পরোপকারে দৃঢ়সংকল্প বৈজুনাথ বৃদ্ধকে লইয়া বিশেষ সন্তর্পণে গঙ্গায় পদক্ষেপ করিতে করিতে নামিতে লাগিল। তাহার কণ্ঠে বার বার ধ্বনিত হইল, “পাপ আবার কি–পাপ শালা…তুমি শালা যত নষ্টের গোড়া, হ্যাঁ…দোসর লাও শালা বুড়ো–” বলিতে বলিতে সে কিছুটা গঙ্গায় নামিল। একবার মুমূর্ষ দেহটি দক্ষিণে বামে আন্দোলিত করে। ইহার একটি পা গঙ্গাস্রোতে, অন্যদিকে হস্ত গঙ্গার জলস্পর্শ করিয়াছে। বৈজুনাথের ঊরু জলমগ্ন, সে পা টিপিয়া টিপিয়া অগ্রসর হইতেছিল।
অচৈতন্য সীতারামের হস্ত সহসা যেন দৈববলে, মন্ত্রবলে বৈজুনাথকে হতচকিত করিয়া তাহার কণ্ঠ আবেষ্টন করিল। সে টলিয়া গেল, তাহার পর সম্বিৎ ফিরিয়া পাইয়া কহিল, “ওরে শালা বিলে দোসরঘোর” বলিয়া আপনার চিবুক দ্বারা আঘাত করিল, দুইহস্ত প্রসারিত করিয়া দেহটি দূরে সরাইল, তথাপি বন্ধন মুক্ত হইল না। সে পদদ্বয় হইতে ডান হাতখানি সরাইয়া লইতে বৃদ্ধের দেহ জলে পড়িল। তথাপি আলিঙ্গন মুক্ত হইল না–পুনৰ্ব্বার চেষ্টা করিল; তাহার পর আস্তে আস্তে কহিল, “কি রে বাবা, আমায় দোসর লিবি নাকি” সঙ্গে সঙ্গেই বৈজুনাথ ভীত।
বৃদ্ধকে আর কোলে লওয়ার কথা তাহার স্মরণ হইল না, সে দুই হস্ত ছাড়িয়া পালাইবার চেষ্টা করিল। …বৃদ্ধ তাহার কণ্ঠে জগদ্দল হইয়া আছে। সে যেমত ভাঁড়ে বাঁধা নেউলের দশাপ্রাপ্ত হইল। গঙ্গার জল চোখে মুখে দিল এবং সিক্ত বৃদ্ধকে কোনক্রমে তীরে লইয়া উঠে।
সীতারামকে মাটিতে রাখিতেই দ্বি-খণ্ডিত লতার মত বৈজুকণ্ঠলগ্ন হস্তদ্বয় খসিয়া পড়িল। বৈজুনাথ অবাক হইয়া তাঁহার হাতের দিকে তাকাইল; এখন তাহার সাহস ফিরিয়াছে, দৌড়াইয়া আপনার আড়ায় ঢুকিয়া মদ্য পান করিয়া কিছু রঞ্জু ও ছোট একটি কলস হস্তে এখানে উপস্থিত হইল। বৃদ্ধের হাত দুটি একত্রিত করিয়া বাঁধিবার কালে বারবার সে পিছনে তাকাইয়াছিল।
.
যশোবতীর হঠাৎ নিদ্রাভঙ্গ হয়, উঠিয়াই তিনি কবরী রচনার জন্য বেণীতে হস্তদ্বয় প্রদান করিয়া পক্ষীর মত মুখোনি ঘুরাইতেই, ছিন্ন চাঁদোয়ার প্রতি লক্ষ্য পড়িল, হাই মুখে রহিয়া গেল, আর যে, চাঁদোয়া কিছুমাত্র উত্তোলন করিতেই, যখন দেখিলেন যে সেই প্রিয় বৃদ্ধ দেহটি নাই তখন নির্বোধের মত হস্ত দিয়া বিছানা অনুভব করিলেন। চাঁদোয়া পড়িল, তিনি তাহা ছিন্ন করিয়া যখন দেখিলেন কেহ নাই, তখন তাঁহার মস্তক শুষ্ক পাতার মত কাঁপিল। বুড়ো বলিয়া তারস্বরে চীৎকার করিয়াই জিব কাটিলেন। নিজের উন্মুক্ত মৎস্যচিহ্ন ঊরুদেশে আপনাকে উদ্বুদ্ধ করিবার নিমিত্ত চিমটি কাটিতে লাগিলেন, আর যে তৎকালে হৃতবৎসা গাভী যেমত চীৎকার করে সেইরূপ তারস্বরে গগন বিদীর্ণ করিলেন—”কৰ্ত্তা -কৰ্ত্তা- কৰ্ত্তা।”
.
যশোবতী কোনদিকে খুঁজিবেন! বিভ্রান্তভাবে দৌড়াইলেন, স্রোত পথরোধ করে অন্যদিকে নিঃসঙ্গ নৌকা, অন্যদিকে ভেড়ীপথের লতাপাতা আগাছা পথরোধ করিল। তাঁহার পায়ে লতা জড়াইয়া গেল, তিনি বৈজুনাথের আড়ার দিকে গতি ফিরাইলেন, খানিক পথ আসিতেই তিনি স্তম্ভিত, শাসহীন, দেখিলেন–ব্যগ্র, ব্যস্ত বৈজুনাথ স্বামীর হস্তে রঞ্জু বাঁধিতেছে; কলসটি যেমন বা ভূতগ্রস্ত। কি যে করা উচিত তাহা তিনি ভাবিয়া পাইলেন না। আপনার তর্জ্জনী গণ্ডদেশে স্থাপিত হইল। হৃদ্বয় সচাপশরযোজিত ধনুলতার মত বক্র, নয়নযুগল স্ফীত।
বৈজুনাথের দেহ চঞ্চল, সে ক্রমাগতই রোমাঞ্চিত; অথচ কোনক্রমেই তাঁহার আগমন উপলব্ধি করিতে পারে নাই, এ কারণে যে, তাহার কণ্ঠ হইতে অনর্গল কটুক্তি আক্রোশ বাহির হইতেছিল, যথা– “দোসর শালা।”
যন্ত্রচালিতের মত দু’এক পা অগ্রসর হইয়া যশোবতী অতর্কিতে দৌড়াইয়া গিয়া নিকটস্থ ভস্মপরিবৃত একখানি অর্ধদগ্ধ কাষ্ঠ হস্তে তুলিয়া লইয়া উন্মাদিনীর মত ছুটিয়া আসিয়া বৈজুনাথকে আঘাত করিলেন। বৈজুনাথের পিঠ বাঁকিল দড়িসমেত হাত কিছু দূরে গেল, যশোবতী থামিলেন না। বৈজুনাথ কোন অঙ্গ দিয়া নিজেকে রক্ষা করিবে ভাবিয়া পাইতেছিল না, পশুর মত চীৎকার করিতে করিতে ধরাশায়ী হইল।
.
দেবী প্রতিমার ভঙ্গীতে দণ্ডায়মানা যশোবতী, হস্তে কাষ্ঠ খণ্ড। পায়ে ছিন্নলতা চমকিত, ক্রোধে জ্ঞানরহিত-অপরিসীম ক্রোধ দেহের মধ্যে শব্দ তরঙ্গ যেমত বা কম্পমান, সহসা তাঁহার কি এক রূপান্তর হয়।
ক্রোধ হইতে কাম সঞ্জাত (!) হইল, দিকসকল তমসাচ্ছন্ন, তিনি এহেন ঘনঘটায় একাকিনী, আপনার সুদীর্ঘ অন্তরীক্ষে প্রবেশ করিতে সাহসী হইলেন, আপনার আয়ত্তের বহির্ভূত হইলেন। পলাশের উষ্ণতা এখানে নিঃশেষিত বিকারগ্রস্ত হইবেক, বহুধা ধমনীর মধ্যে কখনও সুঙ্গ হাস্য খিলখিল করিয়া উঠিল, এখন স্ফীত হয়; সুন্দর সূক্ষ্ম ভঙ্গিমায় ঊর্ধ্বে চিত্তশরীরে উঠিয়া সৌরজগতে পথ হারাইল। নির্বিকার সমাধি–অল্পকাল পরে, ক্রমে বিস্ময় আসিল, তথাপি মনে হয় তিনি যেমত বা সনাথ আছেন এবং এরূপ অনুভবে, লোকচক্ষুর সম্মুখে তিনি যেমন বা বিবসনা হইয়া গেলেন, ব্ৰীড়াবনত মুখে শঙ্কায় প্রমাদ গণিলেন, কেননা চতুঃষষ্ঠি প্রকার লক্ষণসমূহ দেখা দেয়, কেননা মৎস্যচিহ্ন উরুদেশ সিক্ত এবং আপন জিহ্বা দংশন করত দক্ষিণ পা বাম পদের পার্শ্বে স্থাপিত করিয়া কিয়ৎকাল নির্জীব অবস্থায় রহিলেন। তাঁহার পিছনে, গঙ্গায়, কারণ সলিলে স্রোত ছিল। …আঃ রমণী! আঃ আশ্চর্য! যে তুমি দুটি অব্যক্তকে একই দেহে–যে দেহে, সূক্ষ্মতা, আলো পায়, ধারণ কর। এক হৃদয়ে অন্য জরায়ুতে। তুমি সেই লীলা সহচরী।