মনুষ্যদেহী চণ্ডালের ঈদৃশ দুঃসহ সঘন চীৎকারে দিকসকল আর এক চক্ষুতে পরিণত, ভ্রাতৃজীবনসকল ত্রাসযুক্ত; বৃক্ষ পত্রাদি থরহরি এবং সুখনীড় এ পৃথিবী এক মহাধ্বনিতে পরিপূর্ণ হইল, বিশ্বসংসার বুঝি যায়!
তাহার কণ্ঠনাদে এ-বাক্যই ঘোষিত হইল যে আমি, বৈজুনাথ, মাতা যেমন দেহ দেন, তেমনি নরদেহকে আমি সৎকারে সাহায্য করি। সেই বৈজুনাথ এক অবৈধ প্রণয় দেখিয়াছে, এক বিসদৃশ মিথুনের সে দ্রষ্টা, যে মিথুন অন্যায়, যুক্তিহীন। আপনাকে স্বকীয় চীৎকারে সম্মোহিত করত চিতা হইতে এক লম্ফে উঠিয়া অসূৰ্য্যম্পশ্যা ব্যাকরণশুদ্ধ অন্ধকারকে আপনার ভাই সম্বোধন করিয়া দাম্ভিক হইল এবং কিছুক্ষণ পরে নবদম্পতির চাঁদোয়াকে বেষ্টন করিয়া, বৈজয়ন্তীমালার ইঙ্গিত ধরিয়া, সহুঙ্কারে ছুটাছুটি করিতে লাগিল, মুখে “ওই লম্বোদরজননী হাই শিবশন্তো” এবং তাহার দক্ষিণ হস্ত ঊর্ধে ঘুরিতে ব্যস্ত।
যশোবতী বিস্মিত হইবার পূর্বেই সীতারাম, এই ভয়ঙ্কর শব্দে, কাঁদিয়া উঠিলেন। কাঁদিতে কাঁদিতে কহিলেন, “শীত শীত…” বলিয়া স্ত্রীকে আঁকড়াইয়া ধরিতে চাহিলেন। যশোবতী স্বামীর হস্তদ্বয় আপনার কণ্ঠে স্থাপনা করত এখন অন্য হাতে কাজললতা মাটিতে ঠুকিতেছিলেন।
বৈজুনাথ এখন শুধু “বল হরি হরি বোল…লম্বোদর” বলিয়া তাঁহাদের চক্রাকারে পরিভ্রমণ : করিতেছে। তাহার পদখনিত ধূলা উড়ে, ছায়া মাটিতে নাই, যাহা জৈবিক, যাহা মনহীন, যাহা হয় অহিতৈষী।
যশোবতী আর সহ্য করিতে পারিলেন না। আপনার দুর্জয় সাহস নিজেকেই আতঙ্কিত করিল, তিনি শুধু নানাবিধ একত্র মিশ্রিত ব্যাঘ্ৰ কভু কর্কশ, চক্রবাক সহসা তীক্ষ্ণ, বায়স কভু দীর্ঘ, ঋষভ ঝটিতি উদ্ধত–নিনাদে উচ্চারণ করিলেন, “এই…এই।”–অর্থাৎ খবরদার খবরদার।
নয়ন সমক্ষে এ কোন ভীম তীব্রতা!
সীতারাম এখনও তেমনি আলিঙ্গন করিয়া আছেন, যে আলিঙ্গনের প্রতি বিন্দুতে, কেয়ারিতে, বিশাল দিব্য সুদীর্ঘ শেষহীনতা ঝিম; যে, অতিবড় গঞ্জের বারাঙ্গনায়ও পর্যন্ত সে-সুদীর্ঘতা বুঝিতে সমুৎসুক এবং এই অপ্রাকৃতিক আরাম যাহার অন্তর্বর্তী চালোক, যে চন্দ্রালোকের অন্তর্বর্তী ভ্রমণশীলতার অভিধা, যে ভ্রমণশীলতার অন্তর্বর্তী সুন্দরের উষ্ণতার বিচিত্রতার মাধুর্যের সুধার লৌকিকতার জ্যামিতির ভূমিকার উৎপ্রেক্ষা অবর্ণনীয়া; তাহাকেই, সেই আরামকেই রমণীকুলশ্রেষ্ঠা যশোবতী আপন রোমকূপ-সহস্র, যাহা পুরুষ মানুষের, ইতরজনের অবামনসগোচর, তাহা দ্বারা স্বাদ গ্রহণে প্রগম্ভ; এই হেতু যে ইতঃপূর্বের বৈজুনাথের চক্রান্ত যাহাতে শ্মশানের মেদগন্ধযুক্ত মৃত্তিকা চিরতপ্ত এবং সে তাপ হরিহরণকারী, তাহা মৃত্যুকে বীভৎস ফলে জীবনকে জঙঘাদ্বয়ের মধ্যে লুক্কায়িত করিতে উৎসাহদানে–বিফলকাম হইয়াছে, একারণ জঙ্ঘা যেহেতু তাহাই মানুষের একমাত্র পলায়নের ক্রোড়, অন্যপক্ষে স্বাধীনতা। চক্রান্ত বিফলে যশোবতী জয়গর্বিত, ফলে তিনি ভাবনাবিরহিত মনে তখন সেই অলঙ্কার বলয় ইত্যাদি, যেগুলি আত্মরক্ষাকল্পে ব্যবহার করিয়াছিলেন, সে সকল পুনরায় সংগ্রহে ব্যাপৃতা হন। অদূরে চণ্ডালের দেহ চিহ্ন, বেলাপৃষ্ঠে মুদ্রিত, বৈজুনাথ যেন বা আপনার এই ছায়াকে পাহারায় রাখিয়া গিয়াছে। তাঁহার এই অলঙ্কার সংগ্রহ যাত্রা না অভিসার, শূন্য তীর ঝটিতি মহাগুল্ম, তৃণস্থান, লতাবিতান গহন কাননে আচ্ছাদিত। শুধু মৃত্তিকা ও তাহার অচ্ছেদ্য সম্পর্ক এখানেই তিনি অলঙ্কারাদি অন্বেষণ করেন, হৃত সম্পদ লাভ করিয়া একদা গঙ্গায় তাহা শুদ্ধ করিবার নিমিত্ত কয়েক পদ অগ্রসর হইয়াছিলেন, তিনি তীরে দণ্ডায়মানা, নিম্নে জলোচ্ছাস; সহসা তাঁহার ধারণা হয় স্রোতোধারার উপর আপনার সম্পদ সমুদয় মেলিয়া ধরিলেই শুদ্ধ হইবে, ইহার পর আবার এই আক্রমণ।
উগ্রতেজা বলিষ্ঠ বৈজুনাথ এখনও তেমনিভাবে তাঁহাদের বেষ্টন করিয়া সবেগে ধাবমান, তাহার পদদলিত তপ্ত ও তীব্রতর প্রভাবিশিষ্ট ধূলারাশি শূন্যমার্গে উখিত; সে দাম্ভিক, তাহার ঔদ্ধত্যের পরিসীমা নাই, তাহার বেগবিক্রমে একথাই প্রকাশিত যে, আমি মহাবিটপীসকল অক্লেশে উৎপাটন করিব, আমি উত্তুঙ্গ গিরিসকল বিদারণ করিব, আমি মত্ত সাগরকে সংক্ষোভিত করিব। স্বপ্নের দ্রষ্টাকে আমি দাস রাখিব, আমার গতি অব্যর্থ, কি সাগরশৈলে কি বনে অথবা পাতালে–কোথাও আমার গতি প্রতিহত হয় না।
সীতারাম-অভিলাষিণী যশোবতী দুরদৃষ্ট দর্শনে প্রমাদ গণনা করিলেন; একধারে, অতি প্রতীক্ষার অরুণাভ ভেদ করিয়া মনসিজ আলিঙ্গন; অন্যত্রে জাগরণে, প্রত্যক্ষে–নাদ উচ্চনাদ গর্জন মেঘরব, এবং ধূলারাশি! সাধ্বী আর এক মুহূর্তকাল বিলম্ব না করিয়া স্বামীর আলিঙ্গন এক স্থানে রাখিয়া অর্থাৎ স্বামীর ভয়ার্ত হস্তদ্বয় হইতে আপনাকে মুক্ত করত কোমরে কাপড় জড়াইয়া কোন সময় যে কাজললতা হাতে দুষ্টকৰ্ম্মা চণ্ডালের পথ রোধ করিয়া দাঁড়াইয়াছেন, তাহা তিনি নিজেই জানিতেন না। কালসর্পের মত বেণী চমকাইতে লাগিল, এবং তাঁহার পূর্বপুরুষের সাধনার দেহখানি শুধুমাত্র শব্দময়। আননে চন্দ্রালোক নাই, নিয়ম লঙঘন করত এখন, ওতপ্রোত সূৰ্য্যালোক দীপ্তি দান করে।
চণ্ডাল তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিল; বৈজুনাথের দেহ যেমত বা একটি সাষ্টাঙ্গ খাড়া প্রমাণ; দেখিল গঙ্গায় যেন ঢল নামিয়াছে; দেখিল, যাহা ভয়ঙ্কর উহা দুধর্ষ, তাহা অভিরাম, হাজার জোনাকি। সে গতি কোনক্রমে সম্বরণ করিয়া দুই পা পিছাইয়া গিয়াছিল, নিরক্ষর বিড়ম্বনায় তাহার শ্রবণশক্তি ক্লীব, দৃষ্টি হস্তীদলিত অন্ধকার মাত্র; গঙ্গাতীরে, স্তব্ধতার তলে, কেন না স্রোত অধুনা রেখানিচয়, বৃদ্ধের গোঙানির শব্দ শোনা যায়। চণ্ডাল ভূত-চালিতের মত কি জানি কেন আপনার হস্ত প্রসারিত করিয়া ক্রমে ভীতভাবে নামাইয়া লইল, আপনার ওষ্ঠ লেহন করিল।