বৈজুনাথ আর এক-পা ভূতচালিতের মত পিছু হটিতে গিয়া বেসামাল হইল।
কিন্তু লক্ষ্মীনারায়ণ এখনও প্রজাপতিটি লক্ষ্য করিতেছিলেন এবং অনবরত বৈজুনাথকে সরিতে বলিতেছিলেন, কারণ তাহার অঙ্গ যদি স্পর্শ করে তাহা হইলে তাহা অমঙ্গলসূচক হইবে।
কিন্তু হায়, প্রজাপতি শ্মশানে বিভ্রান্ত হইয়াছিল। তাহাকে চিতাধূমের মধ্যে দেখা গেল, অনন্তর। তাহাকে চিতার প্রায় নিকটে দেখা গেল এবং কালক্রমে সে যেন বিমোহিত হইল, রঙ হারাইল, চিতার শিখার রেখার মধ্যে অদৃশ্য হইয়া গেল। ধূম অধিকমাত্রায় নির্গতবান, ইদানীং পতঙ্গ অপ্রকট–শেষ অশ্রুজল যদি সে পতঙ্গের, বাষ্প হইয়া দূর ঊর্ধ্বে, ক্রমে শিশুর চাপল্যরীতি-মেঘকায়ানবজলধরে পরিণত, পুনশ্চ বিদ্যুল্লতায় তাহার নশ্বরতা দেখা দিবে এবং মরলোকের প্রেম সে বিভায় উদ্ভাসিত হইবে, রমণীর সৌন্দৰ্য্য ষটচক্র বাহিয়া পদ্মে মতিত্ব দিবে, আর যে আমরা স্থির হইব।
প্রজাপতি ফাঁকি দিয়াছিল। গোচরীভূত সম্বন্ধে সম্পর্কে চক্ষু হাইয়া গিয়াছে মাত্র, অনেকক্ষণ পরে লক্ষ্মীনারায়ণ এবং অন্যান্য সকলেই জমিয়া উঠা রুদ্ধশ্বাস পরিত্যাগ করিলেন। বৈজুনাথের তীব্র অথচ হতাশ স্বরে সকলেই ইহকাল ফিরিয়া পাইয়াছেন, সে বলিয়াছিল, “হায় গো, গেল গো ছাই হঁইয়ে, বীজ রাখলেন না হে–এ বড় অবাক কথা।”
মন পুনৰ্ব্বার শিরা-উপশিরায় তৎপর হইয়া উঠিল–তখনও স্তব্ধতা ছিল।
বিহারীনাথ আপনাকে সর্বপ্রথম, বিবেচনার মধ্যে পাইলেন; কিঞ্চিৎ চিন্তা করিয়া কহিলেন, “তাহলে জ্যোতিষী, দোসর তো নেবেই” এই বাক্যে নিঃশ্বাসের আওয়াজ ছিল, ইহার পর যোগ দিলেন, “তাহলে আর কি, তাহলে, মহাব্যোম বড় ‘একা’ জায়গা, অবশ্য প্রকৃতি সেখানেও আছে, দোসর দেখলে চিনে নেবে সীতারাম…বৈকুণ্ঠ বাস হবে।”
সকলেই বিহারীনাথের কথা বুঝিবার ভাণ করিলেন মাত্র। বিহারীনাথ তাহা বুঝিতে পারিলেন না, তিনি নিজের মনোভাবকে আরও রূঢ় করিয়া বলিলেন, “সাতশ’ মন কাঠ যোগাড় কর, সাত বেড়া পেরোতে হবে ত…” অতঃপর সঞ্চিত উষ্ময় দাঁতে দাঁত ঘষিতে লাগিলেন, এই যন্ত্রণাদায়ক বিরক্তিকর শব্দ সকলকেই বিশ্রী করিয়া তুলিয়াছিল।
তটপ্রপাতে তীরবাসীরা যেমত আতঙ্কিত হয়, উৎসাহী ব্যক্তিরাও তেমনি হইয়াছিলেন। একে অন্যের মুখপানে তাকাইয়া পরে অন্যমনা। অনন্তহরি একস্থ, খুব ধীরে আপনার ওষ্ঠের একান্ত ফাঁক করিয়া, একটি ভ্র উঁচু করত কহিলেন, “কবিরাজ মশাই, আপনার নাতির শ্বশুরের কোন এক আত্মীয় ফিরিঙ্গী ভাষা জানে তাই আপনি…” ইহার পর কণ্ঠস্বর আরও দৃঢ় করিয়া বলিলেন, “এ ব্যবস্থা আজকার নয়, মাদ্রীকে মনে পড়ে…”
এই শ্লেষে বিহারীনাথ চকিতেই মুখ ফিরাইয়া জ্যোতিষীর প্রতি কঠিনভাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন। জ্যোতিষীর ঠোঁটে কুঞ্চিত-হাসির রেশ ছিল, তাঁহার প্রতিপক্ষ যে সঙ্কটাপন্ন তাহা বুঝিয়া লইতে তাঁহার বিলম্ব হয় নাই, এবং তিনি সদম্ভে ঘোষণা করিলেন, “দোসর সীতারাম নেবেই, এ কথা ধ্রুবসত্য, মঙ্গল রাহু বৃহস্পতি ঘর…”
বিহারীনাথ আপনার ক্রোধ শান্ত করিতে সমর্থ হন নাই। বিবাহের প্রস্তাবে এতাবৎ একমাত্র তিনিই বাধা দিয়া আসিয়াছেন, এখন তাঁহার পরাজয় অবধারিত বুঝিয়া তাচ্ছিল্যভরে কহিলেন, “অবশ্যম্ভাবী…”
“শিবের কলম…”
“শিবের কলম, আপনারা দেখছেন সীতারামের কৰ্ম্মপাশ ক্ষয় হয়ে এসেছে…”
“ছিঃ ছিঃ কবিরাজ মশাই, সীতারামবাবুর জ্ঞান ফিরে এসেছে…সে শুনতে…” লক্ষ্মীনারায়ণ কোন রকমে বলিয়া ফেলিলেন।
“আঃ সত্য কথা ত…”
“বুঝলাম, বুঝলাম কবিরাজ মশাই, কিন্তু আমি কি মহাপাতক হব! আপনিও ত বর্ণশ্রেষ্ঠ, আপনিও কন্যার পিতা”–লক্ষ্মীনারায়ণ এই পর্যন্ত বলিয়া সাধু ভাষা খুঁজিতে লাগিলেন।
“আপনি এখানে সম্প্রদান করিলেই কি…” বিহারীনাথ বলিতে ছিলেন।
“স্বর্গ না লাভ হোক, জাতি কুলমান রক্ষা পাবে নিশ্চিত…এতে কোন সংশয় নেই”–অনন্তহরি কাতর লক্ষ্মীনারায়ণের হইয়া, কবিরাজকে বাধাদান করিলেন এবং পুনৰ্ব্বার কহিলেন, “দেশে বিদেশে পাত্র যদি লক্ষ্মীনারায়ণ খুড়ো পেত, সহৃদয় কাউকে পেত, নিশ্চয় এখানে আসত না। তারপর বিধির লিখন এমন কি স্ত্রীলোকেও জানে জন্ম মৃত্যু বিবাহ…”।
বিহারীনাথ সবই জানিতেন। সীতারামের প্রৌঢ় পুত্রদ্বয়ও পর্য্যন্ত বিবাহ করিতে স্বীকৃত হয় নাই! কেহই হয় নাই, সকলেই প্রয়োজন বুঝিয়াই বিবাহ করিবে। তথাপি কবিরাজ বলিয়া মানুষের প্রতি সংস্কার ছিল, আপনার ভিতরে কে যেমন বা আস্ফালন ব্যস্ত, তিনি আরম্ভ করিলেন, “আপনি জ্যোতিষী, তবু বুঝুন যে লোকের অহোরাত্র পার হয় কিনা…”
“অহোরাত্র নয়, চাঁদে যখন লাল পূর্ণিমা, সীতারাম পুণ্যবান, যাবার সময়েও সে মানরক্ষা করে যাবে” বলিয়া জ্যোতিষী অতি শ্রদ্ধাভরে সীতারামের মুখের দিকে লক্ষ্য করিলেন।
“কিন্তু সত্য কি কন্যার বৈধব্য-যোগ, আছে? না…” বিহারীনাথ দস্তাঘাত করিবার প্রয়াস পাইলেন।
অনন্তহরি তাঁহাকে তুচ্ছ করিয়া কহিলেন, “আগেই ত বলেছি দোসর…”
“বাঃ তাহলেই সব চুকে গেল!” পরাজিত বিহারীনাথ অদ্ভুত বিকৃত স্বরে এই কথা বলিলেন, তাঁহার মনোবৃত্তি ক্ষুণ্ণ, ক্ষুব্ধ, লজ্জিত, অপমানিত, বিপন্ন হইয়াছিল। তাঁহার রোমরাজি কণ্টকিত এবং স্বভাব নষ্টপ্রায়!