এখন যশোবতী হস্তধৃত কাষ্ঠখণ্ড গঙ্গায় নিক্ষেপ করিলেন। কাষ্ঠের অন্তস্থিত অগ্নি সশব্দে নিৰ্বাপিত হইল।
ক্রমে তাঁহার জ্ঞানের সঞ্চার হয়, ত্বরিতে নতজানু হইয়া বসিয়া দেখিলেন, চণ্ডাল বৈজুনাথ শুইয়া পড়িয়া ছটফট করিতেছে, নিজের কাঁধের একস্থানে বুলাইতে বুলাইতে বলিতেছে, “তোমার তরে কনে বউ…” মাটি হইতে মুখ না তুলিয়াই সে এই কথা বলিয়াছিল।
যশোবতী ঘৃণায় মুখ ফিরাইয়া ক্রমে ক্রমে দেখিলেন, বৃদ্ধের আপনার মস্তক অতিক্রম করিয়া হস্ত দুইখানি বিস্তৃত, দেহ যেন একটি রেখাবৎ, বসন সিক্ত, স্বামীর দুরদৃষ্ট দর্শনে পাগলিনীর মত ছুটিতে, যাইতে, লজ্জিত হইয়া ক্ষণকাল দাঁড়াইলেন। পরক্ষণেই চীৎকার করিয়া উঠিলেন। অসহায় ক্রন্দনরোলে ত্রিভুবন বিদীর্ণ হয়। পৃথিবী আর একবার দুঃখময়ী হইল। বিদ্যুৎবেগে স্বামীর নিকট গিয়া, তাঁহার হস্ত নিজ বক্ষে ধারণ করিয়া রোদন করিতে লাগিলেন, কখনও কখন ‘ঠাকুর’ এই বাক্য শুধুমাত্র উচ্চারণ করিয়াছিলেন।
“কৰ্ত্তা কথা কও গো” বলিয়া তিনি গঙ্গার বেলাতট চাপড়াইয়া কাঁদিতে লাগিলেন। সীতারাম এখন দেহমাত্র। যশোবতী কোনরূপে তাঁহার ঊর্ধ্বাঙ্গ আপনার উরুর উপরে স্থাপন করিয়া অঞ্চলপ্রান্ত দিয়া মুখ মুছাইতে মুছাইতে স্বরভঙ্গ কণ্ঠে নানা কথা বলিলেন। “কৰ্ত্তা কোথা গেলে গো, আমাকে ফেলে…”
মধ্যে মধ্যে “কথা কও কথা কও”…এই অনুরোধ বাক্য পৃথিবীকে মায়া বশীভূত করে। কালক্রমে তাঁহার ধারণা জন্মিল ইনি, বৃদ্ধ, প্রাণহীন নহেন, অচৈতন্য মাত্র। এবং এই বোধে, তাঁহার সহজ জ্ঞান ফিরিয়া আসিল, মুহূর্তেই তিনি আপনার বস্ত্রদ্বারা গাত্র মুছাইয়া, অনন্তর, স্বামীদেহ যতনে তুলিবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করিতে লাগিলেন। পুনঃপুনঃ বলসঞ্চয়হেতু, গভীর নিঃশ্বাস লইলেন; আপনাকে প্রস্তুত করিবার নিমিত্ত জিহ্বা নোলকে ঠেকিল। তথাপি এ অধ্যবসায় বিফল হয়।
৬. যশোবতী বিমূঢ় হইয়া গঙ্গার দিকে চাহিলেন
যশোবতী বিমূঢ় হইয়া গঙ্গার দিকে চাহিলেন। এক্ষেত্রে কি করিবেন তাহা মনে আসিলেও তিনি সঙ্কুচিত হইয়াছিলেন, তাঁহার পদনখগুলি চঞ্চল।
বৈজুনাথের কাষ্ঠের আঘাতপ্রসূত জ্বালাভাব তখনও ছিল, ভাগ্যশঃ কাষ্ঠের উপর ভস্ম আবৃত এবং তাহার একটি স্থানেই অগ্নি প্রজ্বলিত থাকার ফলে বিশেষ কিছু আহত করিতে সক্ষম হয় নাই। তথাপি সে কোনক্রমে উঠিয়া দাঁড়াইয়া স্বলিত পদে দম্পতির নিকট আসিয়া দাঁড়াইয়া কহিল–”এ তোমার স্বামী,…”
মুখমণ্ডল আন্দোলিত করিয়া তুলিয়া যশোবতী কহিলেন–”হ্যাঁ।”
বৈজুনাথ কহিল-”সরো গো।”
যশোবতী দৃঢ়তার সহিত আপন স্বামীকে আঁকড়াইয়া রহিলেন।
“লাও সর কনে বউ–উঠ, দিয়ে আসি।”
এ অনুরোধে যখন যশোবতীর ভাবান্তর হইল না, তখন বৈজুনাথ ঝটিতি দেহটি তুলিয়া লইল, চণ্ডালের হস্তস্পর্শে ব্রাহ্মণকন্যা ক্ষিপ্রবেগে জাতিসম্রম রক্ষা মানসে সরিয়া গিয়াছিলেন। তিনি মাটি ছাড়িয়া সত্বর উঠিয়া স্বামীর জন্য পাগল হইয়া কাড়িয়া লইতে গেলেন। চণ্ডালের অঙ্গস্পর্শ হইবামাত্র তিনি যখন ইতঃস্তত করিতেছিলেন, তখন চণ্ডাল সীতারামের মস্তক দ্বারা তাঁহাকে ঠেলা দিয়া সীতারামকে গালাগাল দিতে দিতে অগ্রসর হইল।
বৈজুনাথ লম্বা লম্বা পায় চলিতেছে। তিনি আধো ছুটন্ত, স্বামীর মাথাটা ঝুলিয়া পড়িয়াছে দেখিয়া তিনি ব্যথিত হইয়া অনেক কথাই বলিতেছিলেন। কখন বা মস্তকটি তুলিয়া ধরিবার ইচ্ছা ব্যগ্র হইয়াছিল!
বৈজুনাথ সীতারামকে শোয়াইয়া দিয়া হাঁফ ছাড়িয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “লাও ঘর কর!”
যশোবতী তাহার দিকে এখন কঠিনভাবে কটাক্ষপাত করিলেন, আর সে নির্বোধের মত স্থানত্যাগ করিতে উদ্যত হয়।
চণ্ডাল বৈজুনাথ কিছুকাল সম্মুখের সংস্থানটির বিদ্যমান আলো অন্ধকারের উপর নিজের মুখোনি বুলাইয়া, ফিরিয়া দাঁড়াইয়া, আপনার স্তব্ধতাকে এই শ্মশানে শায়িত দেখিয়া একটি পা বাড়াইল; সে, সম্বিৎ, নিশ্চয়ই লাভ করে। তাহার পৃষ্ঠস্থিত আঘাতের চিহ্ন, এ হেন চন্দ্রালোকে, যশোবতীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। একারণে, তর্দশনেই তিনি এককালে ম্লান এবং গম্ভীর হইয়াছিলেন।
বৈজুনাথ, আপনার হৃতস্তব্ধতা আবার পাইয়া, ঘুরিয়া, তাঁহাকে তদবস্থায় দেখিয়া অবাক হয়, নিঃশ্বাস লইয়া কহিল, “কনে বউ, বেগোড় বুঝ দিও না গো।” বলিয়াই সে প্রস্থান করিল।
যশোবতী তাহার বাক্যে কর্ণপাত করিলেন না, কেননা শ্মশান আর শবাসনে নাই, ইহা খাড়া–এ সত্য হইতে তিনি ধীর নিঃশ্বাস লইয়াছিলেন। নিজেই আপনার অশ্রুজলের উষ্ণতা অনুভব করত রোদন করিলেন, এমত সময় দৃষ্টিপথের উপর দিয়া একটি শুষ্কপত্র–শুষ্কপত্রের মধ্যে যেমন অভিজ্ঞতা, অভিজ্ঞতার মধ্যে যেমন স্বীকারোক্তি, স্বীকারোক্তির মধ্যে যেমন বেদনা, বেদনার মধ্যে যেমন আলিঙ্গন, আলিঙ্গনের মধ্যে যেমন বুদ্বুদ, একটি শুষ্কপত্র খরখর খর করিয়া চলিয়া গেল। তিনি স্বামীর দিকে চাহিলেন, বৃদ্ধকে সিক্ত দেখিয়া, কর্দমাক্ত দেখিয়া, তাঁহার কৰ্ত্তব্যবোধ আসিল; সুতরাং বৃদ্ধের নোংরা। বস্ত্র কারণ বৃদ্ধ অসংযত হন, খুলিয়া তাঁহার সর্বাঙ্গ সযত্নে সংস্কার করিয়া, একটি অন্য কটে’ পরাইয়া। দিলেন, তদনন্তর বস্ত্র ধৌত করিবার জন্য মনস্থির করিতে প্রস্তুত হইলেন।