ক্রমাগত স্রোতের দিকে চাহিয়া, তাঁহার আপনাকে বড় সহায়সম্বলহীন, ফলত বড় আপনার বলিয়া বোধ হয়; কোন কিছুর স্মৃতি মনে উদয় হইল না, শুধু মাত্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অন্ধকার ছোটাছুটি করিতেছে; যিনি উপরে আছেন, মাটিতে আর আর যাহারা, সকলই এক্ষণে নামমাত্র বৈ অন্য নহে।
এক এক সময় আত্মনিগ্রহ করিতে বাসনা হইল, দংশন করিতে ইচ্ছা করিল। এ কারণ যে, এই দুৰ্বত্তের অস্তিত্ব তাঁহাকে অধিকতর কাতর করিয়াছিল। স্বাভাবিক বিচার বুদ্ধি পর্যন্ত রহিত হইয়াছিল। এক্ষণে যে কি করা উচিত তাহা ভাবিয়া কিনারা করিতে পারিতেছিলেন না। অথচ সত্বর বস্ত্র ধৌত না। করিলে শুচিতা রক্ষা হয় না। স্বামীকে চক্ষের আড়াল করিতে তাঁহার কোন ক্রমে সাহস হইতেছিল না।
অনন্যউপায় তিনি স্বামীর কাপড়টি, আলগোচে লইয়া নৌকার পাশে যে অল্প আড়াল ছিল, সেখানে বসিয়া কাপড়টি কাচিলেন এবং একার্য সম্পাদনের মধ্যে বার বার উঠিয়া স্বামীকে দেখিয়াছিলেন। নিজের পট্টবস্ত্র অশুদ্ধ হওয়াতে ভাল মত ভিজাইয়া তীরে উঠিয়া স্বামীর কাপড়টি নৌকায় মেলিয়া দিয়া দেখিলেন, স্বামী শয্যায়, এবং কোথাও কেহ নাই; সত্বর জলের নিকটে আসিয়া গামছাখানি কোনমতে অঙ্গাচ্ছাদন করিয়া আপনার কাপড়খানি কাচিয়া মেলিয়া দিয়া পুনৰ্ব্বার গঙ্গার মাটি ভালভাবে গাত্র মার্জনার পর, স্নান সমাপন করত তীরে উঠিয়া, আপনকার বক্ষ সংলগ্ন গামছাপ্রান্ত খুলিয়া নিঙড়াইতে লাগিলেন, এ সময় তাঁহার দেহ বক্র হয়।
বৈজুনাথ এই বস্তুসংস্কার দেখিল; স্নানলীলা দেখিতে দেখিতে সে উজ্জ্বল হইয়া গেল, ক্ষীণমধ্যা অপূৰ্ব্ব ললিতপদ বন্ধনে দেহ তাহাকে, চণ্ডালকে, যেন বা মনুষ্যোচিত করিল। ভেড়ীর পিছনে সে দণ্ডায়মান, একটি পা শীতকাতর কম্পিত! নিঃশ্বাসে সম্মুখের বৃক্ষপত্র সরিয়া যায়, এবং একারণে। চক্ষুর্ঘয়ের মধ্য দিয়া জিহ্বা বাহির হইয়া পড়িতেছিল। সে আর স্থির থাকিতে পারিল না, জন্তুর মত সেই স্থান বাহিয়া উঠিবার চেষ্টা করিল। মাটি ধ্বসিল, পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করিয়া ভেড়ী পথে উঠিয়া দাঁড়াইয়া, আপনার গতি সংযত করিতে না পারিয়া, এই পার্শ্বের কলমকাটা পথ বাহিয়া,–মাভৈঃ মাভৈঃ গর্জন করিতে করিতে নামিয়া আসিয়া, গঙ্গার তীরে কর্দমের উপর পড়িয়া গেল; তাহার, সম্মুখের হস্ত দুইখানি কর্দমে, সে পশুর মত তাঁহার, যশোবতীর, দিকে চাহিয়া স্থির। যশোবতী এখন বিমূঢ়, সমস্ত দেহ যেন তাঁহার বক্ষে আশ্রয় করিয়াছে, দুই হস্ত সেখানে স্থাপন করত লজ্জায়, শঙ্কায়, ত্রাসে সঙ্কুচিত হইয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। এবম্প্রকার অঘটনের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। বৈজুনাথ কাদা ভাঙ্গিয়া পশুর মতই থপ থপ করিয়া আসিতেছে, লোলজিহ্বায় জোনাকির আলো। ভূততাড়িতের মত তিনি পলাইতে উদ্যতা হইলেন।
বৈজুনাথ উঠিয়া এক লম্ফে আসিয়া তাঁহার গামছাপ্রান্ত আকর্ষণ করিল, তিনি অনিচ্ছাসত্ত্বে ঘুরিয়া গেলেন; সে অতর্কিতে তাঁহার একটি হাত ধরিল এবং নিজের হস্তের গামছা মাটিতে ফেলিয়া একটি লাথি মারিয়া–কেননা এনীচ কার্যে সম্ভবত বসুন্ধরা বাধাদান করিয়াছিলেন–ইহার পরক্ষণেই যশোবতীর সুন্দর রূপলেখা, নশ্বর দেহখানি দুই হস্তে তুলিয়া ধরিল।
যশোবতী প্রথমত আপনকার বিবস্ত্র অবস্থার নিমিত্ত, দ্বিতীয়ত যে তাঁহার দেহ পরপুরুষের বন্ধনে উপলব্ধি করিয়া এককালে লজ্জায়, ক্ষোভে, নিশ্চয় দুঃখে, নিশ্চিত ব্যথায়, কাতরতায়–নিৰ্বাপিত, বিন্দুমাত্র, চেতনাহীন হইয়া গিয়াছিলেন। সহসা স্বীয় দেহের মধ্যে অসম্ভব বিস্ফোরণের শব্দ শুনিতে। পাওয়া মাত্রই, পলকেই এ দুযোগময়ী অজ্ঞানতা নিশ্চিহ্ন হয়, এবং ক্রমে অধীরতায়, ক্রোধে, অপমানে, মুখ দিয়া দেখিতে, কান দিয়া বলিতে, নাসিকা দ্বারা শুনিতে চাহিলেন।
বৈজুনাথ মুখোনি তুলিয়া মুখোনি এমত ভাবে ঘুরাইল যেন সে আপনার দৃষ্টিপথকে পরিষ্কার করিয়া লইতেছে, যেহেতু তাহার ভ্রম হইয়াছিল মনে হয়, কেননা সে, যশোবতীর অনাবৃত দেহে, স্পষ্টতই শুভ্র। সুদীর্ঘ উপবীত দেখিয়াছিল, যেমন পান্না ভৈরবীর অঙ্গে সে ইতঃপূৰ্বে দেখিয়াছে–ফলে সে বড় দ্বিধায় পড়িল, একদা আপন মনে প্রশ্ন করিল, এই কি কনে বউর সাধনা…? এবং এ-প্রশ্নের কি যে উত্তর দিয়াছিল সে-ই জানে। তবে একথা সত্য যে তাহার মন পূৰ্ব্ব হইতেই পৃথক হয়, কেননা সে বলিয়া চলিয়াছে, “এখন তুমি শব, শব ছাড়া কিছু নও।” এ হেন নেতি-বিচারসম্মত উক্তিতে সে আপনাকেই সম্মোহিত করিবার অবশ্যই চেষ্টা করিতেছিল, যেরূপে কালিনী কন্যার সম্মুখে ভক্ত শূন্যতার মন্ত্র উচ্চারণ করে, আপনার দেহস্থিত অস্থিমালা ঘুরায়।
যশোবতী রাবণ কর্তৃক ধৃত সীতার মতই আর্তনাদ করিয়া উঠিলেন, এবং যুগপৎ এই নীচকুলোদ্ভবকে আঁচড়াইতে চেষ্টা এবং দংশন করিবার জন্য মরীয়া হইয়া উঠিলেন, প্রচণ্ড দুর্ধর্ষ বৈজুনাথ ক্রমাগতই তাঁহাকে নিবৃত্ত করিতেছিল এবং এ সময় তিনি কৰ্ত্তা কৰ্ত্তা’ বলিয়া এত উচ্চৈঃস্বরে ডাকিয়াছিলেন যে, নিশাচর পক্ষিকুল ইহাতে বিমোহিত হয়।
“কনে বউ, কনে বউ শব হয়ে থাক।…মিছাই রাত কাটাও হে…মিছাই…মা আমার কোম্পানী, তিনি বলেছে গো, তুমার মরণ নাই; মেয়েদের মরণ নাই…”