“বউ বউ” মর্মান্তিক শব্দ হইল। যশোবতী মুখোনি নিকটে আনিলেন, এখন বৃদ্ধের চোখদুটি আয়ত হইল, কহিলেন, “ঘোমটা…না না।”
যশোবতী ঘোমটা খুলিয়া, পরমুহূর্তে যথাস্থানে রাখিয়া সকল দিক নিরীক্ষণ করত অতি সন্তর্পণে ঘোমটা উন্মোচন করিলেন।
পক্ককেশ-চন্দ্রালোকে যশোবতী চির-রহস্যের সম্মুখে আসিয়া নিঃসঙ্গ; বৃদ্ধের গূঢ় অন্ধকারকে সুযোগ বলিয়াই মনে হইল। আবেগে কহিলেন, “বাঁচব বাঁচব” ফলে মুখের কষ বহিয়া লালা নিঃসৃত হয়।
নিঃসঙ্গতা-আহত যশোবতী কেবলমাত্র মস্তক আন্দোলিত করিলেন।
“তুমি…এসেছ” ইহার পর কম্পিত অঙ্গুলি দ্বারা আপনাকে নির্দ্দেশ করিয়া নিশ্চয় বলিয়াছিলেন, “বাঁচব”; সীতারামের কথা স্পষ্ট না হইলেও তাঁহার আকৃতিতেই বক্তব্যকে প্রকাশ করিতেছিল। অনন্তর বৃদ্ধ একটি দম লইয়া, পদাঘাত করিবার অমানুষিক ঔদ্ধত্যের সহিত কহিলেন, “বাঁচব” এবং যুগপৎ মহা আক্রোশে আকাশের দিকে–এখন যে আকাশ চন্দ্রাহত তারা ভরা–তাহার দিকে চাহিলেন।
আকাশে, উর্ধে, ক্রমাগতই হংসবলাকায়ূথ, যাহাদের ছায়া ইতঃমধ্যের শূন্যতায় নিখোঁজ সুতরাং তাহারা অশরীরী; তথাপি, কভু নিম্নের স্রোতের শব্দকে নিষ্ফল করত তাহাদের মুখনিঃসৃত ধ্বনি শোনা যায়; যশোবতাঁকে এ শব্দনিচয় দিকভ্রান্ত করে–কেন না তিনিও দেখিতেছিলেন, একদা মনে হইল এ-শব্দ বৃদ্ধের মুখপ্রসূত শব্দ বৈ অন্য নহে; সেই হেতু বৃদ্ধের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন। সেখানে এখনও বৃদ্ধের চোখে শিশির তত্ত্ব। আরবার তিনি, যশোবতী, উড্ডীয়মান হংসশ্রেণী দেখিলেন।
অকস্মাৎ দেখা গেল, এ-উড্ডীয়মান হংসশ্রেণী কি যেমন বা পরিত্যাগ করিল, ফলে এ-দিঙমণ্ডল চকিতেই নিষ্ঠুর কুটিল, আকাশপথে কি যেন, পালক যেমত, ভাসিয়া ভাসিয়া নামে। ক্রমে ইহা স্পষ্ট। একটি উর্ণা তথা ব্যাধের জাল খসিয়া আসিতেছে যাহা কিছুকাল পূৰ্বে নিশ্চয়ই হংসশ্রেণীকে রুদ্ধ করিয়াছিল।…অনুঢ়া, রম্য, প্রাণময়ী অদ্যও–এ হংসশ্রেণী; জালটি আকাশে যদিও একাকী, তথাপি সৌখীন, বাবু, নয়নাভিরাম! এ দৃশ্যে সীতারাম পশুশাবকের মতই কুঁকুঁ শব্দ করিতেছিলেন, এখন শিহরিয়া প্রাণান্ত মুখব্যাদান করিয়া তড়িৎ বেগে একটি হাত আপনার চোখের উপর রাখিতে চেষ্টা করিলেন, কেননা জালের ছায়া তাঁহার দেহে পড়িয়াছিল।
যশোবতী এতক্ষণ বিন্দু মাত্র, যেহেতু এই নৈশ সৌন্দৰ্য্য, তাঁহার বালিকা মনে ভয়াবহ রূপে দেখা । দেয়, নির্বাসিত লহমার ব্যথায় তাঁহার জানকীসদৃশ শরীর জর্জরিত, এবং রোমহর্ষে যে অস্তিত্ব খুঁজিয়া। পাইয়াছিলেন–তাহার বলে পার্শ্বস্থিত নিপীড়িত বৃদ্ধকে দেখিয়াই বস্ত্রপ্রান্ত দ্বারা তাঁহার, বৃদ্ধের, স্বামীর মুখমণ্ডল আবৃত করিলেন।
সীতারামের ক্রন্দনের আপ্লুত স্বর ও মুখ মারুতে বস্ত্রখণ্ড উঠা নামা করিতেছিল। ভৌতিক ভাবে সহসা বস্ত্রপ্রান্ত উড়িয়া গেল, একটি কণ্ঠস্বর হাওয়ায় উড়িল, “ভয় ভয়।”
যশোবতী বুদ্ধিভ্রংশ হইলেন না, বৃদ্ধের কপালের দুইপার্শ্বে হাত রাখিয়া আকাশ ঢাকিলেন। কামযোগ। দূরত্বের মধ্যে দুজনে মুখোমুখী। সহসা যশোবতী কেমন যেন পাগলিনী হইলেন, মোলক কম্পিত, নথ রাশ মানিতেছে না।…সীতারাম বলিলেন, “ভয় ভয়।” দিশাহারা যশোবতী মুখোনি আরও নীচু করিলেন, অঙ্গের মাংসল খেমটা সাহস বৃদ্ধের চোখে মুখে বর্ষিত হইল।
চকিত হরিণীর ন্যায় তাকাইলেন, তাঁহার মুখে লালার চিহ্ন। এ সময় দুরাগত হাস্যধ্বনি। গঙ্গার নিকটে বসিয়া একটি পা ছড়ান অন্ধকার সেই উলঙ্গ গীতখানি ধরিয়াছে।
যশোবতী যেমন বা অপমানিত হইয়াছিলেন।
তথাপি উঠিয়া চারিটি খুঁটিতে চাঁদোয়া বাঁধিয়া আসিয়া বৃদ্ধের পাশেই বসিলেন। সীতারাম এই চাঁদোয়ার জন্য কিছুটা সোয়াস্তি বোধ করিয়াছিলেন, কেননা মৎস্য-পিত্ত আকাশ নাই, কেবলমাত্র চাঁদোয়ার কতক ছিদ্র বহিয়া আলোক সম্পাত হইয়াছে। ভয় যেন অন্য কোথাও স্তন্যপানরত।
.
সীতারাম ডাকিলেন, “বউ”.তাহার অনেকক্ষণ পর আবার শোনা গেল, “আমি আবার আমার জমি-” আশ্চর্যের বিষয় এই যে এইবার স্পষ্টই শোনা গেল, “বউ তোমাকে নিয়ে ঘর ঘর” এই কথা তিনি এক নিঃশ্বাসে বলিয়াছিলেন। ছেলেমানুষের মত তাঁহার বাচন ভঙ্গি, ছেলেমানুষের মত আশা। যশোবতী সম্মুখের স্রোত দেখিতে দেখিতে এই বাক্যগুলি শুনিয়াছিলেন।
“বউ, গান বল–”
যশোবতীর চক্ষুদ্বয় বিস্ময়ে ভরিয়া গেল, জীবনে এই বোধহয় প্রথম হাসি আসিল, পাছে অন্য কোন লোক তাঁহার হাসি শুনিতে পায়, সেই হেতু মুখে সত্বর বস্ত্রপ্রদান করিয়াছিলেন। হাস্য সম্বরণ যখন হইল না তখন স্বামীর দেহের পাশেই মুখ খুঁজিয়া কুকুর কুণ্ডলী থাকিয়া হাসিতে লাগিলেন। বৃদ্ধ সীতারাম ইহাতে উৎসাহিত বোধ করিয়া গীত ধরিলেন, শুদ্ধবঙ্গভাষা অপহৃত হইয়াছে, চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা দিয়া শব্দ উৎসারিত হইতে লাগিল। রেনিটি’র ঘরের কীৰ্ত্তন ‘কি হে বাঁশী বাজায়, বধূ’ এ গীতের অন্যকলি অস্পষ্ট, ক্রমাগত ‘বধূ’ই শুনা গেল। আর যে যখন তিনি খাদ হইতে (!) স্বর আনিবার চেষ্টা করিতেছিলেন তখন একনিষ্ঠ গাম্ভীর্য্য মুখ চোখে ঠিকরাইয়া প্রকাশ পাইল। বৃদ্ধ থামিয়া যুগপৎ হাসিতে ও নিঃশ্বাস লইতে লাগিলেন। যশোবতী অন্যদিকে মুখ করিয়া থাকা সত্ত্বেও যেন স্বামীর দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করিবার চেষ্টা করিতেছিলেন এবং মধ্যে মধ্যে হাসিতেছিলেন।