এই দৃশ্যকাব্য তিনি যেন পান করিতেছিলেন, কিছুকাল এইভাবে অতিবাহিত, পরে আপনার দেহভার অনুভব হয়। চণ্ডালের সহিত সাক্ষাৎকার অতীব আশ্চৰ্য্য, শরীর তদবধি সন্তপ্ত, তিনি জল লইয়া চক্ষু কর্ণে এবং আপনার পদযুগের বৃদ্ধা অঙ্গুষ্ঠার উপর দিয়া, অতি বিস্ময়কর কথা যে, তিনি। আপনার বিকলাঙ্গ ছায়ার উপর জল সিঞ্চিত করিয়া, এখন আলগোচে কিঞ্চিৎ পান করিলেন। শীতল জলের স্পর্শে বুঝিয়াছিলেন, মস্তক শিরঘূর্ণনে উপদ্রুত, যদিচ শিরঘূর্ণন এখনও প্রশমিত হয় নাই, তথাপি তদবস্থায় আপনার চমৎকার সুডৌল মৃণালভুজদ্বারা জন্মান্তরের স্বামীকণ্ঠ, মহতী গভীর হৃদয়ে আলিঙ্গন করিয়াছিলেন।
.
সপ্তর্ষি মণ্ডলের অনতিপূৰ্ব্বে চন্দ্র প্রতিভাত।
অলৌকিক দম্পতি ঘুমে নিশ্চিহ্ন, খুব ধীরে শয্যার খড় বায়ু-সঞ্চালিত। ইহা শ্মশানভূমি, এখানে ঘুমন্তরা আনীত হয়, এখানেও ঘুম আসে; দুজনেই স্বামী এবং স্ত্রী ঘুমে দৃষ্টিরহিত। এক পার্শ্বে মৃতকল্প বৃদ্ধ, অন্যপার্শ্বে পরিশ্রান্ত যশোবতী, ঘুমঘোরে অনেকখানি শয্যাচ্যুত হইয়া বাহিরে, হিমক্লিষ্ট ভূমির উপরে আসিয়া পড়িয়াছিলেন, দেহ ত্রিভঙ্গ, কুণ্ডলীকৃত নহে, কর্কশ ধ্বনি ব্যক্ত, এবং তাঁহার অর্ধ উন্মুক্ত মুখ বহিয়া লালা নিঃসৃতবান। এমত অবস্থায় তাঁহার নিঃশ্বাস-আলোড়িত বক্ষের উপর একটি ছায়া পড়িল।
‘ভাবের ঘরের চোর’ এই উক্তিও শোনা গেল।
হঠাৎ ছায়া উধাও; কেননা যাহার ছায়া সে কিঞ্চিৎ দূরে সরিয়া যায়। এ ছায়া চণ্ডালের, চণ্ডাল এখনও সম্ভবত নিশ্চেষ্ট হয় নাই, ধৃষ্টতা এখনও প্রধুমিত হইতেছিল; বৈজুনাথের সহসা অপসরণের কারণ এই যে, সে এক অদ্ভুত কিছু এই সান্নিধ্যের মধ্যে দেখে।
একদা যশোবতীর বিবাহের পূর্বে, এক রাত্রে সে ভেড়ীপথ হইতে অন্তর্জলীসুত্রে আনীত, সীতারামকে কেন্দ্র করিয়া কীৰ্ত্তন পরিক্রমণ দেখিয়াছিল; চক্রাকারে ভ্রমণকে মাঝে মাঝে শ্মশানের। চিতার আলোকচ্ছটা উল্লেখ করিতেছিল, আর কুয়াশাবৃত চন্দ্রালোকে যাহা প্রহেলিকা। মন্দিরগাত্রে। রাশমণ্ডলের আলেখ্যর ন্যায় সমস্ত সংস্থান, নেহাৎ সহজ হইলেও উহা অতিকায়, উহা ভয়প্রদ। সেই অনুভূতির কথা মনে করিয়া বৈজুনাথ এখন শুষ্ক, দুৰ্বল; তাহার কেমন যেন মনে হইল সে কীৰ্ত্তনের চক্রকে ভেদ করিয়া আসিয়াছে; সত্যই, সে শঙ্কিতচিত্তে আপনার চারিপার্শ্বে লক্ষ্য করিল। সত্যই সেই রহস্যময়, মস্তক আবৃত, শীতকুণ্ঠিত লোকগুলি ভ্রাম্যমাণ কিনা!
পুনরায় একই মনোভাবে ঘুমন্ত যুগলমূর্তি দর্শনে সে নিঃসন্দেহে হতজ্ঞান, সম্মুখে রাশমণ্ডলের প্রাণস্বরূপ কেন্দ্র চারিভিতে আলোক উদ্ভাসিত, আর মধ্যে চাঁদোয়ার অন্ধকার, বৃদ্ধ আবছায়া, যশোবতী প্রতীয়মানা; বৈজুনাথ সম্যক উপলব্ধি করে যে তাহার শক্তি অপহৃত হইয়াছে, ক্ষমতা বাষ্পময়, পদদ্বয় রোগীর ন্যায় কম্পিত। কিন্তু তাহার পূর্ধ্বমুহূর্তের চিন্তার আলোড়ন এখন ছিল; সে একদা শুনিল, তাহার আপনার দেহমধ্যে উন্মত্ত মাভৈঃ’ ধ্বনি। ক্রমাগত একই ধ্বনি শুনিতে শুনিতে তাহার চক্ষু সঙ্কীর্ণ হইয়া উঠে, এবং স্বীয় মৃদু হাস্যে সমস্ত সকল বিড়ম্বনাকে উচ্ছেদ করত কহিল, “হা রে ভাবের ঘরের চোর। কনে বউ, এই ত দেমাক, টিকারী, চৈত্রের দুপুরের ক্ষেতের মত পড়ে আছে, রহো রহো হে হে মরণের ছাঁচ হে, মিথ্যেবাদী আমি! সতী হব লোকমান্যি হব…সতী রাণী হে, আমি জাত চাঁড়াল আকাশ বাতাস ভালবাসি না, গঙ্গা লয়, ধুক ধুক করা নরদেহ বড় ভালবাসি…আমি…” এ সকল কথা যখন সে বলে, তখন তাহার ছায়া পুনরায় শ্রীঅঙ্গের উপর বিস্তৃত হয়। আমি’ বলার পরক্ষণেই তাহার ছায়া অদৃশ্য।
বৈজুনাথ চাঁদোয়ার একপার্শ্বে এখন, খড় চড় চড় করিয়া উঠিল, বৃদ্ধ সীতারামকে আচম্বিতে দুই হাতে তুলিয়া দাঁড়াইবার কালে, তাহার একটি হাত যশোবতীর কোমল অঙ্গ স্পর্শ হয়। এইভাবে বৃদ্ধকে নির্বোধের মত তুলিয়া লওয়াতে চাঁদোয়ায় বৃদ্ধদেহটি আবৃত হইয়া পড়িয়া সাক্ষাৎ বিঘ্ন উৎপাদন করে, বেচারী অশীতিপর মরণোম্মুখ বৃদ্ধের প্রাণান্ত আকুল দুঃখধ্বনি একবার মাত্র শুত হয়। তাহার পর নির্বিকার! ইহাতে চণ্ডাল, সত্যই বিমূঢ়, স্থির; সে যেন চন্দ্রালোককে জিজ্ঞাসা করিল, সে যেন শ্মশানভূমিকে জিজ্ঞাসা করিল, সে যেন পারিপার্শ্বিক অন্ধকার সকলকে প্রশ্ন করিলকি ব্যাপার? কিন্তু পরক্ষণেই সে কৃতনিশ্চয়, বদ্ধপরিকর, চাঁদোয়া-আবৃত অবস্থায় বৃদ্ধকে দক্ষিণে কভু বামে আন্দোলিত করিল, দ্রুত কার্য সম্পাদন নিমিত্ত চণ্ডাল হিতাহিত কাণ্ডজ্ঞানরহিত; সীতারামের সূত্রবৎ দেহ এমত মনে হয় যেন জালে পড়িয়াছে; শত চেষ্টাতেও বৈজুনাথ কোনরূপে তাহাকে মুক্ত করিতে সমর্থ নহে। কখন মহা আক্রোশে দাঁত দিয়া চাঁদোয়ার কাপড় ধরিল, কখনও বা চুপ কখনও বা খুঁটিতে পদাঘাত করিল; পদাঘাত করিতেই হাঁড়িকুড়ি লণ্ডভণ্ড ছত্রাকার। বৈজুনাথ দেহ লইয়া অন্তর্ধান করিল।
এই শব্দে যশোবতীর ত্বক, সূক্ষ্মতা জাগ্রত হইল সত্য কিন্তু গভীর নিদ্রা ভঙ্গ হইল না। তিনি অভিভূত অবস্থায় গাত্রবস্তু আপনার শরীরে আচ্ছাদিত করিয়া পার্শ্ব পরিবর্তন করিলেন। নববধুর প্রাণ, জীবনঅভিলাষী দুদ্ধর্ষ চণ্ডাল আপনার কার্যসিদ্ধি নিমিত্ত দ্রুতগ হইল। সীতারামের পদদ্বয় এবং বামহস্ত ভৌতিকভাবে আন্দোলিত, ঘর্মাক্ত চণ্ডাল দাঁত দিয়া রজ্জুবন্ধন ছিন্ন করিয়া পলায়ন করিবার পূৰ্ব্বে যশোবতাঁকে দেখিয়া লইবার ইচ্ছা করিল, কিন্তু তাহা সম্ভবপর হয় নাই কারণ চাঁদোয়া ছিঁড়িয়া যবনিকার সৃষ্টি করিয়াছিল। অভাগিনী তখনও ঘুমে অচেতন। বৈজুনাথ বৃদ্ধকে লইয়া ক্ষিপ্রবেগে ক্রমশঃ ঢালুতীরে নামিয়া গেল।