অনন্তহরি এবং লক্ষ্মীনারায়ণের বৃত্ত ভেদ করিয়া আগমনে শুধুমাত্র যে আলোআঁধারের তারতম্য, কেবল যে স্থান পূর্ণাঙ্গ নিপট, আর সময় পরোক্ষ অনুভূতির বিষয় হইল, তাহা নহে, জাগ্রত সকলেই আপনকার দৃষ্টি তুলিয়া উহাদের মহাআবেগে আহ্বান করিল; একারণ যে, তাঁহারা মনে হয় সেই দেশ হইতে আসিয়াছেন, যেখানকার সকল সংবাদ কুশল, যেখানে বারিপাত আশাতীত, সংক্রামক ব্যাধি যেখানে নাই, যেখানে প্রতিটি চতুর্দশী বালিকাবধূ অন্তঃসত্ত্বা; ফলে তাঁহাদের দর্শনমাত্রই অনেকেরই রক্তে, স্ফীতনাসা-শঙ্খিনী-রমণীর কাম লালসা উন্মত্ত আঁচড় কাটিতে শুরু করে, সে রমণী–নিদাঘের দগ্ধ দ্বিপ্রহরে আপন স্বেদবিন্দু স্বীয় দেহহাপরি গতিচাঞ্চল্যে মদন দহনে নিপীড়িত, ক্ষিপ্ত, অধীরা, তাই সে আপন শরীরকে কভু বিরাট কখন অতল গভীর করিতে সমুৎসুক। ইহারা প্রত্যেকেই জাগিয়াছিল।
সীতারামের দেহের এক পাশে জ্যোতিষী অনন্তহরি বসিয়া পড়িলেন, ঠিক তাঁহার সম্মুখেই অন্যপার্শ্বে বিহারীনাথ। লক্ষ্মীনারায়ণ এখনও দণ্ডায়মান, কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ, ঈষৎ অপ্রস্তুত। এই হেতু যে তাঁহার মনে সংশয় ছিল, নিরাশাও ছিল, উপরন্তু উদ্বেগে বিনিদ্র শরীর বেপথুমান, কোন উপায়ে যে আপনাকে সুসংযত করিবেন তাহার ঠিক-ঠিকানা পাইতেছিলেন না, একদা সীতারামের যুদ্ধ-তিরোহিত নৈষ্কৰ্ম্মসিদ্ধ মুখোনি দেখিলেন, অন্যবার ভৌতিক গীতা-পাঠকের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করিতেই অহেতুক ত্রাসের সঞ্চার হইল।
এতদূর অগ্রসর হইয়া নিশ্চয়ই লক্ষ্মীনারায়ণ গীতা পাঠ শ্রবণে ত্রস্ত হন নাই, ইহার হেতু এই যে এইস্থানের একজনকে তিনি অবশ্যই এড়াইতে চাহিয়াছিলেন। তিনি বিহারীনাথ। বিহারীনাথ আয়ুৰ্বেদিক, বিহারীনাথ নাড়ীজ্ঞানী। প্রবৃদ্ধ সীতারামের নাড়ী ধরিয়া বসিয়া আছেন। প্রতিমুহূর্তের নিয়ত কর্মশীল জগত, একটি সূক্ষ্ম প্রতিউত্তরকে কায়মনোবাক্যে প্রত্যক্ষ করিতেছিলেন–এ-কৰ্মশীল জগতের যদিচ রূপ রস গন্ধ বর্ণ ইত্যাদি কোন অবস্থা নাই। ইহাদের আগমনে তাঁহার মনোযোগের কোন ব্যাঘাত ঘটে নাই।
এখন তিনি বিহারীনাথ মুখোনি তুলিতেই, বুঝা গেল তাঁহার চক্ষুৰ্ধয় আশ্চর্য স্ফীত, এবং সেই কালে লক্ষ্মীনারায়ণের প্রতি কঠোর তথা ঘৃণাভরে, আর জ্যোতিষী অনন্তহরির প্রতি শান্তভাবে দৃষ্টিপাত করিয়া মস্তক আন্দোলিত করেন; ইহা তিনি যেন একটি লোক-গল্প আরম্ভ করিবেন, তাহারই প্রস্তুতি; ইহার মধ্যে মীমাংসা ছিল, সিদ্ধান্তও বলবান।
বিহারীনাথ ইঙ্গিতে যে কথা স্বীকার করিলেন, তাহাতে জ্যোতিষীর দৈববুদ্ধি ও দূরদৃষ্টির চেতনা-মিলিত যে অস্তিত্ব, তাহা নিমেষেই অতিকায় হইয়া উঠিল, অন্তরে তাঁহার ঘনঘটা, বাহিরে গৰ্ব্বে, তাঁহার ব্রাহ্মণসুলভ চক্ষুর্ধয়, যাহা নক্ষত্রলোকের বিহার দর্শন করিয়াছে, উহা চকিতে ঝটিতি তড়িৎময় হইল। অনন্তর তাঁহার দক্ষিণ হস্তখানি উত্তোলিত হইয়া সদম্ভে সজোরে আঘাত করিতে গিয়াসহসা সীতারামের নাভির নিকট থামিয়া, ত্বরিতে সরিয়া খড়ের উপর পড়িল, ধর্ষিত খড় মসমস করিয়া উঠে। পরক্ষণেই, জয় উল্লাসে অথচ দৃঢ় ভারী সংযত স্বরে জ্যোতিষী কহিলেন, “জয় জগদম্বে বলুন কবিরাজ মশাই! বলুন, আমার গণনা ঠিক কি না? যথার্থ কি না!”
এ হেন প্রশ্নে নাড়ীজ্ঞানী বিহারীনাথ পুনৰ্ব্বার মাথা দোলাইয়া সম্মতি জানাইয়া, অতি সন্তর্পণে সীতারামের হাতখানি খড়ের উপরে রাখিলেন, এবং এই কাৰ্য্য করিতে তাঁহাকে কিঞ্চিৎ পিছনে সরিতে হয়। তদ্দর্শনে, এই সুযোগে লক্ষ্মীনারায়ণ সাহস সঞ্চয় করিয়া কোন মতে হাঁটু ভাঙ্গিয়া হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া পড়িলেন। বিহারীনাথ তাঁহাকে কঠিন ভাবে পলকের নিমিত্ত দেখিয়া, আপনকার ট্যাঁক হইতে নস্যের ডিবা বাহির করত কিঞ্চিৎ নস্য তালুতে ঢালিয়া, যুত করিয়া টিপ লইবার ছলে আপনাকে সংযতভাবে সামলাইয়া সশব্দে একটি টান দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার চক্ষু দিয়া খানিক জল নিঃসৃত হয় এবং এক নিমেষের আরাম উপভোগের পর কহিলেন, “আপনি যা বলেছিলেন তাই ঠিক।”
অনন্তহরি যারপরনাই আত্মহারা হইয়া বাঁকিয়া চুরিয়া একটি পায়ের উপর ভর দিয়া বসিলেন এবং খানিক, কি যেমন বা সীতারামের দেহের বিস্তৃতির মধ্যে খুঁজিবার কালে, হঠাৎ তাঁহার হস্তে সীতারামের এক সরল তেজোময় নিঃশ্বাস লাগিল, সন্ধ্যায় গৃহাভিমুখী রাখালেরা যে নিঃশ্বাস ফেলিয়া থাকে। তৎক্ষণাৎ মাতৃসুলভ চাহনিতে সীতারামকে দেখিয়া সহাস্য বদনে অবশেষে বিহারীনাথের কোলের নিকট যে হাতখানি সেইটি পলকে তুলিতে গিয়া ধীরতা অবলম্বনে আস্তে আস্তে মেলিয়া ধরিলেন।
বানরতুল্য টানা টানা দীর্ঘ সীতারামের বিশীর্ণ হাতখানির প্রতি সকলেই, দৃষ্টিক্ষম বলিয়াই, অন্যমনস্কতার সহিত লক্ষ্য করিয়াছিলেন। সেখানে সকালের রোদ একদা খরতর শ্বেত অন্যবার আঁধার, কেননা কীৰ্ত্তনের দল এখনও পরিক্রমণ করিতে ব্যর্থ, তাহারা নামগানে এখনও মুখর হাতখানি, চিরদিন নিদ্রালোককেই আহ্বান করিয়াছে, তাই ইহা বনবাসী তাপসচারীর হস্তের ন্যায় শুষ্ক, রসহীন। জ্যোতিষী। অনন্তহরি বৃদ্ধের হাতখানি লইয়া ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন। অনেকবার ইহার উপর দিয়া ধূমরাশি খেলিয়া দুমড়াইয়া বক্র হইয়া ভয়াবহ কুহক সৃষ্টি করিয়া চলিয়া গেল, ইতিমধ্যে তিনি বার বার আপনার হাত দিয়া বিশীর্ণ করতল মুছিলেন, পরে গভীর রেখা সমন্বয়ের দিকে, মনে হয় যেমন, অর্থাৎ আপনারই পরিশ্রম কৃতকর্মের প্রতি স্ফীত চক্ষে অবলোকন করত দেহকে স্বেচ্ছায় কাঁপাইতে লাগিলেন, যাহাতে যেমন দেহের সৰ্ব্বত্রে ছড়াইয়া পড়িয়াছে তাহাকে পুনরায় একত্রিত করিতে পারেন। এ সময় বিশীর্ণ রোগা অতি বৃদ্ধ হাতখানি চমকাইতেছিল।