“চণ্ডাল”–শুদ্ধভাষায় মানিনী যশোবতী তারস্বরে হুঙ্কার দিয়া উঠিলেন; ইনি সেই যিনি আপন দয়িতের ভয় নিবারণার্থে ভয়ঙ্কর ডাকে একদা সমস্ত মেদিনীকে প্রকম্পিত, সমস্ত স্পন্দনকে শিথিল করিয়াছিলেন। অতএব তাঁহার নির্ভীক উচ্চনাদে বৈজুনাথ বিহ্বল; সে কোনক্রমে আপনকার চক্ষুদ্বয় তুলিয়া সেই অপূৰ্ব্ব রমণীকে অবলোকন করিতে গিয়া আকল্প নবীন অতি সূক্ষ্ম স্পন্দনের বিভূতি দেখে, যাহা দিব্যচক্ষুর অন্তর্গত, যাহা কাব্য-মনসার চিৎস্বরূপ; তথাপি মূঢ় বৈজুনাথ, যে সন্ধ্যা এবং ব্রাহ্মমুহূৰ্ত্ত সম্পর্কে নিশ্চেতন অনভিজ্ঞ, সে আপনার সুদীর্ঘ নিঃশ্বাসে আপনাকে বলবান করিয়া রূঢ় চক্ষে চাহিল, এবং নির্বোধের ন্যায় ঈষৎ হাস্য করিল।
যশোবতী সরোবর সরিৎ, নদী, লতাগুল্মাদি সপ্তপর্ণবনানী, গিরিসমূহ, ভূতগ্রাম সকলের, মৎস্যাদি উভচর সকলের যেন–পথরোধ করত এখনও দৃঢ়, একক; তাঁহার অবগুণ্ঠন নাই, হস্তে সীতারামের। কাজল চচ্চা নিমিত্ত ফলক ইব কাজললতা, মারাত্মক ছুরিকার ন্যায় শোভা পাইতেছে; ঈদৃশী লজ্জাহীনতা এবং দুর্জয় আভঙ্গ দেহসৌষ্ঠবের মধ্যে তিনি নিশ্চয়ই বিদ্যমান ছিলেন, তন্নিবন্ধন অনন্তর চণ্ডালকে পূর্ণভাবে নিরীক্ষণ করত কহিলেন, “তোমার…তোমার মনে কি কোন মায়া-দয়া নেই” একথা বলিতে বলিতে তাঁহার, হরিণনয়না যশোবতীর, সুতপ্ত অশ্রুধারা নামিল।
এ হেন বাক্যে অনাৰ্য্য চণ্ডালের শিরা-উপশিরা হা-হা করিয়া উঠিল, আজন্ম ক্ষুৎপিপাসা কাতর তাহার মন, কথাগুলিকে যেমত বা আহার করিবার মানসে আঘ্রাণ করিল এবং উত্তর দিল, “দয়া মায়া…” এ উচ্চারণে ভঙ্গ ছিল।
সঙ্গে সঙ্গে প্রতিধ্বনিত করিলেন, “হু”–তখন তিনি ক্রোধে ফুঁসিতেছিলেন।
“বটে বটে, এ শ্মশানে” বলিয়া বৈজুনাথ অত্যধিক তাচ্ছিল্য-সহকারে সমগ্র শ্মশানকে অঙ্গুলিদ্বারা নির্দ্দেশ করিয়া পুনরায় যোগ করিল, “এ শ্মশানে পাব কুত্থাকে গো কনে বউ”–এ সময় তাহার অঙ্গুলিতে চন্দ্রলোক লাগিয়াছিল, এবং ইহার পর আপনার মনে দয়া মায়া’ বলিয়া হাসিয়া উঠল।
যশোবতী চণ্ডালের হাস্য তরঙ্গের প্রতি মনোনিবেশ করিলেন, তখনও তিনি যথার্থ সম্বিৎ ফিরিয়া পান নাই, তিনি এখনও অনবগুণ্ঠিতা, তবু ইহা ধ্রুব যে, তিনি আলোতে, অন্ধকারে, একাকিনী, লোকচক্ষে, রক্তমাংসে বধূ; তাঁহার তীক্ষ্ণ রূঢ় সাহসদীপ্ত গম্ভীর কণ্ঠস্বর শ্রুত হইল “তুমি কি ওঁকে মেরে ফেলতে চাও? তোমার মনে কি ভগবান এতটুকু মায়া মমতা…”
“ভাল গল্প গো ভাল গল্প! মায়া মমতা একমাত্তর আমার থাকার কথা, না? আমি জাত চাঁড়াল, বলি মায়া মমতা কোথাকে পাব গো, ও সব ত বামুন কায়েতের ঘরে মরাই মরাই…বেশ মিঠে হিম হাওয়া, না গো…”
“চাঁড়াল”
“ভুল বেগোড় বুঝলে বটে বামুনের মেয়ে, এক গল্প বলি, এখানে যা ছিল, একটু একটু করে সবই পাঁচ ভূতের চিতায় গেছে…মায়া দয়া!”
“তুমি”…
“হ্যাঁ গো কনে বউ তুমি কখন কেঁদেছ?”
যশোবতী সহসা মৃত্তিকায় পদাঘাত করিয়া দর্পভরে কহিলেন, “তুমি ওঁকে শান্তিতে…” এবং উক্তির সঙ্গে সঙ্গেই এবাক্যের ম্লান নিদারুণ ছায়া দুইজনের ইতিমধ্যে নিপট হইয়া দেখা দিল, আর যে ক্রমে তাহা বিলীয়মান। যশোবতী চণ্ডালকে নিরুত্তর দেখিয়া আরবার সুন্দর করিয়া কথা কয়টি উচ্চারণ করিলেন, “তুমি কি শান্তিতে…”
“মরতে” ইহা বৈজুনাথ প্রশ্ন করে নাই, তাহার কণ্ঠস্বরের বেদনা কোন তুমুল সমুদ্র পার হইতে চাহিল, অনন্তর কুয়াশায় আবছায়া স্বরে কহিল “কনে বউ তুমি খুব খাসা, তাই হে যা বল তাই সে কথাই তোমার লাগসই হে, এখন তুমি বল দয়া মায়া আছে কি না, বাঃ!”
বাক্য, শব্দের পূর্বের এক অচিন নিস্তব্ধতা এখানে আবর্তিত হইল! মিলন অভিলাষিণী সুন্দরী, অন্যধারে শ্মশান পরিচর্যাকারী নরদেহ।
বৈজুনাথের ওষ্ঠ ওঠানামা করে; ঝটিতি, এই গহনরাত্রে যাহার একান্তে কুয়াশা আবৃত খরধারা, তাহার ভগ্নস্বর শ্রুত হইল, “বামুনের মেয়ে, কনে বউ, আমি আকাশ খাই গো, তুমি পূব দক্ষিণ দশ দিক কখন দেখেছ…এখানে তোমার তরে সব সোনা হবে” বলিয়া কিঞ্চিৎ শ্মশান-মৃত্তিকা তুলিয়া আরম্ভ করে, “দেখ, দেখ তুমি হেঁটে গেলে, এ মাটি আবাদ হবে…” বলিতে বলিতে বৈজুনাথ ষড়ৈশ্বৰ্য্যময়ীর প্রায় নিকটে আসিয়া দাঁড়াইল।
চণ্ডালের করপুটে মৃত্তিকা, কুয়াশা নাই, যশোবতী সজল স্নেহময়ী চক্ষে এ মৃত্তিকা দেখিয়া, চকিতে কয়েক পদ পশ্চাদপসরণ করিলেন। বৈজুনাথ হস্তস্থিত মৃত্তিকারাশি ফেলিয়া দিয়া ম্লান হাস্যে কহিল, “কাল শালা যাকে লিয়েছে সে যাক্। কিন্তু কেউ কাউকে ঠেলে চিতায় ফেলবে, এটা কি বল? ওগো বাবু, আমার দোষ লিও না,– এ সময় তাহার আওয়াজ কুয়াশা-বিজড়িত, আর্দ্র, শ্রমখিন্ন; দীনমানসে আন্তরিক ভাবে বলিল, “আমি মারলে ঠেঙ্গা ফিরলে লাঠি নই, উঁচু নই চাঁড়াল গো, চাঁড়াল…পুঁথিপাঠ নাই, তোমার চিতা করব না হেঁকে বললুম…আমি ঠাকরুণ ইন্দ্ৰত্ব আশা করি না, বৈকুণ্ঠবাস চাই না, নয় হে দুঃখ হয়েছিল…দেহ বড় ভালবাসি মড়াকে যত্ন করি…”
“চণ্ডাল”–যশোবতী উচ্চৈঃস্বরে তাহাকে প্রকৃতিস্থ করিতে চাহিলেন, সমস্ত আবহাওয়া এখন তাঁহাকে কিয়দংশে শান্ত করে, আর তিনি সম্যক, হয়ত বুঝিয়াছিলেন, বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, এই, ইহা শ্মশানভূমি হইলেও ইহা আদর্শতুল্যা অলাতচক্রাকৃতি পৃথিবীর, যাহা উত্তম হাস্যধ্বনি পরিমণ্ডিত, অংশ; নিম্নে, উগ্র তীব্র ক্ষিপ্ত বেগবতী স্রোতস্বিনী!