সীতারাম তখনও প্রবল বেগে কাশিতেছিলেন, এমতাবস্থায় মন্ত্রচালিত পাষাণপ্রতিমা, যশোবতীর হস্তধৃত মাল্যখানি আসিয়া বৃদ্ধের কণ্ঠলগ্ন হইল।
এসময় বায়ু স্থির, গৃহাভিমুখী পক্ষীরা মুখরিত, স্রোত শান্ত এবং প্রকৃতি স্তব্ধ নিথর হইয়াছিল।
.
সীতারামের অবস্থার কথা স্মরণ করিয়া, শুভকাৰ্য্য যত সংক্ষেপে করা যায় তাহা করা হইতেছিল। ইতিমধ্যে কৃষ্ণপ্রাণ, দক্ষিণা আচারবিরুদ্ধ হইয়াছে, এই কথা বুঝিতে পারিলেন। পুরোহিতচিত কণ্ঠে কৃষ্ণপ্রাণ কহিলেন, “নিয়ম এই যে, আমি আর একটি মুদ্রা বেশী পাইব…”
লক্ষ্মীনারায়ণ ট্যাঁক খুঁজিলেন, কাপড় ভাল করিয়া ঝাড়িলেন। কোন মুদ্রাখণ্ডের সন্ধান পাওয়া গেল না। তখন তিনি শুধু মাত্র অসহায়ভাবে বলিলেন, “তা হলে…”
“সর্ব্বনাশের কিছু নেই, ভালমত অনুসন্ধান কর, ক্ষুণ্ণমনা ক্ষুব্ধ ব্রাহ্মণ দ্বারা শুভকাৰ্য্য সম্ভব নয়” বলিয়া কৃষ্ণপ্রাণ স্মিতহাস্য করিলেন।
তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়া কোন মুদ্রার সন্ধান পাওয়া গেল না। লক্ষ্মীনারায়ণ আপনার লোকেদের কাছে কর্জ চাহিলেন, কিন্তু তাহাদের সকলের কাছেই কিছু কড়ি ছিল, রৌপ্যমুদ্রা ছিল না। সুতরাং লক্ষ্মীনারায়ণ আসিয়া অনুনয় বিনয় করত কহিলেন, “ঠাকুর মশাই, এখন…”
“রৌপ্যমুদ্রা বিনা শুভকাৰ্য্য হয় না…”
অদূরে বসিয়া বৈজুনাথ এই ব্যাপার দেখিতেছিল, সে একটি ঝাঁপা হইতে খানিক তাড়ি নিজের মুখে ঢালিয়া মন্তব্য করিল, “যাঃ শালা-পাকা খুঁটি বুঝি কাঁচে গো” তাহার কথা কাহারও কর্ণে প্রবেশ করিল না। তখনও লক্ষ্মীনারায়ণ দাঁড়াইয়া অপদস্থ হইতেছিলেন; বৈজুনাথ উচ্চৈঃস্বরে কহিল, “আমি ধার দিতে পারি” বলিয়া ঠেটির ট্যাঁকে হাত দিয়া অনুভব করিতে লাগিল।
লক্ষ্মীনারায়ণ অত্যন্ত রাগান্বিত, বৈজুনাথের কথায় তাঁহার সব্বাঙ্গ যেন হোমাগ্নিতে পরিবর্তিত হইল, তিনি ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন, “হারামজাদা ইতর চাঁড়াল…”
শান্তকণ্ঠে বৈষ্ণব কৃষ্ণপ্রাণ সহাস্যবদনে কহিলেন, “কন্যা সম্প্রদানকালে ক্রোধ পরিত্যাজ্য” বলিয়া ক্রমাগত সাধুভাষায় আপনার মনোভাব ব্যক্ত করিতে লাগিলেন, “যে কোন জাতি বর্ণের নিকট হইতে ধাতু তথা অর্থমুদ্রা গ্রহণযোগ্য, একমাত্র মুদ্রার ক্ষেত্রে জাতিবিচার চলে না…এতদ্ব্যতীত শ্মশানে উচ্চ নীচ ভেদ নাই।” মনে হইল কোন অকাট্য সংস্কৃত শ্লোকের ইহা সরল ভাষায় অনুবাদ।
এই বিচারে সমবেত জনমণ্ডলী গভীর শ্রদ্ধার সহিত কৃষ্ণপ্রাণের প্রতি অনিমেষ নয়নে চাহিয়াছিল। লক্ষ্মীনারায়ণ বিভ্রান্ত, একবার ইহাদের দিকে অন্যবার তাঁহার নীচকুলোব মহাজনের দিকে তাকাইলেন। বৈজু ইহাদের কথাবার্তা শুনিয়াছিল, সে হাতের কব্জিতে মুখ মুছিয়া একটি মুদ্রা লইয়া দাঁড়াইয়া অন্যহাতে আপনার মোচ চুমরাইতেছিল। জ্যোতিষী অনন্তহরি লক্ষ্মীনারায়ণকে খানিক সৎসাহস দিলেন।
লক্ষ্মীনারায়ণ লজ্জিত পদে বৈজুর নিকট আসিয়া হস্ত প্রসারিত করিলেন। চণ্ডাল তাঁহার হস্তে মুদ্রাটি দিবার জন্য আপনার নেশা-বেসামাল দেহকে সংযত করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড রোল উঠিল, “ওরে ব্রাহ্মণের চরণে দে, না হলে মহাপাতক হবি”; বৈজুর অবস্থা বুঝিয়া ব্রাহ্মণ এক-পা পিছাইয়া গিয়াছিলেন। সে টাল সামলাইতে না পারিয়া পড়িয়া গেল, তাহার হাত হইতে মুদ্ৰাখণ্ড গড়াইয়া প্রায় গঙ্গার কিনারে গিয়া পড়িল। বৈজু নেশাবিজড়িত কণ্ঠে বলিল, “আমি শালা ত প্রণামী দিচ্ছি না যে পায়ে দেবো…।” অবশ্য তাহার এ উক্তি কেহ নিশ্চিত শুনিতে পাইল না।
লক্ষ্মীনারায়ণ গঙ্গাজল মুদ্রাটির উপর ছিটাইয়া তাহাকে শুদ্ধ করিয়া লইয়া আসিলেন। পুনৰ্ব্বার এই শ্মশানভূমিতে পুণ্য বিবাহমন্ত্র উচ্চারিত হইল, আসন্ন সন্ধ্যার গঙ্গার কল্লোল-ধ্বনিকে আহত এবং স্তব্ধ করিয়া দূর গগনে আবর্তিত হইতে লাগিল। এই মন্ত্রশক্তি, মানব দেহের হিঙ্গুল রক্তস্রোতকে উদ্ধতনখর ও প্রকৃতিস্থ করিতে সক্ষম হয় নাই। ইহা মায়িক সুতরাং হৃদয়ের স্পন্দন পাতালগত শিকড়মতই স্থবির হইয়া রহিল।
বিবাহের প্রথম অধ্যায় নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হইল। মৎস্যক্ৰীড়া কড়ি খেলা পর্যন্ত হইল, পুরাতন উর্ণনাভের মত হাতখানি ক্রীড়াচ্ছলে, কখন বা কড়ি সন্ধানকালে, যশোবতীর দেহের সর্বত্রে কর্ষণ করিল। তিনি ভীতা হইলেন না, নিঃশ্বাসের গতির সমতার কোন ব্যতিক্রম ঘটিল না; নবোঢ়া বধুর মত ক্লান্ত হইয়াও তিনি যে সহজ হইয়াছিলেন, এমতও নহে। কৃষ্ণপ্রাণ গঙ্গাতীরের বাসর পরিত্যাগ করিয়া লক্ষ্মীনারায়ণের নিকটে গিয়া বলিলেন, “কি বলব, আমার মনে হয় আমরা যেন সত্যযুগেই আছি, মায়ের কি শক্তি।”
এখন আকাশ তারাতৃষ্ণ, তবু দেখা গেল লক্ষ্মীনারায়ণের মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে।
.
যশোবতী বসিয়া আছেন। তিনি যেন বা ত্রিগুণাত্মিক মায়ার দ্বারা পীড়িতা নহেন। অথবা স্বাভাবিক জ্ঞান তাঁহা হইতে অপহৃত হইয়াছে। সম্মুখে উদার গঙ্গা ইদানীং চালোকে বেলোয়াড়ী। তিনি কৃষ্ণতম অন্ধকারের আধার মাত্র, পরিদৃশ্যমান স্থূলতা যে অন্ধকারে অপ্রকট হইতেছে; যাহা ঘটিল তাহার স্মৃতি পর্যন্ত তাঁহাকে ক্ষেত্র করিয়া জাগিয়া উঠিতেছে না। অনেক প্রাণ আছে যাহার স্পন্দন নাই, ক্ষুধা নাই। শুধু মরণোন্মুখ ঘুমে তাঁহার চক্ষুদ্বয় খসিয়া আসিতেছে। তথাপি বেশ কিছুক্ষণ ধরিয়া তিনি যেমন বা কাশির মত আওয়াজ শুনিতেছিলেন। অনন্তর কোনক্রমে একবার পাশ ফিরিয়া দেখিলেন যে, আত্মরক্ষায় বদ্ধপরিকর পোকার মত দুটি চোখ তাঁহার দিকে চাহিয়া আছে, এতদৃষ্টে তাঁহার দেহ রোমাঞ্চিত হইল না, শুধু মাত্র অল্প ভাঙন দেখা গিয়াছিল। বৃদ্ধের হাতে মৃদু স্পন্দন ছিল, মনে হয় তাহা গঙ্গার হাওয়া-সম্ভব। যশোবতীর মুখে কালোচিত অবগুণ্ঠন ছিল না, তিনি অপলক নেত্রে বৃদ্ধের দিকে চাহিয়া রহিলেন, এ সময়ে তাঁহার দেহস্থিত কূট অন্ধকার যৌবশরীরকে আলোড়ন করিয়া সুদীর্ঘ দীর্ঘনিঃশ্বাস হইয়া চলিয়া গেল, নাসার বেসরকে তাহা লাল করিয়াছিল, নোলক তটস্থ হইয়াছিল, এবং জীবন সুদৃশ্য হইয়াছিল।