যশোবতীর কণ্ঠস্বর সঙ্গীতময় হইত যদি তাহা আকাশচারী; কাব্যময় হইত যদি তাহা সৃজনক্ষম; চিত্রমায়া হইত যদি তাহা বর্ণিকাভঙ্গধর্মী।
“হা হা, বুঝি বুঝি গো রহ রহ.কনে বউ, যে মানুষ নিজে ভস্ম হতে চায়, সে এ সোনার ত্রিভুবন জ্বালাতে পারে গোগা…ছিলাম শব তোমায় দেখি শিব হইলাম গো,– এইটুকু বলিয়াই আপনার জিহ্বা কাটিয়া কান মলিয়া কহিল, “না হয় ভস্ম হব গো, তবু আমি তোমার হাতেই হব গো, রামের হাতেই হব হে…”
“তুমি যাবে কি না”–এ বাক্য সাগর অভিমুখী, সাগররূপ কান্তর মিলন অভিলাষিণী স্রোতকান্তার একনিষ্ঠতা দর্শনে সাহসী হইয়া তিনি বলিয়াছিলেন।
“আমি এ হতে দিব না গো…তুমি পালাও হে, দুনিয়াটা খুব বড় কনে বউ–দুনিয়াটা খুব বড় বলতে, আমার কেমন রোমাঞ্চ হচ্ছে হে…পালাও কনে বউ।”
“মড়াই তোমার বুদ্ধিতে চলে…”
“মড়া” বৈজুনাথ এবম্প্রকার বিস্ময়ে এ বাক্য উচ্চারণ করে যে, বাক্যের সহিত চিত্র এই প্রথম একক হইয়া, একটি বিস্ফারিত নেত্র, পরিক্রমণশীল! ইহা সে দর্শনে অনড়, আপনকার ক্ষোভ, মর্মবেদনা, অপ্রসন্নতা, কিছু প্রশমিত হইবার পর সে ধীরে ধীরে কহিল, “মড়া!” ক্ষুদ্র একটি নিস্তব্ধতা দেখা গেল, ইহাও তাহার বাক্য বৈ অন্য নহে, এবং করুণ আর্তনাদে কহিল, “নর দেহ, নর দেহ যার কেউ নেই যে নিজে ছিল” পরক্ষণেই আপনার দুর্বলতা বুঝিয়া সশ্লেষে বলিল, “মড়া আই গো কি গেদা গো তোমার কনে বউ…আমি কি মানুষ হব না, বামুনের মেয়ে, কখন হয়ত বলবেক হারে তোর বড় নপর চপর, বেটা তুই পাতকুড়নোর অধম ছোট জাত…হাঁটছিস আমাদের মত, কনে বউ আমার হাতে জল চলে না রূপো চলে…বুদ্ধি…”
“তুমি যাবে কি না…”
বৈজুনাথ হয়ত তাঁহার মানরক্ষা নিমিত্ত দুয়েক পদ ধীর পদক্ষেপে সরিয়া আসিয়া হঠাৎ বসিয়া পড়িয়া কুয়াশা পরিবৃত গঙ্গার দিকে চাহিল, ছোট একটি দীর্ঘশ্বাস, সম্ভবত তাহার, চণ্ডালের, ঘুরিতে ঘূর্ণায়মান অপসারিত; ক্রমে শান্ত কণ্ঠে আপন মনে বলিতে লাগিল, “তোমার বিয়ে দেখলাম গো, গান গাইলাম গো, আমি তারাগুলোকে জলে দেখি, জাত চাঁড়াল এমন বিয়া-সাদি আমি দেখি নাই, মাগভাতার মাদুরে এক, হেঁসেলে দুই, প্রকারে তিন–আমার বউ বলত; তোমার বিয়ার দিন তারিখ নাই। কিন্তু তুমি দিয়ে দিলে বুড়ার হাঁড়িতে চাল, তাই বলে…এমন বিয়ে এ যে ভেল্কী…বুঝাও কোন মতে সিদ্ধ, তবে হ্যাঁ খুব খেয়েছিলাম গো–এ এক অবাক গল্প না গো কনে বউ?”
যশোবতী চণ্ডালের গতিবিধি অনুসরণ নিমিত্ত এখনও সেখানেই; আপনার ছায়ার প্রতি তীব্র কুঞ্চিত দৃষ্টি হানিয়া বৈজুনাথকে দেখিলেন, যাহার গাত্রবস্ত্র, গামছা, আলুলায়িত যাহা মন্থর বায়ুতাড়িত।
যশোবতী বাক্যহীনা, তথাপি বেলাতটে, এখন আসীন বৈজুনাথের মনে হইল, কনে বউ তাহার বোকা সরল কথায় বিদ্রূপ করিলেন, ফলে সে গম্ভীর স্বরভঙ্গে বলিল, “আমরা আর কি বল আমাদের ত জ্বললে আঁধার, নিভলে আলো–এ বড় ভাগ্য যে আমা হেন মানুষ নিঃশ্বাস নেয়!”
যশোবতী হেঁয়ালী বুঝিলেও একথা তাঁহার বিশ্বাস ছিল, যে বৈজুনাথ সেইটুকুর মধ্যে বাঁচিয়া নাই, তাহার পিছনে সম্পর্ক আছে, অনেক ঔদ্ধত্য আছে, সে দুর্ধর্ষ; অনন্য মনে এ সকল কিছু তিনি জ্ঞান করিতেছিলেন এবং এই সূত্রে হয়ত তাঁহার মনে হইয়াছিল তিনি যশোবতী, কি এখনও দিক নির্ণয় করিতে সক্ষম, তিনি কি প্রহর মানিতে পারদর্শী, তিনি কি ফুলসকল ফলসমূহ মৎস্যাদিকে চিনিয়া লইতে অভিজ্ঞা! এবং ঠিক এই সময়ই প্রত্যক্ষ করিলেন যে চণ্ডাল বৈজুনাথ বাঁকিয়া সম্মুখে তাহার হস্তদ্বয় ভুমি’পরি ন্যস্ত, পদদ্বয় কিছু বিস্তৃত, অবাক নয়নে তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়াছে। তাঁহার, যশোবতীর, দৃষ্টি অনুভব করিয়া কহিল, “তুমি কি সুন্দর…”
“চণ্ডাল” তাঁহার বাক্য মেঘরহিত আকাশকে বিদীর্ণ করিল।
“সত্যিই তুমি সুন্দর কনে বউ…” বলিয়া বৈজুনাথ উঠিয়া দাঁড়াইয়া ধূলা হাতে হাত আঘাত করত ঝাড়িয়া ফেলিয়া কহিল, “যাক আর সময় বেশী নেই, কাল…কাল যখন চাঁদ লাল হবে কিন্তু তবু বলব কনে বউ তুমি সত্যই মাটি ছুঁয়ে বলছি কাল চাঁদ যখন লাল হবে,– বলিতেই সে, চণ্ডাল, অচিরাৎ ত্রাসে বিমর্ষতায় নিদ্রিত, স্বপ্ন তদীয় রজনী লইয়া নিঃশ্বাস তাহার মিত্র হইয়া দেখা দিল; অঙ্গুলি যেখানে হাসে, সেই দুয়ে হাস্যধ্বনি, মত্ত মাতঙ্গ স্বভাব এবং তাহা ঘোর, মেঘদর্শন, অধুনা তরঙ্গায়িত! বৈজুনাথ আত্মসম্বরণ করিল, জাগিল; সমস্ত, প্রতিবিম্বিত দীপ্তিতে, আধোউদ্ভাসিত বৰ্তমান সমাকীর্ণ উদ্ভট ব্যাকুল দৃশ্যমানতা অবলোকনে তাহার মনে হয়, আপনার স্বপ্নকে লইয়া এখানেই ঘর করিবে, কেন না এই লোক চরাচর তাহার স্যাঙাৎ, ইহার সহিত তাহার বহুকালের প্রণয়, তথাপি যাহাকে কিছুক্ষণ পূৰ্ব্বে আপন আত্মম্ভরি মনে, পৃথিবীটা খুব বড়’ বলিতে রোমাঞ্চিত হয়, কেননা সে ঐ সূত্রে সুমহান বিরাটত্ব অনুভবে ক্ষণমাত্র বীতচেতন। ক্রমে বৈজুনাথ মায়িক স্বরে কহিল, “কিন্তু তবু বলি সময় নাই গো, আমার এক গল্প শুন হে তুমি, তুমি কনে বউ তুমি লিজে নারী কি পুরুষ একথা জানি না, তুমি কোন দেশের কোন মাহালের তা জানি না, কিন্তু পুড়বে ভাবতে যেন আমি চৌচির, এ কথা ভাবতে আমি মুরারী গো (অর্থাৎ দারুভূত)” ইহার পর চণ্ডালের কণ্ঠস্বর যেন শায়িত এবং শোনা গেল, “অহরহ তুমি তুমি ভাবতে আমি যেন তুমি হই যাই হে” এবং পুনরায় তাহার শব্দপ্রবাহ ব্যক্ত করে, “মনে লয়, মন মানে ভরত–আহা জনক রাজা হরিণ হরিণ হরিণ করতে হরিণ” বলিতেই তাহার দেহ হরিণের নিরীহগতি প্রযুক্ত, সে কিছুটা চলিল।