“মর হারামজাদা! ওরে চাঁড়াল, চিতাটা যে একটু বড় হল, তোর কি মনে হয়?”
“চিতা বড় হবে কেনে…উত্তর দক্ষিণে গঙ্গা, একজন জ্যান্ত…শালা হাওয়া ভারী খচ্চড় জাত, জ্যান্তই থেকে যাবে…তখন হা হুতাশ…করবে কে…” এই বলিয়া পুনৰ্ব্বার হাঁটুতে হাত দিল।
“লে শালার আবার মায়া ফুকারি…” অনন্তহরি ছ্যাঁচড়া কণ্ঠে বলিলেন।
বৈজুনাথ রুখিয়া উত্তর করিল, “না শালা আমরা কাঁদি না, মুতি–চোখে ত জল নেই।”
“আঃ আস্তে আস্তে, আমার মেয়ে রয়েছে বসে…তোর একটা…”
“ওহো এখনও ত তার নাড়ী আছে ঠাকুর…”
“হারামজাদা তোর জ্বালায় পৃথিবীতে কি চন্দ্র সূৰ্য্য উঠবে না…মারের চোটে…”
“বাবু তোমাদের থেকে উঁচু জাত নেই…যারা…আচ্ছা আচ্ছা ঠাকুর, বুড়ো আর কনে বউ যদি…” বলিয়াই বৈজুনাথ যশোবতীর দিকে তাকাইল। ঘাসে মুখ রাখিয়া হরিণী যেমত চাহিয়া থাকে, সেইরূপ দৃষ্টি দেখিতে পাইয়া সে থ’ হইয়া গেল। সে বলিতে চাহিল, “আচ্ছা সারা দুনিয়ার লোক মিলে যদি হা-হুঁতাশ করে, আকাশে কি তাহলে টেলিগ্রাফ হবে?’ পরক্ষণেই অতি সন্তর্পণে মুখ ফিরাইল। স্বগত উক্তিতে ওষ্ঠ কম্পিত, অস্পষ্ট পাখোয়াজের বোল শুনা যাইতেছে।
ব্রাহ্মণেরা সকলেই প্রশ্ন করিল, “কি রে…”
“না, ভাবছি বাবু…”
“ভাবনার কি আছে…” কৃষ্ণপ্রাণ কহিলেন।
“বাবুমশায় সুখে পুড়তে পারে সেটাও ত দেখতে হবে…। আমার মতে চিতা আরও বড় দরকার…”
মুখভঙ্গী করিয়া অনন্তহরি কহিলেন, “তুই শালা কাঠ দিবি? শালা আমার খাঞ্জা খাঁ। এত কাঠ পাবে কোথায়…”।
“বাড়ীর খরচার মত কাঠ লোকে জমা রেখেছে–তারা দেবে কেন?” কৃষ্ণপ্রাণ কহিলেন।
“ওই ত বলে কে…” লক্ষ্মীনারায়ণ শুধুমাত্র সায় দিলেন।
“লে লে চিতা ছোট কর…”
“ভাবছ কেনে গো, কত কর্পূর আসবে, মাখন ছুঁড়বে, এইটা সতীদাহ বলে কথা! এ কি তোমার আমার লাস? পুড়ল না পুড়ল কি এসে গেল? মড়ার মুখ থেকে ছাগল পিণ্ডি চাটবেক…”
বলিয়া সে গর্ব অনুভব করিল।
ব্রাহ্মণেরা সকলেই মুখ বিকৃত করিয়াছিলেন। বৈজুনাথ একের পর এক সকলের মুখের দিকে তাকাইয়া নিজের মধ্যে যেন ফিরিয়া গেল। অনন্তর গভীর নিঃশ্বাস ত্যাগ করত কহিল, “কত সোনা পড়বে, ইঃ–সতীদাহ বলে কথা।” বলিয়া সেই ভাবেই দাঁড়াইয়া রহিল, পরক্ষণেই অদূরে দেখিল, সেই সীতা-স্মৃতি নয়নযুগল।
এহেন দৃষ্টি তাহাকে যেন আকর্ষণ করিতেছিল; সে, চণ্ডাল বৈজুনাথ, আপনার অজ্ঞাতেই দুই এক পা আগাইয়া গেল। ব্রাহ্মণ সকলেই, তাহাকে সচেতন করিলেন। সে অন্যমনস্কভাবে ঘুরিয়া দাঁড়াইল, সম্মুখের উচ্চবর্ণের মুখগুলি সে এমত দৃষ্টিকোণ হইতে দেখিয়াছিল, যাহাতে প্রত্যেকেই তাহার কাছে বীভৎস প্রতীয়মান হয়। ইঁহাদের, ব্রাহ্মণদের, সাধারণ কথাবার্তায় কলহরত খানকীদের আওয়াজ ছিল; সে আপনকার ভারাক্রান্ত মুখোনি উঠাইবার চেষ্টা করিল, আবার প্রয়াস পাইল; একারণে যে, সে অদ্য ফুটন্ত ফুলের বীরত্বের উপর দিয়া বহমান একটি কাকলী শুনিল, এই পাখী হলুদ, অভিমানী বধূদের কথা কহিতে অনুরোধ করে। মনে হইল তারা, কাহারা বাতায়নে দাঁড়াইয়া সুদূরতা দেখে।
ইতিমধ্যে কে যেন কহিল–”তাহলে…কি হবে…?”
“আর মাপের দরকার নেই…”
“খেলা করবার জন্য মাপ নেওয়া হচ্ছে.” এই উষ্মপ্রকাশ করিয়াই তৎক্ষণাৎ লক্ষ্মীনারায়ণ মিষ্টকণ্ঠে কহিলেন, “নে বাবা…কত কাঠ লাগবে বল, সেই অনুপাতে কাঠ যোগাড় করতে হবে ত…!”
চণ্ডালের চোখে জল ছিল না, তবু যেন তাহার মনে হইল তাহার চোখে জল আছে, সে হাত দিয়া চক্ষু মুছিয়া কহিল, “বললাম হে…তুমি গুঁড়ি দশ বার যোগাড় কর, চেলা ক’গাড়ি আর যারা আসবে সবাই কাঠ আনবে বয়ে গো। আগে আমার মনে পড়েনি…তুমি…”
“না না…খুঁটি ছোট কর…”
চণ্ডাল আবার মাপিতে হামাগুড়ি দিতে বসিল, দুই হাত মাপিয়াই সে স্থির; এক অনৈসর্গিক অনুভব বৈজুনাথকে আকাশ বাতাসের সংস্পর্শে আনিয়া দিল, মাটির প্রতি গভীর মনোযোগে একনিষ্ঠ একাগ্রতা সহকারে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল, কাহাকে যেন সে দেখিতে পাইয়াছে–শাস্ত্র যাহাকে ভাবময় তত্ত্ব বলে, তাহার সহিত সে অনায়াসে কথা কহিতে পারে। সে অবাক, সে অভাবনীয় স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করিল, অনন্তর আপন ধীর কণ্ঠস্বরে তাহাকে গল্প বলিতে সুরু করিল, “রাম নামে অযযাধ্যার রাজার পুত্র ছিল…” এসময় দৃশ্যমান মায়া অন্তর্ধান হয়, সে রুষ্ট হইয়া মহা আক্রোশে মাটিতে চপেটাঘাত করিল। নিজের ওষ্ঠদ্বয় কামড়াইতে লাগিল; মনের মধ্যে অগণন কালো সাদা দেখিল, তাহার অর্থ এই হয় যে ‘এ মাটি আমার আমি তার–’ এক মুহূর্তের জন্য মুখোনি জন্তুর মত বাঁকা করিয়া দণ্ডায়মান ব্যক্তিদের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল, আরবার যশোবতাঁকে দেখিল। ইহার পরে তাহার বিরাট দেহটা উঠিয়া দাঁড়াইয়াছে, সে হাঁটু ঝাড়িতে ঝাড়িতে কহিল, “আমি পারব না…চিতা করতে।”
“সেকি…বেটা মহাপাতক হবি রে।” পলকের জন্য যশোবতীর দিকে চাহিয়া লইয়া সে কহিল, “আমার খিদে পেয়েছে…”
পুনরায় সে কহিল, “আমার খিদে পেয়েছে।” ইহার অর্থ আধ্যাত্মিক, বৈজ্ঞানিক না ভৌতিক তাহা কেহ নির্ণয় করিতে সময় ক্ষয় করিলেন না।
“কেন চণ্ডাল হয়ে জন্মেছিস জানিস, তুই বেটা জাত বজ্জাত…তোর পাখা উঠেছে…”
বৈজুনাথ কোন উত্তর করিল না। তাহার গতি আসন্ন-প্রসবা গাভীর মতই ভারাক্রান্ত, কখনও বা সে শান্ত হইয়া পড়িয়াছিল। আবার চলিল, গঙ্গার জল মাথায় দিল।