কমলকুমারের সমস্ত রচনার উপাদান দেশজ এবং মূলত গ্রাম ভিত্তিক। আমাদের সাহিত্যে গ্রাম বাস্তবতা বড় বেশি গ্রাম্য এবং আঞ্চলিক শব্দে কণ্টকিত। কমলকুমার গ্রামের মানুষদের তুলে দিয়েছেন উচ্চ পর্যায়ে, তারা হয়ে গেছে চিরকালীন মানুষ। খেলার প্রতিভা উপন্যাসে একটি মৃত ভিখিরির লাঠিটা নিতেও যাদের বিবেক-দ্বন্দ্ব হয়, তারা অনায়াসেই মহাভারতীয় চরিত্র হয়ে ওঠে।
তাঁর ভাষা শুধু সাধু বাংলা নয়, বাক্য বিন্যাস একেবারে স্বতন্ত্র। তিনি যে সাবলীল, ঝকঝকে চলিত ভাষাও লিখতে পারতেন, তার অনেক নিদর্শন আছে। বড় পত্র-পত্রিকায় শিল্প সমালোচনা এবং নানা বিষয়ে নিবন্ধ লিখতেন চলিত ভাষায়। কমলকুমারের বয়েসী অনেক লেখকই সাধু বাংলা চিরতরে পরিত্যাগ করে চলে এসেছিলেন চলিত অষায়, দৃষ্টান্ত ও প্রেরণা স্বরূপ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু কমলকুমার সাধু ও চলিত এই দুটি বাংলাই পোষণ করেছেন। অর্থাৎ, উপন্যাস-গল্পের ভাষা সম্পর্কে তাঁর বিশেষ চিন্তা ছিল, এ ভাষায় দায় নেই সহজ বোধ্যর, এ শিল্প-নির্মাণের ভাষা, যে-কোনো উচ্চাঙ্গ শিল্পের মতনই এর রস গ্রহণ করার জন্য পাঠকদের দীক্ষিত হতে হবে। যেহেতু কমলকুমারের ভাষার আর কোনো পূর্ব-নজির নেই, অন্য কোনো লেখকের সঙ্গেই তাঁর ভাষার তুলনা চলে না, তাই কমলকুমারের রচনাই বারবার পড়ে এর মর্ম উদ্ধার শিখতে হবে। সেই জন্যই কমলকুমারের যে-কোনো রচনাই বারবার পড়তে হয়।
তিনি নিজে অনেক সময় বলতেন, বাংলা গদ্যের সিনট্যাক্স হুবহু ইংরেজি গদ্যের অনুকরণে, তিনি সেই প্রথা ভেঙে ফেলে ফরাসি গদ্যের প্রকরণ আনতে চান। তাঁর এই উক্তি আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। লিঙ্গ ভেদ কিংবা একবচন-দ্বিবচন বহুবচন অনুযায়ী ক্রিয়াপদ বাংলায় কোনোক্রমেই সম্ভব নয়, এ ব্যাপারে বাংলা সংস্কৃত থেকেও পৃথক। বিশেষণের সংস্থানের অদল বদল, যেমন কালো বেড়ালের বদলে বেড়াল কালো, ফরাসি অনুযায়ী এমন ব্যবহার কোথাও কোথাও আছে মাত্র। অন্য ভাষার অনুসরণে নয়, সম্পূর্ণ অভিনব বাকভঙ্গি নির্মাণেরই দুঃসাহস দেখিয়েছেন কমলকুমার। এ ভাষা অবশ্যই অনবদ্য কিন্তু বাংলা গদ্যের অন্তর্গত হবার মতন নয়। আর দ্বিতীয় কোনো লেখকের পক্ষে এই ভাষা রীতি গ্রহণ করা অসম্ভব। কেউ কেউ কিছুটা চেষ্টা করেও পশ্চাৎ অপসরণে বাধ্য হয়েছেন, এমন দেখেছি। এ এক আশ্চর্য মিনার, যা বাংলা সাহিত্যে চিরকাল স্বতন্ত্র হয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকবে। জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে কমলকুমারের তুলনা একারণেই মনে আসে। গদ্যে নয়, দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ থেকে জীবনানন্দ যে কাব্য ভাষা গ্রহণ করেছিলেন, তা অননুসরণীয় এবং বাংলা কবিতায় তা পূর্বাপর রহিত। জীবনানন্দীয় গোত্রের দ্বিতীয় কোনো কবিকে খোঁজা নিরর্থক।
একটি ছোট অথচ মনোযোগী পাঠকগোষ্ঠী তৈরি করবেন বলেই যেন কমলকুমার তাঁর কাহিনীগুলিতে ভাষার বর্ম দিন দিন আরও সুদৃঢ় করেছেন। তাঁর উপন্যাসগুলির মধ্যে তুলনামূলক ভাবে ‘গোলাপ সুন্দরী’র ভাষা ততটা দুর্বোধ্য নয়, মাঝে মাঝেই ঝলসে ওঠে কবিত্বের মাধুর্য। ‘গোলাপ সুন্দরী’ পড়ার পর ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ ফিরে পাঠ করলে অনেক জট খুলে যায়। ‘অন্তর্জলী যাত্রা’র বিশ্বস্ত ভাবে চলচ্চিত্র রূপ দিয়েছেন গৌতম ঘোষ, সেটি যারা দেখেছেন, তাদের আর কাহিনী অনুসরণে কোনো অসুবিধে হবার কথা নয়। তবু, কাহিনী জানা সত্ত্বেও এর ভাষা সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য এ উপন্যাস বারবার পড়া যায়। সব সাহিত্যেই এরকম দৃষ্টান্ত খুব কমই থাকে।
অনেক লেখকেরই প্রথম জীবনের তুলনায় পরবর্ত্তীকালের ভাষা ক্রমশ সরল হয়ে আসে। কমলকুমারের সব ব্যাপারেই বিপরীত যাত্রা। তৃতীয় ও চতুর্থ উপন্যাসে তাঁর ভাষা আরও জটিল হয়েছে, যেন তিনি খেলা করছেন পাঠকদের সঙ্গে, কিংবা তাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন। কেননা কোনো বাক্যে রেখে দিচ্ছে ব্যাসকুট। পঞ্চম উপন্যাস ‘সুহাসিনীর পমেটম’-এ এই রচনা প্রক্রিয়া আমি নিজেই প্রত্যক্ষ করেছি। লেখাটি সম্পূর্ণ হবার পরেও তিনি আঙ্গিক বদল করছেন বারবার। ছোট ছোট বাক্যগুলি তিনি জুড়ে দিলেন অসমাপিকা ক্রিয়ায়, তারপর বলতে গেলে বাক্যই থাকছে না, পাতার পর পাতা পূর্ণচ্ছেদহীন ঠাসা রচনা। আর সময় নেই বলে আমি যখন তাঁর কাছ থেকে শেষ পাণ্ডুলিপি কেড়ে নিয়েছি কৃত্তিবাস পত্রিকায় প্রকাশের জন্য, তারপরেও তিনি চুপি চুপি প্রেসে গিয়ে প্রচুর পরিবর্তন করেছেন, প্রফের পৃষ্ঠা কণ্টকিত করে তিনি সব সরলকে করেছেন জটিল, পরিবর্তিত প্রত্যেকটি শব্দ আগেরটির চেয়ে কঠিন।
কঠিন বলতে কিন্তু আভিধানিক শব্দ বোঝায় না। ব্যবহারের অনন্যতা। বাঙালি পাঠক তাতে অনভ্যস্ত বলেই হোঁচট খায়। যারা তাতে পেছন ফেরে, তারা কমলকুমারের পাঠক হবার যোগ্যতা তখনো অর্জন করেনি, বুঝতে হবে। যারা কাব্যপাঠে অভ্যস্ত, তারাই এগিয়ে যেতে পারে। এ ঠিক গদ্য নয়, কাব্যের সৌরভ সর্বত্র অথচ চকিতে এক একটি দেশজ শব্দ এসে ঘোর ভেঙে দেয়। “ঐ চন্দ্রালোক, তাহারা নিজেদের বড়ই ঘোলা বুঝিতে আছিল; নদীর ঝিল্লির ইত্যাদির আওয়াজ তাহাদের জানিত সমস্তবিধ শব্দের বাচকতাকে নষ্ট করিয়াছে; বস্তু দর্শনে নাম, নাম শ্রবণে বস্তু মনেতে আসে না; প্রায় প্রত্যেকেই এমন অবস্থা আপন অজ্ঞাতসারেই টের পাইতেছিল।” (খেলার প্রতিভা) এই যে ‘শব্দের বাচকতা’ এটা কমলকুমারের ভাষার সঠিক পরিচয়।