অন্যপক্ষ এতাবৎ, সূক্ষ্ম যশোবতী, নিম্নে, নিকটে, আপন ইহকাল দিয়া স্বামীর অস্তিত্ব-অভিজ্ঞান সকল দেখিয়া লইতে কৃতনিশ্চয়; ফলে এই হয় ধ্রুব যে, বাগ্মী চণ্ডালের অজস্র ধ্বনিপ্রবাহ তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করে নাই; শুনিতেন যদি, তাহা হইলেও, তাঁহার কোনই বিচ্যুতি ঘটিত না, তাঁহার সঙ্কল্পের নিকট উহা বালখিল্য উচ্ছাস পরম্পরা, যাহাকে নিমেষেই, ধরিত্রীপৃষ্ঠের বারিপাত হেতু ক্ষেত্রের অলীক ঝরণা পরাস্ত করিতে এক লহমা, তথাপি তাঁহার একথা মনে হইলেও হইতে পারে, যে, ইহা কি শ্মশান? বীজ বপন করিলে যথার্থই এখানে কি অঙ্কুর দেখা দেয় না!
বৈজুনাথ হরিণগতি সম্বরণ করত চকিতে ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া অব্যর্থ কণ্ঠে বলিল, “তোমাকে আমি মরতে দিব না হে”,–পুনরায় দ্রুত পাশ হাঁটিয়া কহিল, “পারতুম যদি, তোমায় ছুঁয়ে দিতুম গো কনে বউ।”
এবম্প্রকার ভাষায় যশোবতীর দেহ, শিখা যেমত, ভ্রমর যেমত, পদ্মপত্র যেমত, তড়িৎ প্রবাহ যেমত, অতীব চঞ্চল, আপনার মস্তক সঞ্চালন করিয়া অন্তর্মুখী হইতেই হস্তধৃত কাজললতা মাটিতে খসিল। তিনি, ইহা কি সত্য, সম্মোহিতা হইলেন।
বৈজুনাথ যশোবতীর এ বৈলক্ষণ্য অনুধাবন করে নাই, সে উদ্দীপ্ত, সে আপনার কথা সাজাইতে ব্যস্ত, “হ্যাঁ গো, তোমার সত্যি সত্যি বিয়ে হয়েছে, না সেটা স্বপ্ন…কে জানে বাপু.আমার কেমন আঁট নাই…মনে হয় দশ রাত জাগা…কখন কোথায় মনে লেয় না, কখন না থাকলে কোথায় সেটা নাই…মনে লেয় আমার গা-চাটা বয়েস…” বলিয়াই অতি সূক্ষ্মভাবে হাসিয়া নববধূর প্রতি দৃষ্টিপাত করিল।
যশোবতী পর্ব্বতছায়ার মত স্থির।
এতদ্দৃষ্টে, চণ্ডাল স্তম্ভিত, নিস্পৃহ; ইহার কিছুক্ষণ পরে সে কেমন এক ভাবের ভাবী হইয়া, ঘোর বশে মৃত্তিকা তুলিয়া করজোড়ে, চণ্ডাল বৈজুনাথ, সুন্দর প্রার্থনার কণ্ঠে বলিতে আরম্ভ করিল, “তোমায় মান্য করি কনে বউ, তুমি বামুনের মেয়ে আমার দোষ লিও না, তুমি একবার ভাব আমি খল কটু নই, তুমি হে গহনা ছুঁড়লে…আমি কিন্তুক সে মনা নই হে, তঞ্চক বঞ্চক…সত্যিই যদি, তাহলে লিয়ে ফেরার হতুম…” বলিয়া সে অল্পকাল থামিল, মৃত্তিকারাশি ঝরা শব্দ শোনা গেল।
সহসা ঐ শান্ত একটানা শব্দ ভেদ করিয়া বিদ্রুপাত্মক এক ঘোষণা হইল, “মাতাল বজ্জাত।” ইহা যশোবতী বলিয়াছিলেন।
বৈজুনাথ যুগপৎ, অন্যরূপে ইহার প্রতিধ্বনি করিল; মৃত্তিকা সকল সদম্ভে ফেলিয়া, আপনার গণ্ডে বার বার চপেটাঘাত করত কহিল, “হা কপাল, কপাল, চেনা মানুষকে চিনতে লারলে গো, চোখ কালো বলে কি দিনমান আঁধার হবে হে? মদ! বলি গল্প শোন, মদ আমাকে সৎ করেছে তাই না এতেক বললুম…মদকে দুষো না, মদের নাম প্রমোদন…মদ আমায় সংযম করে,…তোমাকে খোলাখুলি বললাম হে তারই জোরে…”
“তুমি যাবে না…”
“ওই গো ভাবের ঘরে চুরি,– এবং পরক্ষণেই মুখভঙ্গী সহকারে কহিল, “তুমি কি ভাবো ওই ঘাটের মড়া তুমার সোয়ামী…
“হ্যাঁ, স্বামী” যশোবতীর এই উত্তরে সমগ্র বিশ্বের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ছিল, এ স্বীকারোক্তির অখণ্ড তৈলধারাবৎ পতিভক্তিতে কাল বিমর্পিত হইল; স্পন্দন গতি যাবতীয় দ্রব্যসকলের আর প্রয়োজন নাই–চন্দ্র সূৰ্য্য অচিরাৎ দায়মুক্ত।
বৈজুনাথ একমাত্র জীব যে আপনার মাথা তুলিতে এখনও সমর্থ, সে যারপরনাই শক্তিতে ফুকার দিয়া উঠিল, “মিছা মিছাই মিথ্যা হে কঠিন মিথ্যা গো” সমস্ত জীব জগতের হাহাকার তাহার এই আৰ্তনাদ, যাহা দিগ্বিদিকে মাথা ঠুকিয়া ফিরিল; অতঃপর সে দন্তঘর্ষণ করিতে করিতে ব্যক্ত করে, “আ হা…মানুষ এক অচিন গাছ, মানুষ বড় ডাগর জীব গো, কাঠের বিড়াল দিয়া ইন্দুর ধরে…..তাই না?” বলিয়া হা-হা রবে হাস্য করিয়া আবার জলদগম্ভীর কণ্ঠে কহিল, “মিথ্যা।”
তাহার, বৈজুনাথের, বাক্যশব্দ যেমন বা সূৰ্য্যকে নাম ধরিয়া ডাকিল, ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকারে সময় আরূঢ় হইয়া উদ্দাম, কৰ্ম্ম প্রতিশ্রুত হইয়া আবর্তিত হইল।
বৈজুনাথ আর বাক্যক্ষয় করিল না, সে শ্লথ পদবিক্ষেপে অগ্রসর হয়; সে যেমন বা কিয়দংশে মর্মাহত, চন্দ্রালোকে এত বড় মিথ্যার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না, ফলে তাহার মস্তক অবনত; একবার, সে মুখ ফিরাইয়া যশোবতাঁকে নিরীক্ষণ করে, দেখিল, তিনি তখনও তেমনভাবেই দণ্ডায়মানা।
.
যশোবতী ইদানীং একটি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করত, আত্মকেন্দ্রিক, এবং নিমেষেই সহজ, এবং অতি দ্রুত আপনার অঙ্গাভরণ সংযত বিন্যস্ত করিয়া, যেন বা দৌড়াইয়া, স্বামীর নিকট প্রত্যাবর্তন করিলেন। অর্ধ-আস্বাদিত আলিঙ্গন, চাঁদোয়ার ছোট অন্ধকারে, যাহা তিনি রাখিয়া সম্মুখ সমরে নামিয়াছিলেন তাহা সন্ধান করিতে এখন প্রয়াসী।
বৃদ্ধ সীতারাম তখনও কাঁদিতেছিলেন; ধীর বিলম্বিত লয়ে ক্রন্দনের ধারা শূন্যতায় উঠে নামে। যশোবতীর কেমন যেমন ভাবান্তর দেখা দিল, অবশ্য তাহা কয়েক মুহূর্তের জন্য, যদিও তিনি স্বামীর নিকটেই তথাপি আৰ্ত্ত ত্রাস আবিষ্ট রোরুদ্যমান বৃদ্ধের সযত্নে চক্ষু মুছাইবার মত স্নেহ তাঁহার মধ্য হইতে অন্তর্হিত; ভূতগ্রস্তের ন্যায় তিনি বসিয়া আছেন, কৃষ্ণপক্ষের শশিকলা যেরূপ ক্রমশঃ ক্ষীণা, তেমনই তিনি, যশোবতী, অঘোরচারী ঈপ্সিত অমাবস্যা তাঁহার ধমনীতে, রক্তে, পরিপ্লাবিত। কিছুকাল পূর্বের কথা, তামসিক চণ্ডালের রাজসিক কণ্ঠে সত্ত্বগুণ দীপ্ত বাক্যালাপ সম্ভবত তাঁহাকে, তাঁহার দেহ হইতে উচ্ছেদ করিয়াছিল, অবশ্যই সত্যই অমৃতবারি সেচন করে নাই। কখনও কখনও তাঁহার পলাতক মন দেহের সহিত সহজ বন্ধন লাভ কালে, তথা দেহের সহিত মন সংযুক্ত হইবার কালে, দেহ ওতপ্রোতভাবে দুলিয়াছিল; যশোবতী আপনার ললাটে, এ সময়, দক্ষিণ হস্ত প্রদান করিয়াছিলেন; তাহা কি করাঘাত সূত্রে অথবা স্বেদ মুছিবার কারণে তাহা জানিবার উপায় নাই–কেন না উহাতে কোন চিত্রসংজ্ঞা ছিল না। আর যে এইক্ষণেই তিনি মানসচক্ষে অবলোকন করেন, কাহারা যেমত বা এক মধুর গীত গাহিতে গাহিতে আসিতেছে, ইহাদের স্বেদ নাই, ইহারা ক্লান্ত নহে, যে গীতের মধ্যে আশা, যে আশার মধ্যে গোলাপের গন্ধ, যে গোলাপ গন্ধের মধ্যে বাল্যকাল, যে বাল্যকালের মধ্যে নিরীহতা, কাহার অন্তরীক্ষ আলেখ্য বহনে গর্বিত।