বৃদ্ধ সীতারাম অনেকক্ষণ একভাবেই ছিলেন, হয়ত নববধূর সহিত বাক্যালাপ করিবার তাঁহার বাসনা হইয়াছিল; তাহার জন্য শক্তি সঞ্চয় করিতেছিলেন। তিনি কি যেন বলিলেন…।
যশোবতী সত্যই তাঁহাকে বুঝিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, অভিমান তাঁহার হয় নাই। অন্তত তাঁহার মুখে একটি সপ্রতিভ লক্ষণ দেখা গিয়াছিল।
যশোবতাঁকে সীতারাম দেখিতে লাগিলেন। নববধুর দৃষ্টি এখন অন্যত্রে নিবদ্ধ ছিল। যেখানে মাদুরে বিশ্রামরত সকলের সম্মুখে উবু হইয়া বসিয়া, বৈজু গান শুনাইতেছিল। রামপ্রসাদী শেষ হইল। যাহাদের এখনও তেজ ছিল তারা আর একটা, আর একটা’, বলিয়া অনুরোধ করিল; তাহার প্রত্যুত্তরে সে কহিল, “বাবু মশায়, আমি এবার নিজ মন মত একটা গান বলব…”
বৈজুর বাক্যে কৃষ্ণপ্রাণ ইত্যাদি যাঁহারা জাগিয়াছিলেন তাঁহারা হরিধ্বনি করত কহিলেন, “তাই হোক।” বৈজু তাহার জোয়ারী গলায় হস্তের ঝাঁপা বাজাইয়া ধরিল, “বলি শোন–
বিবাহ এক রক্তের নেশা,
বর বউ যেন বাঘের মত…”
গীতের বাণী পোড়া কাগজের মত গঙ্গার হাওয়ায় ফর ফর করিয়া উড়িয়া যাইতেছিল, তথাপি শ্রোতাদের কর্ণে প্রবেশ করিয়াছিল; বৈজু এখনও তাহার হাঁটুর প্রায় কাছেই চাপড় মারিয়া হৈ হৈ করিয়া গাহে।
ব্রাহ্মণেরা এ উহার দিকে চাহিয়া তারস্বরে হো হো শব্দ করিয়া উঠিয়া তাহার পরেই কিয়দংশ সমস্বরেই কহিলেন, “মর হারামজাদা…বেল্লিক…শালা…চাঁড়াল…”। কৃষ্ণপ্রাণ আপনার খড়ম হাতে লইয়াছিলেন।
বৈজুনাথের কোন কিছুই হয় নাই। সে উঠিয়া নেশা বিবশ পা ছড়াইয়া আবার চলিতে আরম্ভ করিল, গান তাহার কণ্ঠে ছিল।
“বিবাহ এক রক্তের নেশা–
বর বউ যেন বাঘের মত,
বাঘ বাঘিনী রক্ত চোষা ॥”
যশোবতী অত্যধিক বিস্ময় সহকারে এই গান শুনিতেছিলেন। বৈজুর দেহ দুলিতেছে। সহসা কৃষ্ণপ্রাণ ছুটিয়া আসিয়া বলিলেন, “দেখ ব্যাটা চাঁড়াল, আমি তোর গান ঘুচিয়ে দেবো…”
“হেরেরেরে–কি অল্ল্যায় হলো…” বলিয়া বৈজু ঈষৎ টলিয়াছিল। “ন্যায় অন্যায় তুই কি করে বুঝবি বজ্জাত হারামজাদা…” নিজের ব্যাঘ্ৰস্বর শুনিয়া কৃষ্ণপ্রাণ নিজেই চমকাইয়া শঙ্কিত এবং নিজের হস্তপ্ত খড়মের দিকে চাহিয়া কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হইলেন।
“তা বটে তা বটে, ন্যায় অন্যায় বুঝবই যদি তবে চাঁড়ালির পেটে জন্মাব কেনে…”
“ফের যদি গাইবি হারামজাদা তো…” তদনন্তর কণ্ঠস্বর মিহি করিয়া কৃষ্ণপ্রাণ কহিলেন, “বিয়ের ক’নে বসে–”
“তা বাসরঘরে গোঁপ চোমরান গান হবে না ঠাকুর, এ কি হবিষ্যি গান হবে…”
“তুই মাতাল, তা না হলে…”
বৈজু ঐ স্থান হইতে বিবাহের বাসর দেখিল। কি দেখিল সেই জানে, হয়ত বা নানা আসনে চন্দ্রালোকই দেখিয়া থাকিবে। সে গম্ভীর হইয়া অল্পক্ষণ দাড়ি চুলকাইল। তাহার পর সজল নেত্রে কহিল, “চাঁড়ালের ঘরে জন্মেছি ঠাকুর, ন্যায় অন্যায় জানিনা। তবু তুমি শেখালে গো” বলিয়া প্রণাম করিল। কৃষ্ণপ্রাণ তাহাকে প্রণত রাখিয়া ফিরিয়ে গেলেন।
প্রভুভক্ত কুকুর যেমন প্রভুর দিকে মুখ তুলে, তেমনই সীতারাম নববধূর দিকে মুখ তুলিয়া কিছু বলিতে চাহিলেন। বৈজুর গানের অসৎ কলিগুলি যশোবতী শুনিয়াছিলেন, তথাপি তাঁহার মনে কোন বিকার উপস্থিত হয় নাই, এ কারণ যে সেখানে পুষ্পের অজ্ঞতা ব্যতীত কিছুই ছিল না।
বৈজুর দিক হইতে মুখ ফিরাইয়াই বৃদ্ধের দিকে দৃষ্টি পড়িল। গাল চোষার অল্প আওয়াজ এখন আগ্রহের সৃষ্টি করিয়াছিল, তিনি স্বীয় মুখোনি তাঁহার প্রায় নিকটেই আনিলেন, কিন্তু চো চোক আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শুনিতে পাইলেন না। কিছুক্ষণ পরে মুখ তুলিতে গিয়া দেখিলেন, আপনার বসন প্রান্ত বৃদ্ধ মুঠা করিয়া ধরিয়া আছেন, অতঃপর ক্ষিপ্রবেগে তাঁহারই হাতের কব্জি ধরিতেই তিনি সবিস্ময়ে দেখিলেন, অঙ্গুলিগুলি একটির পর অন্যটি নামিতেছে উঠিতেছে। ইহাতে, ইহাতেই মনে হয় যশোবতীর চক্ষুর্ঘয় কিঞ্চিৎ উদগ্রীব হইয়াছিল।
যদিচ আপাত দৃষ্টিতে এহেন অঙ্গুলি আন্দোলন সত্যই ত্রাসের সঞ্চার করে, তবু তাহারই মধ্যে প্রেমিকের হৃদয়ের উষ্ণতার, গভীরতার, সুকুমার ব্যঞ্জনা ছিল; সুকুমারস্বভাবা যশোবতী হাতটি ভাল করিয়া দেখিতে লাগিলেন, ইদানীং অনুভব করিলেন, বৃদ্ধের এই বিশীর্ণ হাতখানির মধ্যে বলবতী ধাবমান ইচ্ছা প্রচ্ছন্ন হইয়া আছে এবং তাঁহার সমস্ত হাতখানিকে উর্দ্ধে লইয়া যাইতে চাহিতেছে। যশোবতীর সাহায্যে প্রবীণ হাতখানি শক্তিলাভ করিল, যেন আপনা হইতে উঠিয়া তাঁহার অবগুণ্ঠন উন্মোচন করিয়াই সেখানে স্থির হইয়া রহিল।
এই দেহের অথৈ সৌন্দৰ্য্য যেমন বা সন্ন্যাস লইয়াছে। স্তম্ভিত বৃদ্ধকে মুহূর্তের মধ্যেই চরিত্রবান করিল, সীতারাম আমিত্ব-অহঙ্কার বর্জিত, কিন্তু মানুষের দন্তপাতি অদৃশ্য হইলেও, জিহ্বা অক্ষয় হইয়া আপন স্থানে বসিয়া থাকে, রস উপলব্ধি করে। উদ্ভিন্নযৌবনার হেমদেহ স্পর্শে বৃদ্ধের গায়ে যেন মাংস। লাগিল। সীতারাম কি যেন বলিলেন। যশোবতী তাহা সঠিক বুঝিয়ে না পারিয়া নূতন করিয়া ঘোমটা রচনা করিবার জন্য দুই হাতে বসন প্রান্ত উত্তোলন করা মাত্রই প্রাচীন হাতখানি তাহার বক্ষে আসিয়া দারুভূত হয়, শতাব্দীক্লিষ্ট বল্কলসদৃশ অঙ্গটি দেখিয়া যশোবতী এককালে অন্ধকার-শঙ্কিত, উৎখাত হইলেন। তাঁহার দীর্ঘশ্বাসের আঘাতে বৃদ্ধের হাতখানি ক্রমে যেমন বা নামিয়া গেল।