“বউ…”
স্বামীর ডাকে তাঁহার দেহ যেমত বা মোচড় দিয়া উঠিল, এ ডাকটিকে হস্তদ্বারা ধরিতে চাহিলেন; কেননা, মনে হয়, এহেন দুর্বিপাকে তাহা ব্রহ্মাস্ত্রের মতই কাজ দিবে, এবং এ ডাক শ্রবণমাত্রই তিনি উত্তর করেন, “এই যে গো, কেনে?” কিন্তু সীতারাম কোনই সাড়া দিলেন না, নিশ্চয়ই তিনি ঘুমের মধ্য হইতে আপন পত্নীকে সম্বোধন করিয়াছিলেন। বৃদ্ধ ঘুমে অচৈতন্য, কারণ পরিশ্রান্ত, তাঁহার নিঃশ্বাসে বক্ষের ঘড় ঘড় ধ্বনি এই চক্ষুহীন নির্মম স্থানটিকে পুনঃপুনঃ রক্তাক্ত, পাংশু, ফ্যাকাশে, শব, অস্বাভাবিক, রুক্ষ, প্রেতাত্মক করিতেছিল।
যশোবতী, এ শ্মশান–যাহার পৈশাচিক রূপটি, প্রত্যেক জিহ্বাকে নাবালক, প্রত্যেক দৃষ্টিপথে জ্যোতির্মণ্ডলের বীজ ছড়াইয়া দেয় এবং এখানকার কিঞ্চিত্র শব্দে অন্য স্তব্ধতা থরহরি–এই সেই রমণী একদা যাঁহার মারাত্মক প্রলয়ঙ্করী শব্দে ত্রিভুবন মথিত হয়–তিনি আৰ্ত্ত, তিনি আর সহ্য করিতে অক্ষম। পলাতক জন্তুর পদধ্বনি শ্রবণে কতবার চমকাইলেন, তিনি যেন প্রাণপণ মাটি আঁকড়াইয়া থাকিতে প্রস্তুত, আর সম্ভব হইল না, হিতাহিত বিবেচনা অদৃশ্য হইল, তিনি আপন স্বামীকে ছাড়িয়া দৌড়াইয়া ভেড়ীপথে উঠিলেন।
মাঠে আবছায়া কুয়াশা, যে কোন বস্তুতেই নীচকুলোদ্ভব চণ্ডাল বিদ্যমান হইল, যশোবতী ছোট করিয়া হাঁক ছাড়িলেন, স্বর বক্র হইল। কণ্ঠ পরিষ্কার করিয়া চৌকিদারী কণ্ঠে হাঁকিলেন।
এ এক অদ্ভুত স্থান হইতে তিনি আর এককে ডাকিতেছেন, যে মানুষ তাঁহার আসন্ন ভীতি হইতে রক্ষা করিবে। এ স্থান লতা গুল্ম তৃণ বৃক্ষে আচ্ছন্ন, আর তিনি একটি বেশী প্রকাশ। এ ভাবনায় তাঁহার দেহ দুলিয়া উঠিল, তথাপি আত্মসম্বরণ করিলেন।
অনেকবার এইরূপ করা হইল, কিন্তু প্রতিটি হাঁকই করুণ প্রতিধ্বনি হইয়া ফিরিয়া আসিল। মহা আক্ষেপে যশোবতী বৃক্ষ আঁচড়াইলেন, এবং প্রত্যাবর্তনের উদ্যোগ করিবার কালে তাঁহার মনে হইল শেষবারের মত ডাকিয়া চলিয়া যাইবেন। সুতরাং এইবার হাঁক দিলেন।
তদুত্তরে নিকটস্থ বৃক্ষের পার্শ্ব হইতে ছাগধ্বনি আসিল। দুঃখিনী যশোবতী মহাউদ্বেগে যত্রতত্র দৃষ্টি সঞ্চালন করিলেন। আর, আবার, ছাগলের খেদধ্বনি শোনা গেল। যশোবতী বালিকাই বটে…তাঁহার মধ্যে ছাগটিকে আলিঙ্গনের বাসনা দেখা দেয়। আর যে, পরক্ষণেই মনে হইল, ছাগ আছে বলিয়াই যে চণ্ডাল আছে এমন নহে; এ বড় ন্যায়ের কথা। পলকেই সবিস্ময়ে শুনিলেন ছলাৎ করিয়া একটি শব্দ; ব্যগ্র নয়নে দেখিলেন, একটি বাঁকলগ্ন কলস হইতে জলীয় কিছু পড়িল; যদিচ আধো আলো আধো অন্ধকার, ইহার পর প্রকৃতির রজগুণরাশির তথা পাতা লতাগুল্মের ছায়া যাহার সৰ্ব্বশরীরে-সশরীরে বাঁক কাঁধে বৈজুনাথকে দেখা গেল।
যশোবতী প্রথমে সচকিত, কেননা ভয়, দ্বিতীয়ত লজ্জিতা যেহেতু আত্মাভিমান, বৃক্ষের পিছনে মুখ লুকাইলেন।
“কনে বউ”–বৈজুনাথ কোনক্রমে উচ্চারণ করিল।
অন্ধকার তাঁহার মুখমণ্ডলকে বৈচিত্র্য দান করত চলিয়া গেল, কেননা মলয় পবন ক্ষণিকের জন্য পত্র-রাশিকে শতচ্ছিন্ন করে, এ হেন সময়ে সহসা আলো আসিল; যশোবতী আপনার মধ্যে পদ্মগন্ধ। উপলব্ধি করিলেন, অল্পক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বৃক্ষ গাত্রে নখরাঘাত করিতে করিতে বলিলেন, “আড়া ভেঙে দিলে যে…” ইহা ব্যতীত তিনি কি আর প্রশ্ন করিতে পারেন!
“আড়া ছাড়া কি আর ভাঙব হে, উঁচু যারা তারা উনুন ভেঙে চলে যায়, আমার উনুন চিতা…তাই আড়া…তুমি আমায় ডাকতে কেনে এসেছ হে তা জানি বটে, বলব…”
যশোবতী তাহার দিকে চাহিলেন, দেখিলেন পত্রগুল্মের ছায়াচিত্রিত একটি মানুষ।
“শ্মশানে একা বড় ডর, না হে? শব না হলে শ্মশানে থাকে কে গো, শিব নিজে এখানে শব হয়ে থাকে, আমরা কোন ছার–এ বড় কঠিন ঠাঁই, দিন রাতে দেখা নাই। ভয় কেনে গো, তিনকুড়ি তন্ত্র আরজন্মে করেছ, এখনও মায়া…তাহলে? আমি কলসীর ভার কমাবার জন্য একটু সেবা করেছিলুম হে তাই…দেখা, কনে বউ। চণ্ডাল হয়ে জন্মেছি বলে আমি দোষ দিইনি রাগ করিনি, আমি ধম্ম খোয়াইনি, লাথি ঝাঁটা খেয়ে আছি…কিন্তু তুমি…” বলিতে বলিতে তাহার কণ্ঠে যেন বা পোকা ঢুকিল। সে কিছুকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বাঁক নামাইয়া সত্বর মদ্যপান করত দাঁড়াইয়া উঠিয়া কহিল, “এক গল্প বলি হে, তোমার রঙ যেমন দুধে আলতায়, আমার রক্তে তেমন দুধে আলতায়…কেনে? যে কোম্পানী। উপরে, সে আমাদের রক্তে দুধ দিইছে, যেমন তোমাদের বুকে দুধ দেয় গো, আমাদের রক্তে দুধ দেয় হে। চিতার আগুন আমার কিছুই চ্যামটে খয়রা করেনি হে, বড় কষ্ট হয় তাই…যা কিছু জেনো বটে হে শ্মশানেই আমার আঠা…তোমার শাপ মনে লয়, আমার মনে ড্যাঙ্গাডহর আছে, বীজ বৈখরী…চায়…পাপ আছে…”
“চণ্ডাল, আমি…”
“আমি! আমি! তুমি কার আমি। তুমি ত এক প্রহরের শ্বাস টানা শব; কাল এতক্ষণ চাঁদ যখন লাল, তখন লয়…তাই আমি বলেছিলুম বটে হে…রক্ত আমার দুধে আলতায় গো।”
“এখন না মরে আমার উপায় কি বলতে পার…আমায় ফেন দেবার লোক কই…”
“তোমার কেউ নেই…তোমাদের জাতে কুটুম…”
“আমাদের, কেউ থাকে না…”
“বড় ডাগর জটাধারী কথা গো, গঙ্গার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পার…”
“তুমি ভুল বুঝলে হে, আমার স্বামী ত আছেন, যাক ও কথা, তুমি আজ রাত্রে যেও না” বলিয়া চলিয়া গেলেন, কেননা এ সময় পুনরায় আপনার দেহে তীব্র পদ্মগন্ধ আলোড়িত হয়।