সম্ভবত একমাত্র লক্ষ্মীনারায়ণই এহেন-হাতখানির আদলে, চিতাধূমের মধ্যেও যাহা পরিচ্ছন্ন, যাহা এখন শ্বেত তখন ছায়া আবৃত, পরিব্যাপ্ত প্রকৃতির হর্ষ দেখিয়াছিলেন। তাঁহার মানসচক্ষে ক্রমে উদ্ভাসিত হইয়াছিল নামহীন পক্ষীর বক্ষদেশের উপর দিয়া, আপন ঐশ্বৰ্য্যরাশি ও বিলাসসামগ্রী লইয়া, দ্বিপ্রহরের নীল লবণসমুদ্র পার হইয়া যাইতেছে; দেখিয়াছিলেন, প্রকৃতি আপনার বিন্দুবৎ শরীর লইয়া স্বহস্তের ডম্বরু বাজাইতে বাজাইতে স্থবির পুরুষকে কেন্দ্র করিয়া নৃত্যময় পদবিক্ষেপে ভ্রমণশীলা। মানুষ বালকমাত্র, একথা মনে হয় নাই। একমাত্র তিনি, লক্ষ্মীনারায়ণ গঙ্গাতীরে আনীত সীতারামের প্রাণবায়ু নির্গমনের কালবিলম্ব-সমাচারে চোরা আনন্দের গুরুভার বহন করিতেছিলেন।
২. তীব্র কলহের অসভ্য ভয়ঙ্কর শব্দ
এমত কালে তীব্র কলহের অসভ্য ভয়ঙ্কর শব্দে সকলেই শশব্যস্তে, ব্যগ্রতা সহকারে মন ফিরাইলেন। এমনকি কীৰ্ত্তন সম্প্রদায়ের প্রত্যেকেরই চক্ষু তির্যকভাবে পড়িয়া যাইতে চাহিল। দুই ভাই, বলরাম এবং হরেরাম, প্রখর হইয়া উঠিয়াছে, ক্ষুরধার বচসায় দুইজনে ক্ষিপ্ত, শির সঞ্চালনে দুইজনেই অকাতর।
হরেরাম তখন বলিতেছিল, “তুমি ওখানে বসতে পাবে না।”
“কেন পাব না শুনি…ওঃ ওনার কথায়…”
“না পাবে না…ভাব আমি ঘাস খাই…বুঝি না…না?”
“বলি বোঝাটা কি শুনি…মাঢ়ভেতো বুদ্ধি…”
“খবরদার বলছি…চোর কোথাকার!”
“এই মুখ সামলে…না হলে আমি খড়ম পেটা…”
হরেরামের উত্তর করিবার পূর্বেই বিহারীনাথ রাশভারী কণ্ঠে ধমক দিয়া উঠিলেন। “ছিঃ ছিঃ তোমরা কি মানুষ না পশু? লোকটা এখন-তখন, ছিঃ ছিঃ তোমাদের কি কোন ধম্মজ্ঞান নেই।”
দুইজনেই ধমক খাইয়া বাক্য ত্যাগ করিলেও, অস্পষ্ট ক্রোধবাচক শব্দ তখনও করিতেছিল।
“ছিঃ ছিঃ! তোমরা…”
“ও-ই ত শুরু করলে…দেখুন না সেই কখন থেকে বাবা আমার কোলে মাথা দিয়ে আছেন, তাতে আমার পা অবশ হয়ে গেছে, তাই সাড় ফিরাবার জন্য একটু আঙুল মটকাচ্ছি…অমনি…”
“আঙুল মটকাবার জন্য বাবার পিঠের তলায় তোমার হাত চাবি খুঁজছিল…”
“হরে হরে আমি পৈতে ছিঁড়ে তোমায় অভিশাপ…”
“আবার বলরাম…” বিহারীনাথ দৃঢ়ভাবে কহিলেন।
বচসা থামিল। জ্যোতিষী পুনরায় বৃদ্ধের হাতের প্রতি মনঃসংযোগ করত ধীরে ধীরে বলিলেন, “কর-কোষ্ঠীর কথা আর এক, তবু এখানেও দেখুন…কোন…”
বিহারীনাথ বৃদ্ধের হাতের দিকে শিশুসুলভ মনে দেখিতেছিলেন। এই সময় জ্যোতিষী, বৃদ্ধের দেহের উপর দিয়া, শরীরকে বাঁকাইয়া কবিরাজের কানে কানে কহিলেন, “আর একটা কথা বলি, বুড়ো সীতারাম একা যাবে না,…সৰ্বস্ব পণ করতে রাজী, কবিরাজ মশাই–সীতারাম দোসর নিয়ে যাবেই.” বলিয়া যেক্ষণে বৃদ্ধের দেহ হইতে আপনকার দেহ সরাইয়া লইলেন, তৎক্ষণাৎ সকলেই বৃদ্ধের বক্ষে, যেখানে কতিপয় রোমরাজি–সেখানে এক অলৌকিক বিস্ময়কর দৃশ্যে হতবাক আশ্চর্য্য হইলেন।
সেইখানে এক নয়নাভিরাম, বাবু, সুন্দর প্রজাপতি চুপ হইয়াছিল; সকালের রোদ এবং রোদের অভাবে যাহার মনোহারিত্ব একই। এ জীব যেমন বা সোহাগের আরশিতুল্য, ফলে সকলেরই আসক্তির পরিসীমা ছিল না। সকলেই এই সৌন্দৰ্য্য দর্শনে অভিভূতের ন্যায় ‘আঃ বিস্ময়বাচক শব্দ করিয়াছিল সকলেরই মুখ এখনও অৰ্দ্ধ উন্মুক্ত!
লক্ষ্মীনারায়ণ এই বিভূতি দর্শনে স্তম্ভিত হইলেও একমাত্র তিনিই বলিয়া উঠিয়াছিলেন “প্রজাপতি প্রজাপতি” এবং তাঁহার চোখে জল দেখা দিল।
এখনও সকলেই মোহগ্রস্ত, শুধু বৈজুনাথ কীৰ্ত্তনের দলের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি মারিয়া এই দৃশ্যটি দেখিবার চেষ্টা করিতেছিল।
এ-পতঙ্গ যে পতঙ্গ সৃষ্টির সাক্ষাৎ পরমায়ু, অক্ষর এবং রঙের মধ্যবর্ত্তী বাসনা, দুঃখীর মনচোরা ভ্রম স্বাধীনতা!
.
জ্যোতিষী অনন্তহরি ভূতাবিষ্টের মত কহিলেন, “কি(ম) আশ্চর্য! প্রজাপতি সিন্দুর।” এই দৃশ্যের সহিত তাঁহার দৃষ্টি যেমন বা জুড়িয়া গিয়াছিল, কোন ক্রমে সে-জীব হইতে দৃষ্টি ছাড়াইয়া আনিয়া কবিরাজের দিকে তাকাইলেন, বুঝা গেল তিনি অনন্তহরি, অতিশয় আহ্লাদিত হইয়াছেন। আধো আধো স্বরে, “প্রজাপতি, দোসর…দোসর নিবে” অন্যমনস্কভাবে বলিয়াছিলেন।
কবিরাজ এই যুক্তিহীন দৈব-ঘটনাকে প্রীতির চক্ষে না দেখিলেও, এ মহা আশ্চর্যে তিনি সত্যই হতবাক হইয়াছিলেন। সুন্দর তুচ্ছ পতঙ্গটি এরূপ ভয়ঙ্কর খেলা খেলিবে তাহা তাঁহার জানা ছিল না।
অনেকক্ষণ ধরিয়া সকলেই পতঙ্গটি দেখিল, এখনও যাহা স্পন্দনরহিত নির্বিকার। এ কথা নিমেষেই সকলে বুঝিল যে ইহা কোন সৌভাগ্যবতীর বারতা বহন করিয়া আনিয়াছে, জীবনই যাহার জীবিকা, উপাধান যাহার মনের কথার শ্রোতা, লতা পাতা কীট পতঙ্গ যাহার আপনজন, আপনার প্রতি বিতৃষ্ণাই যাহার কর্তব্য; যে বালিকা নিজহাতে শিব গড়িয়া ভক্তিভরে তাহার পূজা করিয়াছে, প্রণাম করিয়াছে। সেই মৃত্তিকা স্তম্ভে (!) আপনকার সুখমোক্ষ দাতাকে প্রত্যক্ষ করত আপনার জীবনে চন্দ্রালোক আনিয়াছে। সিন্দুরকে অক্ষয় করিবার মানসে কায়মনোবাক্যে দেহকে শুদ্ধ এবং মনকে সুন্দর রাখিয়াছে। এই কল্পনা লইয়া যে নিদ্রাচ্ছন্ন এই প্রজাপতি বুঝি তাহার সংবাদ আনিল!
এতক্ষণ পরে প্রজাপতি উড়িল, কীৰ্ত্তনের দল পথ ছাড়িল। ক্রমে ঊর্ধে আরও উর্ধে, নামিল, চলিল! এখন বৈজুনাথের দিকে পতঙ্গটি যাইতেই বৈজুনাথ বোকার মত সরিয়া গেল। এবং এই সময় শুনিল কে যেন হাঁকিতেছে, “আঃ মরণ, গোখোর বেটা…তোর গায়ে যেন না লাগে…”