সীতারাম উত্তেজনায় অস্থির, এইবার ‘কালীয়দমন’ যাত্রার একটি টপ্পা ধরিলেন। “বলি পরাণ বাঁশী ফেলে দাও, আমাকে মজিও না প্রাণ তোমাতে মজাও”–এই মধ্যরাত্রে গঙ্গাযাত্রী বৃদ্ধের বুকে পীতধড়া বনমালা পরিহিত কালো ছোঁড়ার চাপল্য জোয়ার হানিল। আশ্চৰ্য্য হাতের ফেরতাই দেখা দিল, তেহাই পড়িল এবং সঙ্গে সঙ্গে হিক্কা উঠিল। যশোবতী তখনও হাসিতেছিলেন।
তিনি এই ভয়ঙ্কর পরিবর্তনের কথা কোনক্রমেই জানিতে পারেন নাই। আপনার কোমরের কষি আলগা হইল, তিনি উঠিয়া স্বামীর এই বিকট মূর্তির দিকে চাহিয়া যেন ফুলিয়া উঠিলেন। বস্ত্রের কষি হইতে হস্তদ্বয় মুক্ত করিয়া তাঁহার বুকে হাত বুলাইতে লাগিলেন, কি করা কর্তব্য তাহা তিনি জানিতেন না।
.
অতি প্রত্যুষে কুশণ্ডিকা হইয়া গেল। ঢাকি বাহক সকলেই চলিয়া গেল। বৃদ্ধের পৃষ্ঠের রক্তিম নারায়ণ-চিহ্ন তখনও নববধূর চোখে ভাসিতেছিল, কখন স্রোত কভুবা মৎস্যের লাফান তাঁহার দৃষ্টিপথে
পড়িয়াছিল। কোন কিছুকে অর্থ করিবার মত তাঁহার মন ছিল না।
লক্ষ্মীনারায়ণ গঙ্গার নিকটে বসিয়া যশোবতাঁকে উপদেশ দিতেছিলেন। পুরাকালের রমণীগণের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের মহিমা কীৰ্ত্তন হইতেছিল। যশোবতী একদৃষ্টে পিতার কথা শুনিতেছিলেন, এই চাহনির মধ্যে এতেক সরলতা ছিল, যে…লক্ষ্মীনারায়ণের মনে হইতেছিল, যশোবতী তাঁহার কথা ঠিক বিশ্বাস করিতেছেন না, ফলে তিনি ঈষৎ নির্বোধ বনিয়া ঘোট ঘোট অঙ্গ ভঙ্গিমায় তাহা ঢাকিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন।
“বাবা” যশোবতী ডাকিলেন।
গঙ্গার হাওয়া এবং জলোচ্ছাসে যে রৌদ্র, তাহা উচ্চারিত বাক্যটিকে লিখিত করিয়া দেয়; এ কারণে যে যশোবতীর ‘বাবা’ কথাটি বলার ভঙ্গিতে যে নিঃসঙ্গতা ছিল, যে নিঃসঙ্গতায় বাদল ছিল, যে বাদলে আদিম উষ্ণতার হেত্বাভাস–তাহা তাঁহাকে, লক্ষ্মীনারায়ণকে, বিবৃত করিয়াছিল।
লক্ষ্মীনারায়ণের মনের কোথাও যেন সে কথা, শিশুসুলভ হাতের নরম স্পর্শ করিয়াছিল, ব্রাহ্মণদেহে যোগসাধনার ধারা বর্তমান, মূঢ় জনের মত অল্পেই হা-হা করিয়া কাতর হইয়া উঠে না। কারণ মনে পাণ্ডিত্যের ধারা বর্তমান, তবু প্রবহমান গঙ্গার দিক হইতে সুযোগ বুঝিয়া দৃষ্টি ফিরাইলেন। কেননা সেখানে, এ গঙ্গায় উপত্যকার অন্তস্থিত পার্বত্য ছায়ায় যে মাতৃত্ব উৎপন্ন উৎসাহিত উৎসারিত বর্ধিত হয়, তাহারই দ্বাপরকালিক আভাস ছিল!
ইদানীং সে গঙ্গা–শিবের জটা বহিয়া যাহা নামিয়াছে, যাহাতে কোন গল্প নাই–তাহা, পিতা ও কন্যার ইতঃমধ্যে সঞ্চারিত। যশোবতী স্বচক্ষে সেই পবিত্র স্রোতেধারা দেখিয়াছিলেন; এখন মুগ্ধ, তিনি মনে মনে আকাশ লইয়া খেলিতে মুখর বাত্ময়; যে অমরতা লইয়া ইহজগত, তাহার আলো তাহার পুষ্পরাশি নয়ছয় করিয়াছে, কাব্যে যাহা ছন্দ-মিলের ধ্বনি মাত্র, সুশীল ও সুবোধ মানুষের মৃত্যুতে যাহা সান্ত্বনা বচন, তাহা, এখন, এই খেলার বস্তু এবং যাহা যশোবতী অবোধ পৃথিবী হইতে সংগ্রহ করিয়াছিলেন। তিনি অন্যমনস্কা অথবা সংস্কারবশতভাবে ডাকিলেন, “বাবা।”
এই সম্বোধনের মধ্যে ত্রিসন্ধ্যা এক হইয়াছিল! লক্ষ্মীনারায়ণ অন্ধকার হইয়া নিশ্চিহ্ন, ক্রমাগত গ্রহনক্ষত্রের স্বভাব সুলভ আবেগসঞ্চার তাঁহাকে কেন্দ্র করিয়া দৃঢ় হইয়া উঠিল, যাহাকে নিগ্রহ করিতে তিনি শক্তিহীন। তাঁহার মন যুক্তির জগতের জন্য চঞ্চল; সেখানে শস্যের জীর্ণতা মনকে সহজ করিলেও মন বীজকে সাদরে রাখে, জীর্ণতাকে সঙ্গোপনে লালন করে। লক্ষ্মীনারায়ণ অগোচরে আপনার নাম, নিজেই, ধরিয়া ডাকিয়া পরে কহিলেন, “মা গো, সব কপাল! তুমি সীতাকে জান মা, রাবণবধের পরে রাম তাঁকে ত্যাগ করেন সীতা সহ্য করলেন, লক্ষ্মণ চিতা সাজালেন…মে হৃদয়ং নিত্য নাপসৰ্পতি রাঘবাৎ, কোন ক্রমেই তাঁর মন রাঘব থেকে ছেড়ে যায়নি। মা আমার কত ব্যথা সহ্য করেছিলেন, তবু পতিভক্তি…” লক্ষ্মীনারায়ণের চোখে জল আসিল। নিশ্চয়ই পৈতা দিয়া চোখ মুছিলেন।
যশোবতীও পিতার চক্ষু মুছাইয়া কহিলেন, “তুমি তুমি…” আর কিছু বলিতে পারিলেন না। অথচ নির্ভীক গম্ভীর সুন্দরী মনোরমা যশোবতী বলিতে চাহিয়াছিলেন, ‘পিতা তুমি আমাকে সনাথ করিয়াছ– ইহা হইতে আর কি রমণীর প্রেয় হইতে পারে; তিনি ঊর্ধ্বে আছেন ইহা আমি জানিতাম, পরে অন্তর্যামী জানিয়াছিলাম, এখন…’ বলিয়া বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়াছিলেন–যাহা ডালিমের বেদনাময় যৌবনের দ্বারা সম্ভব। কারণ এ সময় শোনা গেল, চণ্ডাল হাঁকিতেছে, “ঠাকুর এস, এস হে। এখুনি আবার যাত্রী আসবে…গো।”
বৈজুনাথের ডাকে লক্ষ্মীনারায়ণ যেন বা মুক্ত আকাশ দেখিলেন, কন্যাকে তদবস্থায় রাখিয়া কয়েক পদ আসিয়া মনে হইল যেন আপন গৃহদ্বারে পৌঁছিয়াছেন। নিশ্চিন্তভাবে খানিক দণ্ডায়মান থাকিয়া সহসা ঘুরিয়া দেখিলেন, যশোবতী সীতারাম হইতে এখন দূরে।
লক্ষ্মীনারায়ণ কন্যাকে ডাকিলেন। যশোবতী বলিলেন, “বাবা আমি এখানে…”।
“ছিঃ ছিঃ অমন ক’র না, লোকে কি বলবে? তোমার দুই ছেলে রয়েছে…তাছাড়া যেটুকু সময় পাও স্বামীসেবা কর মা…।”
যশোবতী স্বামীর নিকটে গিয়া বসিলেন।
.
বৈজুনাথ এ জমিকে প্রণাম করিয়া চিতার মাপ লইতে লাগিল। মাটির উপর হামাগুড়ি দিয়া হাত মাপিতে মাপিতে অনেক দূর পর্যন্ত গেল; খুঁটি বসান হইল, সে গান গাহিয়া উঠিল, সে গান, “যে দেশে রজনী নেই মা, সেই দেশের এক লোক পেয়েছি”। দাঁড়াইয়া হাঁটু ঝাড়িয়া খুব বিজ্ঞের মত কহিল, “বেশ হয়েছে, লাও এবার নিকিয়ে ষটকোণে বীজমন্ত্র লেখ…জয় গুরু!”