমাদের ফুলশয্যা…” এবম্প্রকারের কথা বলিবার পরক্ষণেই তাঁহার সম্ভবত লজ্জা হইল।
যশোবতী নীরব থাকিয়া কহিলেন, “কেন হবে না…”
সম্ভবতঃ পূৰ্বের উক্তি চাপা দিবার জন্য বৃদ্ধ কহিলেন, “বউ…আমি যদি মরি তোমার মন কেমন করবে?”
অকপটে যশোবতী কহিলেন, “খুব”–এ বাক্যে আন্তরিকতা ছিল, গঙ্গার বাস্তবতা ছিল।
“হুঁ…মিছাই”
“মিথ্যা আমার মরণেও নেই, কৰ্ত্তা।”
“সত্যি “…
“সত্যি “…
যখন রীতিমত আলো হইল তখন সীতারাম সলজ্জভাবে স্ত্রীর দিকে চাহিয়া বলিলেন, “বউ আমি উঠব, বসব।”
“কষ্ট হবে না…”
“না, বসে একটু ডাকব…”
সীতারামের ঠিক পিছনে, যাহাতে তিনি হেলান দিতে সমর্থ হন, তাহার উপযোগী করিয়া একটি কলস উল্টাইয়া বসাইয়া দিয়া বৃদ্ধকে কোন ক্রমে উঠিয়া বসিতে সাহায্য করিলেন। এ সময়, সীতারাম বক্ষে কর স্থাপন করত আকল্পনবীনা এই পৃথিবী দর্শন করিয়া ইষ্টমন্ত্র জপ করিয়া, “রাধা শ্যাম” স্মরণ করিলেন। কয়েক মুহূর্ত পরেই চক্ষু খুলিয়া গেল, চতুর্দিকে চাহিয়া ভারী খুসী হইলেন, “বউ বড় ভালো লাগছে গো–”
ইহাতে যশোবতীর বড় আনন্দ হয়, এবং বৃদ্ধের ক্রমাগত গাল-চোষার মুদ্রাদোষ আর তাঁহার চোখে পড়িল না।
“বহুদিন পরে যেন দেখছি…” বলিয়া তিনি একটি গভীর নিঃশ্বাস লইয়া পরে ত্যাগ করিবার কালে অল্প কিঞ্চিৎ কাশিলেন এবং তৎসহ একটি “আঃ” শব্দে স্বস্তির ধ্বনি শোনা গিয়াছিল। গঙ্গাকে প্রণাম করিতে করিতে কহিলেন, “মা মা মাগো”–পুনৰ্ব্বার খুসী মনে, টপ্লাগায়কের মত, চারিদিকে চাহিলেন। বলিলেন, “মনে হয় সব যেন আমার…”
অনন্তর মাটিতে হাত চাপড়াইতে চাপড়াইতে কহিলেন, “আঃ কি সুন্দর…” সহসা হাতটি লইয়া লেহন করিলেন।
যশোবতী সত্বর তাঁহার হস্তটি ধরিয়া ব্যাকুলভাবে আপনকার অঞ্চল প্রান্ত দ্বারা পরিষ্কার করিতে করিতে বলিলেন, “ছিঃ গো ছেলেমানুষী করছ গো, শ্মশানের মাটি…কেউ মুখে দেয়…বৈরাগ্য হবে যে গো, আমার থেকে মন উঠে যাবে, এ দেহ দেখে নেতিবিচার করবে” বলিয়া স্বেচ্ছায় আপন লজ্জা ত্যাগ করত চটুল হাসি হাসিয়া বৃদ্ধের-দেখা পৃথিবীটিকে নিরীক্ষণ করিলেন।
“তা বটে তা বটে…আচ্ছা বউ আমার বুক দশ মরদের মত না, আ… আয়না…”
“আয়না কোথায় পাব…আমি তো জলে…”
“আমাকে দাও…”
যশোবতী একটি মালসায় জল লইয়া আসিলেন। অধৈৰ্য্য বৃদ্ধ জলপূর্ণ মালসাটি লইবার জন্য মন্ত্রবলে অত্যুগ্র আগ্রহ হস্ত প্রসারিত করিলেন, যশোবতী তাঁহার হস্তে দিলেও মালসা ছাড়েন নাই, তিনি নতজানু হইয়া স্বামীর সম্মুখেই বসিয়া ছিলেন। বৃদ্ধ যশোবতাঁকে অজস্রবার মৃদু ভর্ৎসনা করিলেন, “আঃ ঠিক করে ধর না–কি কচ্ছ পাগল–কখনও স্থিরভাবে নিজের, একদৃষ্টে প্রতিবিম্বের দিকে, জীবনের দিকে চাহিয়া রহিলেন–তাঁহার শীর্ণ স্কন্ধ স্পন্দিত হইল–ধীরে মুখোনি তুলিয়া পত্নীর দিকে তাকাইয়া কহিলেন, “আমায় সুন্দর–”
যশোবতী আপনকার সুন্দর মুখোনি আন্দোলিত করিলেন, বৃদ্ধের, স্বামীর, উক্তি সমর্থিত হইল।
বৃদ্ধ সীতারাম স্বীয় প্রতিবিম্বের পশ্চাতে অম্বর, কখনও মেঘমালা এবং উড়ন্ত পক্ষী দেখিলেন– দুস্তর গাম্ভীৰ্য আসিল, এবং প্রশ্ন করিলেন। বৃদ্ধ আপনার চক্ষু দেখিলেন, মমত্ববোধ আসিল এবং সেই প্রশ্ন করিলেন, বৃদ্ধ আপনার দন্ত দেখিতে মাড়ি দেখিলেন, ঝটিতি জিহ্বা দেখিলেন ভয় আসিল, সত্বর প্রশ্ন করিতে গিয়া দেখিলেন, ভয়ঙ্কর কাশির ধমকের মধ্যে মালসা দু’জনের হস্তচ্যুত হইয়া ভাঙ্গিয়া খান খান হওয়ার মধ্যে, এ বিপর্যয়ের মধ্যেও একটি প্রশ্ন শোনা গেল। যশোবতী বারম্বারই বলিয়াছিলেন, “তুমি সুন্দর তুমি সুন্দর তুমি সুন্দর।”
যশোবতী তাঁহার স্বামীকে ধরিয়া যত্নে কলসে ঠেস দিয়া ধরিয়া রহিলেন। অসুস্থতা প্রশমিত হইল। গঙ্গোদক দিয়া স্বামীর চোখ মুছাইয়া দিলেন।