এ হেন ডাক অধুনা হাওয়া সংখ্যার মত ভাস্বর, ক্রমে ক্রমে বৈজু শুনিয়াছিল এবং এই প্রথম, হয়ত বা, সে আপনকার পিছনে যাইতে সক্ষম হইয়াছিল। যেখানে সে সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ লাভ করিয়াও অপটু। যেখানে সে ক্রন্দনে সৰ্বরূপে দক্ষ, কেননা তাহাই উহার একমাত্র ভগবদ্দত্ত ক্ষমতা। আপনার নগ্নতা যেখানে সূর্যের আলঙ্কারিক বিচিত্রতা, আর একটা দিক।
কিয়ৎক্ষণ ধান্যক্ষেত্রের প্রতি তাকাইয়া সহসা হঠাৎ বৈজু ভেড়ী পথ হইতে ভয়ঙ্কর ভাবে চীৎকার করিল, “ওগো তোমাদের পুণ্যাত্মা বুড়ার ক’নে আসছে”, এদিকে শ্মশান যাত্রীদের বলিল, “বস গো বস, এনেছ তো মড়া, কাঠ তো এলো না এখনও, কত ধূম হবে, কত লাচনা গাওনা হবে, দেখবে না?” ইহার পরে সুরে গাহিল,
“তুমি আমার বাবার ঠাকুর,
টোপর মাথায় দিয়ে এলে,
বুড়ী হয়ে বসে থাক প্রাণ,
মাঝে মাঝে এসে ছোঁব–
তুমি আমার বাবার ঠাকুর”
ভেড়ীর উপরেই বৈজুনাথ নৃত্যের ভঙ্গী দেখাইয়া তেহাই দিল। বৃদ্ধ ব্যতীত সকলেই তাহার এই অসভ্য গান শুনিল, হরেরাম হাসিতে গিয়া গম্ভীর।
শ্মশান্যাত্রী দলের অযোগবাহশব্দ স্পষ্ট আপ্লুত স্বর স্বাভাবিক হইয়াছিল। শবের পাটছোঁয়া লোকটি বলিল, “সে কি গো, বউ? বিয়ের কনে!” এবং পরক্ষণেই আপনার অসংযম স্মরণ করিয়া সহসা উচ্চৈঃস্বরে, “ওগো খুড়ো গো” বলিয়া কাঁদিয়া উঠিল।
‘ক’নে গো ক’নে, বাবা পঞ্চমুণ্ডি লেমিনাথের লৈবিদ্যি…”
“বলে কি!”
বৈজুনাথ কলমকাটা ভেড়ী পথ বাহিয়া নামিয়া আসিয়া ঘোট দৌড়ে এখানে উপস্থিত হইয়া স্ত্রীলোকের মত ভান করত কহিল, “ওমা, অবাক বললে বাছা! বাছা, বলি তোমার কি জাত গো? কেনে, শোন নাই…বামুন কায়েতের ঘরে সব সময় হয়…” বলিয়া ঝুমুরওয়ালী কেষ্টদাসীর মত ভান করিয়াছিল।
“এই শ্মশানে?”
এ বাক্যে বিস্মৃতি; যে লোকটি এ কথা বলিয়াছিল সে চির-চেনা একটি অন্ধকারকে ইদানীং অপরাহের আলোকে যাহা রেখাবৎ–তাহাকে পথ ছাড়িয়া দিল। যাহা সর্পগতিতে দূর কোন রক্তস্রোত দর্শনে অদৃশ্য।
‘শ্মশান’ কথাটা শুনিয়া বৈজুনাথ শ্লেষ্ময় ভারাক্রান্ত, কটাক্ষ করিতে উন্মত্ত হইয়া উঠিল, “তবে! পরলোকে সংসার কি খামার বাড়ী থেকে পাতবে? এই লাও! এই তার চারবাগাল বাড়ী, চালাকাঁৎ ঘর গো…” বলিতে বলিতে পশ্চিমে ফিরিয়া তাকাইল। কেননা বিরক্তিকর বাজনা এখন অতীব নিকটে।
ভেড়ীর একস্থানে শ্মশানে আসিবার সঙ্কীর্ণ পথ বৰ্ত্তমান, ইহার পুনরায় হঠাৎ বেশ প্রশস্ত স্থান সিঁড়ির মত এবং নীচে শ্মশান ভূমি।
এক একজন বাজনদার বেসামাল পায়ে নামিল। তাহার পর মুরারী নাপিত; তাহার পর লক্ষ্মীনারায়ণ দ্রুতপদে আসিয়াই পিছন ফিরিয়া বাঁশের ছাতা ঘাড়ে করিয়া ডুলি বাহকদের নির্দ্দেশ দিতে লাগিলেন, কিন্তু দেখা গেল ডুলি বাহকের পরিবর্তে একজন কাঠ লইয়া আসিতেছে। লক্ষ্মীনারায়ণ বলিলেন, “আঃ তুমি আবার কোত্থেকে এলে হে? একটু সবুর সয় না…”
সে কহিল, “বাঃ মড়া পড়ে আছে…”
লক্ষ্মীনারায়ণ তাহার কথায় নারায়ণ নারায়ণ’ করিয়া বলিলেন, “যত অলুক্ষণে কাণ্ড, যাও যাও ওরে তুই খুব সাবধান গা, দেখিস…হা হা কোন বিঘ্ন না হয়, আয় আয়…,
.
সঙ্কীর্ণ পথ, একটি ডুলি দেখা গেল।
সুন্দর লাল কল্কা ছাপ ‘আরকট ছিটের কাপড়ের মধ্যে অসম্ভব করুণ স্তিমিত ক্রন্দনের শব্দের আধার এই ডুলিখানি, জালা যেখানে রাখা সেখানেই সন্তর্পণে রাখা হইল।
এইস্থান হইতে বুড়া সীতারামকে–তথা বরকে স্পষ্ট দেখা যায়।
লক্ষ্মীনারায়ণ এখন তৎপর, ডুলির খুরা হইতে একটি কাঠি মাদুর বাঁধা ছিল, খুলিয়া লইয়া এখানে পাতিলেন। এখনও সীতারামের মাথার উপর হইতে ছাউনি, যাহা দুপুরের রৌদ্রের জন্য খাটান হইয়াছিল, তাহা খুলিয়া লওয়া হয় নাই। পুরোহিত বৃদ্ধের কানের তুলা খুলিয়া, “সীতারাম, ক’নে এসেছে” বলিয়া উঠিয়া, লক্ষ্মীনারায়ণের নিকটে আসিলেন। ডুলির মুখের পর্দায় ‘অযোধ্যায় রাজকৰ্ম্ম ব্যাপৃত রামচন্দ্র পার্শ্বে সীতা’ ছাপা, সেখানে, ইহার সম্মুখে লক্ষ্মীনারায়ণ দাঁড়াইয়া আপন কন্যাকে আহ্বান করিলেন, “এস মা এস।”
কিয়ৎক্ষণের পরে বলিলেন, “লজ্জা কি মা যশো…নেমে এস” ইহার পর নিজেই অধৈৰ্য্যতার সহিত ডুলির পর্দা খুলিয়া দিলেন। যশোবতাঁকে দেখা গেল।
অনিন্দ্যসুন্দর একটি সালঙ্কারা কন্যা প্রতীয়মান হইল, ক্রন্দনের ফলে অনেক স্থানের চন্দন মুছিয়াছে, আকর্ণবিস্তৃত লোচন রক্তাভ, হলুদ প্রলেপে মুখমণ্ডল ঈষৎ স্বর্ণসবুজ। সৰ্ব্বলক্ষণে দেবীভাব বৰ্ত্তমান, ফলে সহজেই মনে হইবে এ যেন বা চম্পক ঈশ্বরী, লক্ষ্মী প্রতিমা। শুধুমাত্র মুখোনি জন্ম দুঃখিনীর মতই বিষাদময়।
বৃদ্ধ সীতারাম কোনক্রমে মুখ আড় করিলেন, ক্রমাগত নিজের গাল চুষিবার শব্দ, সহসা কিঞ্চিৎ লালা গড়াইল, তিনি দেখিলেন, পটে আঁকা একটি ষড়ঐশ্বৰ্য্যময়ী দেবীমূৰ্ত্তি, এখন তাঁহার পায়জোড় পরিহিত পা মাটিতে ছোঁয়ান, দুটি হাতে দুইদিকের ডুলির চৌকার বাঁকা ধরিয়া আছেন।
এই ডুলির পশ্চাতে বাজনদাররা এ দৃশ্যে, বৃদ্ধদর্শনে, বাজনা ভুলিয়া গেল। কেহ ফুঁ দেয় আবার ঠিক হয়, কেহ বেতালা ঢাক বাজায়, কাঁসি খন খন বাজিয়া উঠে।
যশোবতী বৃদ্ধকে দেখিয়াই চক্ষু তুলিলেন, সীতারামের পিছনে, নিম্নে প্রবাহিণী গঙ্গা। দেখিলেন, স্রোতে গলিত দেহেশকুন বসিয়া মনঃসংযোগ করিতে চেষ্টা করিতেছে, তাহারই পার্শ্বে চক্রাকারে ঘুরিয়া । কাক তাহাকে বিরক্ত করে। বেলাতটে একটি অকেজো ভাওলিয়া, যাহার গায়ে মেটে সিন্দুর দিয়া আঁকা চক্ষু, নিম্ন দিয়া ধ্বনিসহকারে জল বহিয়া যাইতেছে। ক্কচিৎ জলজ পানা।