.
যশোবতী রোদনে যেন কূল পাইতেছিলেন না, ফলে বৈজুনাথ তাহার কণ্ঠ কিঞ্চিৎ উচ্চগ্রামে তুলিয়া বলিল, “শ্মশান আমার ইহকাল, আমার মনে পুণ্য নাই পাপও নাই, যদি থাকত!… তুমিই কাল হতে কনে বউ…লাও, আমি দাঁড়াব না তোমারও সময় হয়ে এল, কাল পূর্ণিমা…আমি যাব। লাস যদি আসে…তারাই দেখবে; তুমি পুড়বে আমি দেখতে…হ্যাঁ জেনো হে আমার মনে শুকের (শুকদেব) বাস” বলিয়া সে চলিয়া গেল। চন্দ্রালোক বর্ধিত হইল।
যশোবতীর আপনকার ব্যথা ইন্দ্রিয়সমূহকে এরূপ জর্জরিত করিয়াছিল যে বৈজুনাথের কোন কথাই তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করে নাই। তিনি নিজেকে একা পাইয়া, অবুঝের মতই কাঁদিয়া উঠিলেন, বারম্বার মিলন অভিলাষিণী নববধূ বলিলেন, “আমার কেউ নেই গো, আমার কেউ নেই।”
ভেড়ীর উপর হইতে বৈজুনাথ দেখিল।
দূরে, স্রোতক্ষুব্ধ বেলাতটে, একাকিনী যশোবতী, তিনি দণ্ডায়মানা, হস্তোপরি মুখমণ্ডল ঢাকিয়া ক্রন্দনরত, একপার্শ্বে কেশদাম হাওয়ায় সর্পিল, নিম্নে জলোচ্ছাস। এখন তিনি উর্দ্ধে মুখ তুলিয়া হস্তদ্বয় আশায় উত্তোলন করত ডাকিলেন, “ভগবান ভগবান” বলিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন। একদা, কাহাদের যেন বা সম্মুখের আকাশে দেখিলেন, দেখিলেন… আরব্য রজনী সমূহ এখানেই স্বপ্ন কুড়ায় আর কাহারা তাহাদের অনুনয় করে, “আমাদের বিনিদ্র রজনীর বারমাস্যা নিয়ে যাও, নিয়ে যাও…” তিনি আরও দেখিলেন, গোলাপের কেশরাশ্রিত পরাগ, যাহা ভ্রমরের অঙ্গীভূত হয়, আঃ ভ্রমর! তুমি বুদ্বুদের বাহন, দুঃখের বাহক। সে পরাগ শূন্যতার মোহিনী মায়াতে বিমোহিত হইয়া অচিরাৎ ভ্রমর অঙ্গচ্যুত–খসিয়া পড়িয়া ইদানীং উঠানামা করে…এরূপ নানাবিধ দর্শনে তিনি ভীতা, আৰ্ত্ত। কাক যেমত সূৰ্য্য দর্শনে ব্রাসিত হয়–কেননা, সূৰ্য অন্ধকারকে নিশ্চিহ্ন করিয়াছেন, অন্ধকার কালো, যেহেতু, সে, কাকও কালো, তাই ভয়ার্ত–তেমনি সেইরূপ ত্রস্ত শঙ্কিত হইলেন। তাঁহার ক্রন্দন উত্তরোত্তর বর্ধিত হইল, সে ক্রন্দনধ্বনি পত্র-মৰ্ম্মরের সংঘাতে বর্ণ, এবং বর্ণসমূহ স্রোতের সংঘর্ষে এবং শূন্যতার গভীরতা দ্বারা শব্দব্যঞ্জনালাভে একটি পদবিন্যাস সৃষ্টি করিল…ভগবান তোমার চাতুৰ্য মেলা-বিলাসী বালককে মোহিত করুক; আমি জানি জল বাষ্প হয়, আমি মধ্যপথে নিশ্চিহ্ন হয় না, আমি জানি বাষ্পবিন্দুকে সূৰ্যতেজ ধ্বংস করিতে সক্ষম হয় না, আমি জানি যখন তাহা মেঘতনু লাভ করে তখনই বিগলিত– এ চাতুৰ্য্য, এ বিভূতির জন্য, আমার মন নাই, মোক্ষ নাই, কেননা আমিই বিভূতি, আমিই তোমার চাতুৰ্য্য, আমি তোমার সুদীর্ঘ স্বাধীনতা, এ জীবনকে ‘খেলা’ বলি; তুমি আমার স্বাধীনতা, আমি বন্ধুহীন, দীন, তুচ্ছ। ইদানীং তোমার ক্ষণিকত্ব বহনে আমি বড় ক্লান্ত।
.
তিনি ঊর্ধ্বলোকে নির্ভীকভাবে অবলোকন করিলেন, যেখানে বিন্দুর অণিমার ক্রমাগত উঠানামা–ইহার পর স্বামীর কাপড়খানি তুলিয়া স্থলিতপদে স্বামীর শয্যাপার্শ্বে আসিয়া কিঞ্চিৎ গঙ্গাজল আপনকার মস্তকে ছিটাইলেন। মানুষের কখনই কেহ নাই একথা সত্য, নিকটে কেহ নাই একথা ভয়ঙ্কর সত্য। নিভৃত গোপন নিঃসঙ্গ নির্জনতা লইয়া কতকাল কাটাইবে, বিরহ কবে অরুণোদয় দেখিবে–যে ভগবান আমার জন্য ক্ষুদ্র হইয়াছেন…
“বউ”…
“কিগো” বলিয়াই মনে পড়িল স্বামীর দুর্গতির কথা, তিনি ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন। বারম্বার বলিতে লাগিলেন, “তুমি তুমি…”
“তুমি…কোথা…”
“এই কাপড় কাচতে…”
“এ্যাঁ”…
যশোবতী কানের তূলা খুলিয়া বলিলেন, “তোমার কাপড় কাঁচতে…”
“কেন?” যশোবতী আশ্চর্য্য হইলেন, বৃদ্ধের মুখপানে চাহিয়া দেখিলেন, কহিলেন, “তোমার কাপড় নোংরা হয়েছিল যে”…
“কষ্ট কষ্ট”
“না না…” তাঁহাকে আশ্বস্ত করিতে চাহিলেন। হঠাৎ কিসের শব্দ হইল। তিনি দেহকে খানিক উঁচু করিয়া লইয়া চারিদিকে দেখিলেন, অনন্তর শুনিলেন ছাগলের স্বর। দেখিলেন, বৈজুনাথের নৌকার ছইএর মত আড়াখানি, যাহা উল্টাইয়া পড়িয়া আছে, এবং অন্যদিকে ভেড়ীপথের উপর দাঁড়াইয়া কে একজনা ছাগলটিকে টানিতেছে। সে নিশ্চয়ই সে, এবং সেইক্ষণে একথা বুঝিলেন যে বৈজুনাথ সত্যই চলিয়া গেল।
যশোবতী স্বামীর পাশ ঘেঁষিয়া বসিলেন। কিছু পূৰ্ব্বে সংগ্রাম এবং ইদানীং ক্লান্তি অবর্ণনীয় নির্লিপ্ততার মধ্যে তাঁহাকে আনিতেছিল; বৈজুনাথের বিদায় গ্রহণ তাঁহাকে জাগ্রত করে, ক্রমে শৈত্য অনুভব এবং কিছুপরে শিবা ধ্বনি এবং তদুত্তরে পেচকের পীড়াদায়ক খর স্বর তাঁহাকে একীভূত করিল। ক্রমে দিত্মণ্ডলের বিনিষ্কন্দ্র মৌনতা ত্রিতাপহারিণী বহমান গঙ্গাকে ভয়াল করিয়া তুলে। ইহাতে যশোবতী সত্যই আতঙ্কিত, অনন্য উপায়ে নির্জীব প্রাচীন স্বামীর দিকে ভরসা করিয়া তাকাইলেন, বক্ষে হস্ত স্থাপন করত ইষ্ট দেবতা গোপীবল্লভকে স্মরণ করিতে বসিলেন। বারম্বার চক্ষু খুলিয়া গেল, অর্ধসিক্ত বসনের হিম তাঁহাকে শিহরিত করিল, ওষ্ঠ দংশন করিয়া কি যেন ভাবিলেন, রাত্র গণনা। করিলেন; জাঁতিটি লৌহ, ফলে স্বামীর শিয়রের তলে পুঁজিয়া নিজের হস্তমধ্যে অস্ত্রস্বরূপ কাজললতাটি লইলেন। চণ্ডাল নাই একথা ভাবিতেই–একাকী এই শ্মশানে, দংশনোম্মুখ বৃশ্চিকের মতই যাহার বর্তমানতা–স্বামীকে লইয়া সমস্যা বিড়ম্বনায় সঙ্গীন অবস্থায় পড়িলেন; আর একবার চণ্ডালের আড়ার দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন।