কমলকুমার মজুমদারের উপন্যাসগুলি আসলে আধুনিক চম্পূ, যেরকম চম্পূ ইদানীংকালে অন্য কেউ লেখেন না, আর কেউ লিখতে পারবেন বলেও মনে হয় না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১. আলো ক্রমে আসিতেছে
অন্তর্জলী যাত্রা – আলো ক্রমে আসিতেছে
আলো ক্রমে আসিতেছে। এ নভোমণ্ডল মুক্তাফলের ছায়াবৎ হিম নীলাভ। আর অল্পকাল গত হইলে রক্তিমতা প্রভাব বিস্তার করিবে, পুনৰ্ব্বার আমরা, প্রাকৃতজনেরা, পুষ্পের উষ্ণতা চিহ্নিত হইব। ক্রমে আলো আসিতেছে।
অনতিদূরে উদার বিশাল বাহিণী গঙ্গা, তরল মাতৃমূৰ্ত্তি যথা, মধ্যে মধ্যে বায়ু অনর্গল উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠে; এইস্থানে, বেলাতটে, বিবশকারী উদ্বিগ্নতা ক্ষুদ্র একটি জনমণ্ডলীকে আশ্রয় করিয়া আছে। কোথাও কারণের বিকার মাত্র নাই, প্রতিবিম্ব নাই, কোথাও স্বপ্ন পর্য্যন্ত নাই; এ কারণে যে, একটি মুহূর্তের সকল কিছুকে বাস্তব করত স্মরণীয় করিয়া একের যে নাম ভিন্ন ক্রমাগতই অপ্রাকৃতিক পার্থিব, তাহারই প্রাণবায়ু নিষ্ক্রান্ত হইবে এবং তাই মানুষমাত্রই নিশ্চল, ম্রিয়মাণ, বিমূঢ়। ইহাদের প্রত্যেকেরই। মুখে মুখে নির্বোধ গাম্ভীৰ্য্য আরূঢ় হইয়া রহিয়াছে মনে হয়, কখন তাহারা কপালে করাঘাত করিবার অমোঘ সুযোগ পাইবে তাহারই যেন বা কাল গণনা করিতেছে। কেননা চির অসূৰ্য্যম্পশ্যা জীবন এই প্রথম আলোকের শরণাপন্ন, কেননা শূন্যতা লবণাক্ত এবং মহাআকাশ অগ্নিময় হইবে।
আমাদের স্নেহের এ জগৎ নশ্বর, তথা চৈত্ররুক্ষ অগণন অন্ধকার সকলই, মৃন্ময় এবং অনিত্য; তথাপি ইহার, এই জগতের, স্থাবর ও জঙ্গমে পূর্ণিমা; ইহার চতুর্বিংশতিতত্ত্বে, মানুষের দুঃখে, কোমল নিখাদে–সর্বত্রে, এরূপ কোন তন্মাত্রা নাই যেখানে যাহাতে–হাসি নাই, কারণ সৰ্ব্বভূতে, বহুতে, তিনি বিরাজমান।
হায়! ইদানীং সেই বহুর মধ্যে একটিকে পরিত্যাগ করত মহাব্যোমে, বিরাট শূন্যতায়, চক্ষুহীন জিহ্বহীন স্তব্ধতায় তিনি অব্যক্ত হইবেন; চির রহস্যের, অনন্তের রূপ একই রহিবে। গঙ্গাতীরে অন্তর্জলী উদ্দেশ্যে আনীত সীতারাম চট্টোপাধ্যায় এই অগণিত বহুর মধ্যে–সেই নিঃসঙ্গ একটি।
সীতারাম অতীব প্রাচীন হইয়াছেন; অধুনা খড়ের বিছানায় শায়িত, তিনি, যেমত বা স্থিতপ্রজ্ঞ, সমাধিস্থ যোগীসদৃশ, কেবল মাত্র নিষ্পলক চক্ষুর্ঘয় মহাকাশে নিবদ্ধ, স্থির; তিলেক চাঞ্চল্য নাই, প্রকৃতি নাইক্রমাগতই বাঙ্ময়ী গঙ্গার জলছলাৎ তাঁহার বিশীর্ণ পদদ্বয়ে লাগিতেছিল।
অন্তবন্ত, অন্তরঙ্গ এ দেহ যে বৈরাগ্য আনিবার পক্ষে যথেষ্ট অঢেল তাহা অতিবৃদ্ধ সীতারামের। দেহের প্রতি তাকাইলেই সম্যক উপলব্ধি হয়; তদ্দর্শনে, আপনার হস্ত হইতে শিশুর কপোলস্পর্শজনিত যে রেশমী অনুভব তাহা অচিরেই উধাও হইবে; আপনার সকল স্মৃতি–একদা হয়ত যে মানসবেগ চম্পকে জড়াইয়াছিল, কখন হয়ত দূর পথশ্রমের পর–স্রোতস্বিনী দর্শনে যে শান্তি অনুভব, অথবা পরিপ্রেক্ষিত হইতে সৃষ্ট হইয়া ক্রমে দিনের আলোয় ভাঙিয়া পড়া যেমন বুদ্বুদের চরিত্র এবং তাহা। অনুধাবনে মানুষ যেমন বিনয়ী হইতে গিয়া অহঙ্কারী হইয়া উঠিয়াছে–এই সকল স্মৃতি মাত্রই ভ্রংশ হইবে এবং দীর্ঘশ্বাস পরিত্যাগ করত আপনাকে নিশ্চিত বারম্বার বলিতেই হইবে, হায় এ-দেহ কি গোলাপের অন্যতম দীর্ঘতম পুরস্কার! এবং অজানিতের প্রতি বালকের মতই, আপনার অনাৰ্য্য অভিমান জন্মিবে।
বৃদ্ধের দেহে দেহে কালের নিষ্ঠুর ক্ষতচিহ্ন, অসংখ্য ঘুণাক্ষর, হিজিবিজি। মনে হয়, এ-দেহে পাপ অথবা পুণ্য, কিছুই করিবার যোগ্যতা নাই। বিশুষ্ক চৰ্ম্মের আবরণে কঙ্কালসমান মুখমণ্ডল–এখানে, কপালে চন্দন প্রলেপ অধিকন্তু বীভৎসতা হানিয়াছে। ভাববর্ণহীন চক্ষুদ্বয় কালান্তরে আপনি নিমীলিত হয়, পুনৰ্ব্বার কিসের আশায় খুলিয়া যায়। অব্যক্তের লীলা-সহচরী মাতা, কোন মাতা এ-দেহ হইতে বারেক সৃষ্টির বীজ সঞ্চয় করিয়া আপনার সঙ্গোপনে রাখিবেন কে জানে!
বৃদ্ধের ওষ্ঠদ্বয় বিচ্ছিন্ন এবং এই অপরিসর ফাটলে বিন্দু বিন্দু গঙ্গোদক পড়িতেছে, এক একটি বিন্দু। কুঞ্চিত ওষ্ঠে পড়িয়া চমকাইয়া টলিয়া স্থির হয়, পরক্ষণেই অতর্কিতে কোনরূপে মুখগহ্বরে প্রবেশ করে; কোনটি বা, কীট-পতঙ্গ যেমত, জীবন লাভ করিয়া চিবুকের অঙ্কুরিত দাড়িমধ্য দিয়া পথ পায়, নামিয়া যায়। এই সঙ্গে বিলম্বিত লয়ে ‘গঙ্গা-নারায়ণ-ব্ৰহ্ম বলো’র দুঃসহ নিপীড়িত মর্মান্তিক ভৌতিক ধ্বনিবিস্তার উত্থিত হইতেছে। তবুও সীতারাম প্রৌঢ়শিলার মতই অনড়, গঙ্গা-নারায়ণ-ব্ৰহ্ম বলিবার। কোন ধৈৰ্য্য তাঁহার আয়ত্তের মধ্যে ছিল না।
শিয়রের নিকটে কুলপুরোহিত কৃষ্ণপ্রাণ, কণ্ঠলগ্ন চেলীতে নারায়ণ শিলা, অত্যন্ত সন্তর্পণে কুশী হইতে গঙ্গাজল (চরণামৃত) বৃদ্ধের ওষ্ঠে ঢালিতেছেন। সীতারামের মস্তক তাঁহারই জ্যেষ্ঠপুত্র বলরামের উরু-উপরে ন্যস্ত। দক্ষিণে কনিষ্ঠ পুত্র হরেরাম। ইহারা সকলেই বৃদ্ধের আত্মার সদগতি নিমিত্ত ‘গঙ্গা-নারায়ণ-ব্রহ্ম’ পদটি আবৃত্তি করিতে যত্নবান। হরেরাম ঠোঁট কম্পিত করিতেছিল, ঝিমাইতেছিল, এবং মাঝে-মাঝে চক্ষুদুইটি বড় করত আপনাকে সজাগ করিয়া আবৃত্তির সুরের সহিত কণ্ঠস্বর মিলাইতেছিল।
মধ্যে, একপার্শ্বে, কবিরাজ বিহারীনাথ হাতের নাড়ী টিপিয়া অনন্য মনে বৃদ্ধের মুখপানে চাহিয়া আছেন। তাঁহার স্পর্শের মধ্যে নীলাবিসনা এই পৃথিবীর বাঁচার তির্য্যগ সূক্ষ্মগতি এবং তৎসহ সংখ্যাবাচক একের প্রথম উপলব্ধি ছিল। কবিরাজের পিছনেই একজন সৰ্বাঙ্গ চাঁদরে আবৃত করিয়া, অথচ মুখটুকু খোলা, দুলিয়া দুলিয়া গীতাপাঠ করিতেছে। লোকটির সম্মুখে পুঁথি, কিন্তু পুঁথি দেখিবার আলো নাই, প্রয়োজনও নাই একারণে যে লোকটির গীতা কণ্ঠস্থ। কখনও বা তাহার ঘুম বিজড়িত স্বরে শ্লোক পরম্পরা ব্যাখ্যাও শুনা যায় যথা “কৌমার যৌবন কিছুই স্থির নয়, আত্মার হেতু নাই, মৃত্যু নাই–আশ্চৰ্য, কেহই আমরা থাকিব না, আমরা অমৃতে যাইব…” সমস্ত কিছুই একসঙ্গে লোকটি বলিতে চাহে।