“এ্যাঁ”…
“হ্যাঁ হ্যাঁ…”
লক্ষ্মীনারায়ণ যে কি করিবেন তাহা ঠিক পাইলেন না। মাটি দেখিলেন, আকাশ দেখিলেন, পৈতা দেখিলেন, তাহার পর অদূরে গঙ্গা, পাগলের মতই দৌড়াইয়া গিয়া, “মাগো মা মা, এতদিন বাদে দয়া করিলে মা” বলিয়া হাত দিয়া জল মাথায় দিতে গিয়া, হঠাৎ গঙ্গায় নামিয়া অনবরত ডুব দিতে লাগিলেন। তাহার কিয়ৎক্ষণ পরেই উঠিয়া আসিয়া, জলসিক্ত বসনে, রুদ্ধকণ্ঠে প্রশ্ন করিবেন বলিয়া মুখ খুলিলেন, কিন্তু ওষ্ঠদ্বয় বাঁকিল কিন্তু শব্দ বাহির হইল না। এমত সময় ইষ্টদেবতা স্মরণ নিমিত্ত হাতখানি বক্ষের নিকটে স্থাপিত ছিল।
“কি, এই শ্মশানঘাটে স্নান করলে? মাথা খারাপ না কি?কি বল…?”
“হবে ত…” লক্ষ্মীনারায়ণের তখনও প্রত্যয় হয় নাই।
“সীতারাম নিজে রাজী, আবার…! কিন্তু হ্যাঁ, একটা কথা কি জান তোমায় বলে রাখা ভাল, এখনি কথা হচ্ছিল, কি হে বলরাম…কি বল আগের কালের মত ধৰ্ম্ম সত্যরক্ষা একালে নেই, বিয়ের পর তোমার যদি…”
“দেখবেন ঠাকুর মশাই, আমার মেয়ে তেমন…”
“তা নয়, কোম্পানীর রাজত্ব, ঘোর কলি, সহমরণে যে পুণ্য আছে একথা কেউ বিশ্বাস করে কি…যাই হোক…যদি না হয় তোমাকে নিতে হবে…শেষে স্ত্রী বলে একটা মামলা রুজু করে দিলে, এরা বলছে। ব্রাহ্মণের দায় উদ্ধার করতে গিয়ে…”।
“আপনি আমায় তামা তুলসী দিন, গঙ্গা আছেন, আমি…” লক্ষ্মীনারায়ণের সখেদ উক্তি শোনা গেল।
দূর হইতে কবিরাজের কণ্ঠ আসিল, “আর প্রয়োজন নেই, অল্প বয়সী বিধবার ভার কোন বাপ নেয়, আমি বুঝি না।” নিম্নকণ্ঠে মনে হয় বৈজুকে কহিলেন, “একবেলা খাওয়া উপোস, চুল কপচে দেবে, তবু সন্দেহ ঘোচে না…ইস, কিছু করবার যো নেই…”
“ঠাকুর মশায় বারুণ কর তুমি”–বৈজুনাথ অনুরোধ করিয়াছিল।
“বারুণ কে শুনবে? কৃষ্ণপ্রাণ, জ্যোতিষী অনন্ত এদের ত লাভ–সতীদাহ যখন হয় তখন।”
“হাঁ হাঁ জানি জানি, বলবে সোনা ছাড়া স্বগ্যে কিছু যাবে না, ওগো সোনা দাও, অক্ষয় স্বগ্য বাস…সোনা…আমায় বলবে, তুই শালা চাঁড়াল, বামুন কায়েতের সতী, এর ছায়া মাড়াবি না…তারপর চিতা লিভিয়ে সোনা খুঁজবে, আমায় বলবে বেশী গর্ত কর।”
“তা কেন বলবে না, যদি থানাদার…”
“কি হত? সে শালা ঘুষ লিত…”
একথায় বিহারীনাথ অন্যমনস্ক হইয়াছিলেন।
বৈজু মহাআক্রোশে বলিল, “একটু উঁচুজাত না হলে শালা আমি লাঠি ঘুরাতাম…”
“চুপ চুপ…”
“না, বড় প্রাণে লাগে, তোমরা ভাব আমি চাঁড়াল–মড়া দেখতে আমার বেজার নাই, সত্য, কিন্তু কেউ মরছে দেখলে বেজার লাগবে না…” থামিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, “আমি চিতা সাজাব, সব পাপ আমার লাগবে, সেই পাপে বউটাকে কুমীরে নিয়ে গেল…”
কবিরাজ উঠিয়া কাহারও কাছে বিদায় গ্রহণ না করিয়া চলিয়া গেলেন–বৈজুও উঠিয়া মাটিতে একটি লাথি মারিল, তাহার পর বলিল, “কি ঠাকুর, কি হল…?”
লক্ষ্মীনারায়ণ যাইতে যাইতে বলিলেন, “হয়েছে, তোকে পেট ভরে খাওয়াব।”
“খাওয়া ছাড়া আমার কি আছে ঠাকুর!”
বেলা এখন প্রায় শেষ! একটি চিতার কোণে প্রজ্বলিত কাঠের উপরে হাঁড়ি টগবগ করিয়া ফুটিতেছে, এক একটি সুসিদ্ধ চাল লাফাইয়া উঠে; বৈজু ‘এ দেহ তরণী ডুবে যাবে’ গাহিতে গাহিতে একটি কঞ্চি দিয়া ভাত তুলিয়া দেখিবার সময় কান খাড়া করিল। কপাল কুঞ্চিত করিয়া কি যেমন একাগ্র মনে শুনিবার চেষ্টা করিতে লাগিল।
দূরাগত শব্দ আসিতেছে, সম্মুখে স্রোতময়ী গঙ্গার কল্লোল, পাতায় পাতায় হাওয়ার চপলতা সেশব্দকে ক্রমাগত বাধা দিতেছিল; বৈজু একান্তে ভাতের কাঠি রাখিয়া, অল্প শতচ্ছিন্ন চ্যাগড়া কুড়াইয়া হাঁড়ি ধরিয়া ফেন গালিতে লাগিল। এতাবৎ দূরাগত শব্দ এক্ষণে কিঞ্চিৎ স্পষ্ট রূপধারণ করিল, শোনামাত্রই বিরক্তি-উৎপাদনকারী ক্রমান্বয় দেশাড়ী সানাইয়ের আওয়াজ ঢাক ভেদ করিয়া ট্যাঁ ট্যাঁ করিয়া উঠিতেছে, আর ট্যাং ট্যাং করিয়া কাঁসির বজ্জাতি; বৈজু আর স্থির থাকিতে পারিল না। কোনমতে হড়মড় করিয়া ফেন গালাইয়া, আড়ায় রাখিয়া পরক্ষণেই দৌড়াইয়া গিয়া উচ্চ ভেড়ীর উপর উঠিল।
সম্মুখের দূরান্ত নিখোঁজ পৃথিবী দেখিতে গিয়া তাহার অসম্ভব ঘোর লাগিল। হয়ত মনে হইয়া থাকিবে এখন সন্ধ্যা হইলে ভাল হইত। অবিশ্রান্ত দূরত্বকে সম্ভবত বুঝিয়া লইবার কারণেই আপনার ছোট সীমাকে একদা দেখিয়া লইল, যাহার নিম্নে হিম জলরেখা, অজস্র প্রতিবিম্ব-সম্ভবা। এভাবে দেখা তাহাকে কোন দিব্য-সাহস দেয় নাই–শুধু তাহার বর্তমানতা, বাস্তব, সাধারণভাবে অস্তিত্বকে স্পষ্ট করে।
বহুদুরে ধান্যক্ষেতের মধ্য দিয়া ক্ষুদ্র একটি শোভাযাত্রা আসিতেছে। বৈজুনাথ বুঝিল যে ইহা কোন নিম্নজাতির শব নহে। স্পষ্টত দেখিল মধ্যবর্ত্তী ডুলির লাল কাপড়, তাহার এক এক প্রান্তে হেমন্তের হাওয়া উড়িতেছে। সম্মুখে সানাই বাদক, কখনও বা কাঁসিবাদক আলের উপর দিয়া গমনে টাল সামলাইতে না পারিয়া ধান ক্ষেতে নামিয়া পড়িতেছে; যদিচ শরৎ চলিয়া গিয়াছে তথাপি ধান নুইয়া। পড়ে নাই–বৈজু এক দৃষ্টিতে দেখিতে দেখিতে, হায় গো’ বলিয়া আপনকার গালে দুইহাত দিয়া চপেটাঘাত করিতে লাগিল। “হায় গো বাবা পঞ্চমুণ্ডি লেমিনাথ, তোমার লৈবিদ্য, দোসর বুঝি।”
কে একজন ঘাট হইতে ডাকিল, “হেই বৈজু চাঁড়াল, ঢাকের বাদ্দি শুনলে চলবে? এদিকে মড়া পড়ে।কোথায় হে?”