পুনৰ্ব্বার তিনি, যশোবতী, বৃদ্ধকে নিরীক্ষণ করিলেন।
পাতার ফাঁক দিয়া কঠোর সূৰ্য্যালোক পড়িয়াছে, বৃদ্ধের নাক দিয়া কাঁচা জল গড়াইতেছে, এবং অন্যান্য সকল কিছু শব্দকে পরাজিত করিয়া গাল চোষার আওয়াজ ক্রমবর্ধমান, তদ্দর্শনে ডুলিস্থিত প্রতিমা চৈত্রের পাতার মত কম্পিত, তাঁহার জ্ব-যুগলে যেন গুণ টানা হইল। দৃষ্টিকে ছাড়াইয়া চক্ষুদ্বয় আগাইয়া আসিতে চাহিল।
“সীতারামের বেশ জ্ঞান আছে, বিয়ের সময়ও উঠে বসবে, তুমি গিয়ে সীতারামের সঙ্গে একটু কথা বল, মেয়ে দেখে ওর পছন্দ হয়েছে কিনা…” নির্লিপ্তভাবে কৃষ্ণপ্রাণ ইহা বলিয়া লক্ষ্মীনারায়ণের নিকট দায়িত্বজ্ঞানের পরিচয় দিলেন। প্রথমতঃ ইহা যথারীতি আচারবিরুদ্ধ, তাহা কোনক্রমে মনে হইল না।
এই কথা কয়টি যশোবতীর যৌবন উচ্ছল শরীরখানিকে যেন বা নিঙড়াইয়া দিল, তাঁহার কণ্ঠ মধ্যে পাখীর বাসার স্বাদ ও গন্ধে রুদ্ধ, তাঁহার মুখোনি ডুলির পর্দার আড়ালে চকিতে অদৃশ্য এবং পরক্ষণেই মুখমণ্ডলের অর্ধভাগ পরিদৃশ্যমান হইল। অচৈতন্য হইবার পূর্বলক্ষণ জানিয়া পিতা লক্ষ্মীনারায়ণ সত্বর আসিয়া কন্যাকে ডাকিলেন, “যশো, যশো!”
যশোবতীর আয়ত চক্ষুদ্বয় এখন উন্মীলিত, তিনি আপনার আদরের পৃথিবী দেখিলেন, যে পৃথিবী শূন্যতার, সৌন্দর্য্যের, বাস্তবতার আধিভৌতিক সমস্যা এবং শুধুমাত্র তিনি উচ্চারণ করিলেন, “বাবা!”
এই স্বরের মধ্যে বিড়াল ও পাখীর ঘোরতর যুদ্ধের আওয়াজের রেশ ছিল। মুক্তাসদৃশ দন্তপাতি দিয়া তিনি তাঁহার নিম্ন ওষ্ঠ চাপিয়া ধরিলেন, এমত সময়ে মানসচক্ষে দেখিলেন, এক বৃক্ষ, শিকড় যাহার উচ্চে, শাখা নিম্নে, এবং পুনরায় তিনি, সমুদয় তাঁহার কাছে!
.
“আয় মা আয়, আমার মান রক্ষা কর।” তাহার পর ধীরে ধীরে সান্ত্বনার ছলে বলিলেন, “মঙ্গল কাজের সময় চোখের জল ফেলতে নেই মা।”
যশোবতী পিতার মুখের দিকে চাহিয়া নিজের দুর্বলতার হেতু সত্যই লজ্জিতা হইলেন, অত্যধিক দৃঢ়তার সহিত জুলির বাঁশ চাপিয়া ধরিয়াছিলেন, ফলে হাত ছাড়াইয়া লইবার পরেও হাত অৰ্দ্ধ উন্মুক্ত হইয়া রহিল। কন্যাকে ধরিয়া লক্ষ্মীনারায়ণ মাদুরের উপর বসাইয়া দিলেন।
এইস্থানের পরিবেশ দেখিয়া আপনার হতভাগ্যের কথা ভাবিবার মত কোন মনোবৃত্তি যশোবতী খুঁজিয়া পাইলেন না। শুধুমাত্র চক্ষু বুজাইয়া ঘুম চাহিলেন।
.
বাজনদারদের তখনও স্বাভাবিকভাব ফিরিয়া আসে নাই। কৃষ্ণণ কন্যাপক্ষের হইয়া তাহাদের ধমক দিলেন, তাহারা যুগপৎ নানাবিধ শব্দ করিয়া উঠিল; নাপিত সত্বর ক্ষুরে ধার দিতে লাগিল, তাহার মাথায় কৃষ্ণপ্রাণ গঙ্গাজল দিয়া শুদ্ধ করিয়া বলিলেন, “হরেরাম, নাপিতকে নিয়ে যাও বলরাম তুমি ওখানটা পরিষ্কার কর।”
দ্রুতগতি কাজ শুরু হইয়া গেল। লক্ষ্মীনারায়ণ ছাতার আড়া হইতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মোড়ক, ডুলির বাঁশ হইতে হাঁড়ী কলস নামাইলেন, কৃষ্ণপ্রাণ কলাপাতা কাটিলেন। সকল কিছুর ব্যবস্থা হইল।
যশোবতাঁকে যখন তাঁহার পিতা ডাকিতে আসিলেন তখন তিনি ডুলির উপর মাথা রাখিয়া প্রশান্তচিত্তে ঘুমাইতেছিলেন। পিতার ডাকে উঠিয়া বস্ত্রাদি সম্বরণ করিয়া একটি হাই তুলিবার কালে চারিদিকে তাঁহার দৃষ্টি পড়িল। আলস্যত্যাগ করা আর হইল না। কিছুকাল স্থির থাকিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া পিতার দিকে শিশুর মতই তাকাইলেন। অনন্তর শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করিলেন, “কি করবো?”
“তাড়াতাড়ি নে মা, লগ্নের আর দেরী নেই।”
নাপিত তাহার ছোট বিলাতী আয়নাখানি এখানে বসাইয়া দিয়া গেল। যশোবতী ধীরে ধীরে সাজিতে লাগিলেন। দেহ কাঁপিয়া কাঁদিয়া চমকাইতেছিল, কপোল বহিয়া অশ্রুধারা বর্তমান, কিন্তু তথাপি মনে হয় যেন ক্রন্দনের সেই মনোভাব নাই; কেননা তিনি, যশোবতী, গঙ্গার জলোচ্ছ্বাসে পুনঃ পুনঃ শুনিয়াছিলেন, “হে কৌন্তেয়–হে কৌন্তেয়! সাক্ষাৎ ভগবান আপনার প্রাণপ্রিয় সখাকে যেন ডাকিতেছেন। হঠাৎ দেখিয়াছিলেন, কে যেমন বা নাড়ীসমূহ লইয়া নেতি ধৌতি করিতেছে।
চতুর্দিক অবলোকন করত যশোবতী বলিয়াছিলেন, এ কি খেলা! এবং শ্মশানের ধূম তাঁহাকে মলিন করিতে পারে নাই।
যশোবতী বধূবেশ আপনি ধারণ করিলেন।
৩. বরবেশে সীতারাম সত্যই আকর্ষণীয়
বরবেশে সীতারাম সত্যই আকর্ষণীয় হইয়াছিলেন; কেবলমাত্র ক্রমাগত গাল চোষা ছাড়া তাঁহার মুখে অন্য শব্দ ছিল না। বলরাম পিছন হইতে তাঁহাকে বেশ কিছুটা তুলিয়া ধরিয়াছে। এখন তাঁহাদের পরিক্রমণ করিয়া সাত পাক চলিতেছে, সীতারাম অনেকবার আপনার ভারাক্রান্ত মুখোনি তুলিয়া ধরিয়া দেখিতে চাহিলেন, ফলে তাঁহার দুর্বল স্কন্ধই কাঁপিয়াছিল।
শুভদৃষ্টির কালে, লক্ষ্মীনারায়ণ কন্যাকে বরের দিকে ভাল করিয়া চাহিয়া দেখিতে অনুরোধ করিলেন। সীতারাম যশোবতাঁকে দেখিতেই গাল চোষার গতি বাড়িয়া গেল, বৃদ্ধ যেন উত্তেজনা সহ্য। করিতে পারিলেন না, অপ্রকৃতিস্থ হইয়া আপনার পুত্রের হাতে মাথা হেলাইয়া দিলেন, কে জানে হয়ত আপনার প্রৌঢ়ত্ব পার হইয়া যৌবনের উপর হেলিয়া পড়িতে চাহিয়াছিলেন! কিয়ৎকাল এইভাবে অতিবাহিত হইল। তিনি আবার ফিরিয়া আসিলেন। তাঁহার হস্তে মালা দেওয়া হইল, জরাগ্রস্ত হস্ত মালা লইয়া আগাইতেছিল, সহসা কোথা হইতে কাশি আসিল, তবুও বৃদ্ধ মালা পরিত্যাগ করেন নাই, কিন্তু আর সম্ভবপর হইল না; দমকা হাওয়া তাঁহার হাত হইতে মালা খসাইয়া লইয়া গেল। সকলকে আশ্চৰ্য্য করিয়া মালাটি ধরিবার জন্য সীতারামের বাহু প্রসারিত হইয়াছিল, মালা দূরে গেল, হরেরাম মালা আনিতে ছুটিল কিন্তু অবলীলাক্রমে বৈজুর ছাগল সে মালাখানি সদ্ব্যবহার করিতে তখন মুখ আগাইয়া দিয়াছে।