“কৰ্ত্তা কৰ্ত্তা…”
“অখণ্ড তোমার কৰ্ত্তা, তুমি মরবে কেনে গো…আমি আছি, বাঁচাব…এমন ঠাঁই ছেড়ে আসব তোমাকে, ফরসা হবে, তেনা (কাপড়) নাই আসতে লারবে, তুমি ইহকাল পাবে…” সে ইহার পর অনেক কিছু বলিতে চাহিল, কিন্তু পৃথিবী তাহার কাছে অতীব ডাগর, ডবকা, দশাসই, মনোরম; ছোট করিয়া কিছু বলিতেও পারিল না…।
“চাঁড়াল, চণ্ডাল…তোমার ভাল …”
“আমার আবার ভাল, কি বল্লিস গো কনে বউ…চুপ চুপ, আমার ঘরণী হাসবে বটে!”
“চণ্ডাল আমি যদি বামুনের মেয়ে…”
“আমার যেন সতীদাহ হয়, ভাবের ঘরে চুরি ভাল লয় গো…”
“চণ্ডাল আমি অভিশাপে…”
এই কথায় সে, বৈজুনাথ, উল্লসিত হইয়া চৌকিদারের মত ‘হোই’ দিয়া কহিল, “গল্প জান গো, অভিশাপ লাগবে না, দেহচিতায় মন যার পুড়ে” বলিয়াই হাসিল; একারণে যে এ বাক্য দ্ব্যর্থবোধক।
দুঃখিনী যশোবতী কহিলেন, “আমি জানি, শয়তান বজ্জাত।”
বৈজুনাথ থামিতে থামিতে, থামিল।
“নরকের কীট হয়ে জন্মাবি…খল।”
এবম্প্রকার উক্তি বৈজুনাথ এমনভাবে শুনিতে চেষ্টা করিল যেমন বা, মনে হয়, এ কথা অন্যত্র হইতে আসিতেছে।
“তোর (!) মতলব…আমি…” যশোবতীর কণ্ঠ লজ্জায় ক্ষোভে রুদ্ধ হইল।
বৈজুনাথ ইহাতে অধাৰ্মিক, নিন্দনীয় ইঙ্গিত বুঝিল। তাহার ডাগর চক্ষুৰ্ধয় রাগে বন্ধ হইল; যশোবতীর উক্তি যেন বা তাহার চোখে পড়িয়াছে, সে কয়েক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করিয়া মুখ দ্রুত সঞ্চালিত করত, আপনাকে সুস্থির করিবার প্রয়াস পাইল। আর যে, চকিতেই সে অস্ত্রাঘাতপ্রাপ্ত শাপদের ন্যায়, আকাশকে যুঁড়িয়া, ফুসিয়া গর্জিয়া, উঠিয়াছিল। সেই হেতু যশোবতীর ক্রন্দন, ক্ষণেকের জন্য থামিয়া যায়, এবং সে, বৈজুনাথ, আপনার দাঁতে দাঁতে ঘর্ষণ করত কহিল, “কি বল্লিস গো কনে বউ, তুমার মনে এই ছিল হে, শ্মশান আমার ঘরণী আমি তার শ্বশুর ঘর, ছি গো ছি, তুমি নারী কি পুরুষ তা আমি জানি না, ভেবেছিলুম তুমি পান্না ভৈরবীর মত সাদা!” বলিয়াই সে অত্যধিক ঘৃণ্য সামগ্রীর মতই যশোবতাঁকে যেমত বা ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিল।
যশোবতী নিশ্চয়ই আঘাত প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, কিছুকাল এলো এঁটেল বেলাতটে অদ্ভুতভাবে পড়িয়া রহিলেন, কেবল ক্রন্দনের হেতু তাঁহার সোহাগের শরীর উঠে নামে। এখন অপমান এবং ক্ষুব্ধধৰ্ম্ম তাঁহার মনোযন্ত্রণার কারণ হইয়াছিল। অগণন সিক্ত কেশরাশি ঝটিতি মস্তক আন্দোলনে সরাইয়া একটি হাতের কনুইয়ের উপর সমস্ত উত্তমাঙ্গের ভার ন্যস্ত করিয়া, অন্যহাতের তর্জ্জনী দ্বারা তাঁহাকে ইঙ্গিত করত শোকাভিভূত স্বরে কহিলেন, “বদমাইস শয়তান, আমার স্বামী অথৰ্ব্ব…তাই তোর এত আস্পর্ধা”– এইটুকুতেই বুঝা গেল যে তাঁহার স্বরভঙ্গ হইয়াছে।
বৈজুনাথ অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইয়াছিল, সে শুধু কহিল, “ছি গো গো, ছি” এবং ইহার পর বারম্বার শুনিল ‘আমার স্বামী অথৰ্ব্ব’–ইত্যাকার কথা তাহাকে বড়ই ছোট করিয়াছিল, এবং সে যথাযথ উত্তর মুখে আসিলেও বলিতে পারে নাই; পরক্ষণেই সে দ্রুত পদবিক্ষেপে ভাওলিয়া নৌকার কাছে আসিয়া, খানিক দূরে শায়িত বৃদ্ধকে দেখিল। এখন সে একটি ডাল কুড়াইয়া যশোবতীর পট্টবস্ত্র যাহা কিঞ্চিৎমাত্র শুষ্ক হইয়াছে, তাহা কোন উপায়ে ডাল দ্বারা তুলিয়া, কিছুদূর পর্যন্ত আসিয়া তদনন্তর নৌকাভিমুখে ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া, বেলাতটে এখনও ক্রন্দনরত যশোবতীর দিকে পিছু হাঁটিতে লাগিল। বেশ নিকটে পৌঁছাইয়া কোনরূপে পট্টবস্ত্র প্রদান করত কহিল, “কাপড় কনে বউ যেন শ্মশান আমার ঘরণী, আমি কিছু নই, কেউ নই, নই’-এর আমি কিছু…”
বস্ত্রখণ্ড, যশোবতীর অনতিদূরে, বজ্রাহত পক্ষীর মত পড়িল; বিদ্যুৎবেগে কাপড়খানি ধরিতে গিয়াই তিনি প্রায় উন্মাদের ন্যায় হইয়াছিলেন, দেহ পুড়িতেছে, বস্ত্রদর্শনে লজ্জা বেশী করিয়া তাঁহাকে গ্রাস করিল। অপমান তাঁহাকে নিগৃহীত, নিপীড়িত করে; মনে হইল বস্ত্র তাঁহার এ-লজ্জাকে কোন ক্ষেত্রেই ঢাকিতে সমর্থ হইবে না, এবং নিঃস্ব মুষ্টি আস্ফালন করিয়া, ‘আমি’ বলিয়াই তিনি মুহ্যমান, বিমূঢ়; সৰ্বসময় তাঁহার মনে হইতেছিল যেমত বা কোন অমূল্য সম্পদ হারাইয়াছেন, ফলে ‘আমি যদি সতী’ একথা তাঁহার বাধিল, অশ্রুপ্লুত নয়নে স্পন্দিত ওষ্ঠে তিনি কহিলেন, “তুই কৃমি কীট হয়ে থাকবি…” এ-ভয়ঙ্কর অভিশাপ তাঁহার বক্ষ উদ্বেলিত, স্বরকে আপ্লুত করিয়া উচ্চারিত হয়।
“মনুষ্য জনমে গড় করি, আমি আর চাইনা কনে বউ…কৃমিকীট কুকুর হওয়া ভাল গো, তাদের জাগা-ঘরে চুরি নেই, যাতনাও দেয় না। হে মা আমার কোম্পানী, সামনে আছেন, তোমার শাপ যেন ফলে।” এইসকল মনোভাব ব্যক্ত করিবার কালে, বৈজুনাথের হস্ত অঞ্জলিবদ্ধ ছিল, যে অঞ্জলির মধ্যে দক্ষতা ছিল না, এ কারণে যে তাহা করফেঁড়ে পরিণত হয় নাই, তথাপি তাহা দ্বিধা দোমনা নয়। এখন সে আবার কহিল, “লাও তোমার হইয়ে আঙুল মটকালুম গো, তিন সত্য করে কলির পাপ সত্যযুগ ঘুরে এল। …বড় বেগোড় বুঝলে হে…”
“দেখতুম শয়তান, উনি যদি জোয়ান হতেন…”
বৈজুনাথ এই বাক্যে খুব মজা পাইল, জিহ্বা দংশন করত কহিল, “ইঃ…হায় হায় গো! কি পাপ! তখন আমি তোমার সামনে দাঁড়াবার ভরসা রাখতুম। কি বলিস গো কনে বউ, তখনও কুকুর বেড়ালের সঙ্গে গা চাটাচাটি করে মণ্ডা খেতুম হে, আমি জাত চাঁড়াল।…ঘাট মানছি…” বলিয়া দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিল; পৃথিবী শুদ্ধ হইল।