এবম্বিধ পাঠ, মরণোন্মুখ সীতারাম ব্যতীত আর আর যাঁহারা উপস্থিত তাঁহাদের মনে স্বতঃই নৈরাশ্যের সঞ্চার করিতেছিল। এই পরিবেশকে, গীতা ব্যাখ্যার গোঙানি ছাড়াও, এইক্ষণে অধিকতর ভয়ঙ্কর রহস্যময় করিয়াছিল নিকটবর্ত্তী চিতা নিৰ্বাপিত করার উদ্দেশ্যে জল নিক্ষেপের ফলে হস্ হস্ শব্দ, তৎসহ অনর্গল ধূমরাশি, যাহা বিচিত্র আকারে কুণ্ডলী সৃষ্টি করত এক এক সময়ে ইহাদের অতিক্রম। করিয়া অন্তর্হিত হইতেছিল। এবং অস্বস্তিকর নরবসার গন্ধ এখানে উদ্দাম। উপস্থিত সকলে, প্রতীয়মান সমস্ত কিছুর মধ্যে ভয়ঙ্কর চিরসত্যটি দেখিতে পাইতেছিল। কীৰ্ত্তনীয়ারা, তাহারা হতাশার চোখ দিয়া একটি গীত গাহিতেছিল। উপস্থিত সকলে মন দিয়া অনেক গীত শুনিতেছিল।
সীতারাম ও নিকটবর্ত্তী সকলকে পরিক্রমণ করিয়া একটি আধো-ঘুমন্ত কীৰ্ত্তনের দল মণ্ডলাকারে ঘুরিতেছে। দলটি ইহাদের পরিক্রমণ করিতে গঙ্গার উপর দিয়া যাইতে বাধ্য হইয়াছিল, যেহেতু সীতারামের পদদ্বয় গঙ্গা স্পর্শ করিয়া আছে। কীৰ্ত্তনের দল শ্রান্ত, তাহারা উৎসাহহীন, তাহারা ক্ষুধার্ত, তাহারা শিথিল গতিতে মনে হয় যেমন বা পলাইতেছে, তাহাদের নৌকার-গাত্রে-লাগা তরঙ্গরাজির। শব্দের মত ভয়প্রদ ভাঙা ভাঙা স্বরে নাম গান স্থানটিতে যথার্থই অন্ধকারের সৃষ্টি করিয়াছিল।
এই গোষ্ঠীর কিছু দূরে; জ্যোতিষী অনন্তহরি উবু হইয়া বসিয়া তামাক খাইতেছিলেন, তাঁহার মন। তখন সৌরজগতে বিচরণ করিতেছে, বিরাট অনৈসর্গিক জ্যোতির্মণ্ডলে তিনি যেন হারাইয়া গিয়াছেন। যেমন বা অশরীর হইয়া গিয়াছেন। তাঁহার হুঁকার গম্ভীর শব্দ এবং কভু বা হুঁকা হইতে মুখ সরাইয়া বিড় বিড় করিয়া কথা বলা, তাঁহারই পার্শ্বস্থিত অন্য এক ব্যক্তিকে ক্রমাগতই রোমাঞ্চিত করিতেছিল, এই ব্যক্তি লক্ষ্মীনারায়ণ। জ্যোতিষী অনন্তহরির ব্যবহারের কিঞ্চিত্র ইতর-বিশেষে লক্ষ্মীনারায়ণের ধৈর্যচ্যুতি এবং অতি উগ্র-আগ্রহের কারণ হইতেছিল, লক্ষ্মীনারায়ণ যেন বা শীতকাতর; তিনি বারম্বার উদগ্রীব হইয়া অনন্তহরির নিকটে মুখ সরাইয়া আনিতেছিলেন, এ কারণে যে, তাঁহার মনে হইতেছিল জ্যোতিষী তাঁহাকেই লক্ষ্য করিয়া কিছু বা বলিতেছেন; ইহাই সত্য যে তিনি কিছু শুনিবার আশায় বসিয়াছিলেন। এই স্থানে কাহার কণ্ঠস্বর আসিতেছিল, “হিঃ ইরে ডরে গেলে হে, হারে মন নিছুনি জান না গো, উ ঠাঁই মরণ নাই গো, লাও গো আঁট করি কলসটা ধর বটে লীচু করি হে, একঠাঁই শান্তি দাও হে”–এ স্বরগভীরে এতাবৎ মিলন অভিলাষী হরিণীর কণ্ঠ ছিল। এ স্বর প্রাণময়, কেননা শান্তি দাও’ কথাটি উচ্চারিত হয়।
একটি চিতা সাজান হইয়াছে, উপরে বর্তমান সত্য যেন বা স্মৃতি হইয়া দেখা দেয়, যেখানে নক্ষত্র নাই। চিতার নিকটে বসিয়া একটি ক্রন্দনরত বালক, সে লাউডগা-রুগ্ন সুন্দর, পিণ্ড হাতে করিয়া বসিয়া আছে, তথাপি তাহার ক্রন্দনে আকাশ আঁকা ছিল, তখনও লহরীতত্ত্ব ছিল। বালকের সম্মুখেই ব্রাহ্মণ। তাঁহার মুখে ভয়জনিত ক্লীব অবিশ্বাস; কিন্তু অনর্গল শ্লোক ধারা উৎসারিত হয়, এবং মাঝে মাঝে অঙ্গুলীস্থিত কুশ-অঙ্গুরীয় যথাযথ করার ইচ্ছাও দেখা যায়, মনে হয় যেন বা এই বন্ধনে সমস্ত কিছু বাঁধা আছে। এই নূতন আয়োজনের পাশেই আর একটি চিতা প্রায় নির্বাপিত। যেখান হইতে উক্ত কণ্ঠস্বর আসিতেছিল।
ক্রমাগত জল দেওয়ার ফলে এই চিতা প্রায় নির্বাপিত হইয়া আসিতেছে; এই স্থান হইতে গঙ্গাজল পর্য্যন্ত অনেক জন লোক দণ্ডায়মান : যে ব্যক্তি গঙ্গায় দাঁড়াইয়া, সে কলস পূর্ণ করিতেছে–তাহার হাত হইতে পূর্ণ কলস হস্তান্তরিত হইয়া আসিয়া এই চিতায় নিঃশেষিত হয়। ভস্মরাশি বিরক্ত হইয়া উঠে। কিন্তু প্রতিবারই দেখা যায় দণ্ডায়মান লোকগুলি এ কার্য সম্পাদন করিতে, কলসটি হাতে লইয়া, কেমন যেন বা ভীত। পয়ারবিলাসী মন উধাও, পা কাঁপিয়া উঠে। সকলেই নিৰ্বাক, সকলেই এই ত গাছ নড়ে, এই ত অন্য সকলে রহিয়াছে–এই কথা ভাবিয়া সমস্ত কিছুকে কলস প্রমুখাৎ যুত করিতে চাহে, তত্রাচ কলস প্রায় হস্তচ্যুত হয়। সকলেরই কলস বাঁচাইতে দেহ বাঁকিয়াছিল।
কেবলমাত্র বৈজু চাঁড়াল, রূপরসগন্ধের সততা মানিয়া নির্ভীক, দাঁড়াইয়া আছে, সে তাহার দুঃসাহসিক মোচে দৃপ্ত চাড়া দিয়া অদ্ভুত করুণাবাচক হাসি হাসিয়া অনেক কথাই বলিতেছিল, তাহার চোখে ঘুম নাই। কহিল, “আই গো, হুঁশিয়ার গো খুব হে, মনকে আঁচ ঠেল, হিঃ গতর খুব খাড়া রাখ মন” পুনৰ্ব্বার দু’এক কদম নিকটে আসিয়া বলিল, “ওগো মশাই গো, উটি কলসটি, তোমার হৃদয় গো, আবার উটি তোমার স্মৃতি বটে, দেখ যেন ভাঙেনি, উটি ভেঙে দিয়ে যাবে চিতায় হে” বলিয়া মাথাটি দিয়া এখানকার আলোকে ঈষৎ নাড়া দিল।
বৈজু কারণসলিলে একটি ক্ষুদ্রপল্লবিত শাখাবৎ, দূরে কোথাও দ্বীপ প্রচ্ছন্ন হইয়া আছে, সুতরাং তার প্রতি সকলের আকর্ষণ অহেতুক নহে। তথাপি বৈজুর কথায় জনগণ অতিষ্ঠ হইয়া উঠিতেছিল, শুধু। কথা কেন, তাহার তুচ্ছ হেরফের গম্ভীর হইয়া দেখা দেয়, যেহেতু তাহার দেহকে অবলম্বন করিয়া একটি চাকচিক্য যেন স্বস্তিলাভ করিয়াছে। জনগণের একজন বৈজুর কথার উত্তরে, কেবলমাত্র নিজের অস্তিত্ব উপলব্ধির কারণেই বলিল, ‘এতেক কথা শিখালে কে বটে হে!