অনন্তহরি এক প্রকার জোর করিয়া আপনাকে মুক্ত করিয়া বিরক্তি সহকারে উত্তর করিলেন, “আঃ খুড়ো, তুমি বৃথা বাক্যব্যয় করছ; ওরা, মানে…ছেলেরা, কুলপুরোহিত কৃষ্ণপ্রাণ এরা সবাই ত রাজী। শুধু বিহারীনাথ–অবশ্য তখন বুড়ো অবস্থা…বেগোড় হয়েছিল…”
“এখন তোমার কথা…” লক্ষ্মীনারায়ণ ইহাতে তাঁহাকে পুনরায় অনুরোধমাত্র করিয়াছিলেন।
“আমার? আমি ত নিমিত্ত…শিবের কলম…” বলিয়া জ্যোতিষী লক্ষ্মীনারায়ণের পদদলিত আঁকের দিকে চাহিলেন, যেখানে জীবনের কিছুটা ছিল, ব্রাহ্মমুহূর্তের প্রাকৃতিক শোভা যাহার আয়ু।
বৈজুনাথ তাঁহাদের যেন বা আপনার দ্বারদেশ হইতে দেখিয়াছিল, প্রিয়জন যেন বিদেশ যাত্রা করে। অল্পকাল পরেই, তাহার দৃষ্টি খসিয়া তাঁহাদের ছায়ার উপর পড়িবামাত্রই সঙ্গে সঙ্গেই, সারা গাত্রে তাহার আপনকার–নিম্ন শ্রেণীর আধা-নিরীহ পশুর ক্ষুব্ধ, অসংযত, মর্মভেদী যন্ত্রণার, বিলাপের, ক্রন্দনের হৃদয়বিদারক শব্দসমূহ ধ্বনিত হয়, এবং ইহা সে নিরীক্ষণমানসে চঞ্চল চিত্তে, একদা দেহের দিকে ক্রমে বাঁধপ্রতিম বাহুর প্রতি মহা উদ্বেগ লক্ষ্য করত অস্থির। একথা সত্য, অদ্যাবধি কোন রাত্রই তাহার দোয়াঁশা হইয়া দেখা দেয় নাই, কোনদিন তাহার হস্তরেখার খাত ছাড়িয়া, অন্যত্রে যায় নাই। এখন, অনন্তর সে ভয়ে তৃষ্ণার্ত হইয়াছিল।
অনন্যমনে সে এক রাত্রের মধ্যে, অর্থাৎ গতরাত্রে ভেড়ীপথ হইতে দেখিয়াছিল, স্রোতবিকার চন্দ্রালোক এবং বেলাতটে পরিক্রমণরত বৃত্ত, যাহাদের নামগান হিম বাতাসে কিয়ৎপরিমাণে দুষ্ট, উপরন্তু যখন তখন কাশির আওয়াজ সমস্ত কিছু অন্ধকারের বক্রোক্তির মত শুনাইতেছিল। বৈজুনাথ তদ্দর্শনে যারপরনাই ত্রস্ত, ফলে সীমাহীন হইয়া গিয়াছিল–এমত অবস্থায় তাহার সুন্দর চক্ষুদ্বয়ের সম্মুখে আধিদৈবিক ভোজবিদ্যার কৌশল চকিতে খেলিয়া যায়, অবলীলাক্রমে প্রতীয়মান হইল, ক্রমাগত পরিবর্তনশীল বৃত্তের তথা যেমত বা রাশমণ্ডলের কেন্দ্রে যে জন একটি অভিব্যক্তিমাত্র, সে যেন নিকটের আকাশে বারেক উঠানামা করিতেছে। বৈজুনাথ বিস্ময়ে অস্ফুট বচনে প্রশ্ন করিয়াছিল, ইহা কি সত্য! এই সীতারাম, কীৰ্ত্তনের দল, কাশির আওয়াজ, বেলাতট এ সকল কিছুই কি স্বপ্ন। দেহ-মায়াবন্ত বৈজুনাথ ভয়ে শঙ্কায় কেমন যেন হইয়া শিবার মত ধ্বনি করিয়া উঠিতে চাহিল; তদনন্তর এক মুহূর্ত ভেড়ীপথে না অতিবাহিত করিয়া সবেগে দৌড়াইয়া তখনও প্রজ্বলিত একটি চিতার নিকট আসিয়া, গ্রীষ্মকালীন দ্বিপ্রহরের কুকুরের মতই জিহ্বা প্রলম্বিত করত হাঁপাইতে লাগিল। বারবারই তাহার মনে হইতেছিল, বাঁচিয়া গিয়াছি। যদিচ একথার কোন যুক্তিপূর্ণ, আপাত দৃষ্টিতে, হেতু ছিল না। পুনরায় সে সুস্পষ্টরূপে ভাবিল, চিতার কাছে আসিয়া সে নিশ্চিত বাঁচিয়াছে। এবং কোনসূত্রে কিঞ্চিৎমনোবল সঞ্চয় করত স্পন্দনশীল রহস্যটিকে আর একবার দেখিয়াছিল। কিন্তু পলকের জন্য তাহার এ হেন অনাৰ্য্য বিমূঢ়তা ছাড়াইয়া, ইহা সহজ হইল না যে সত্যই উহা সুন্দর।
পুনৰ্বার বৈজুনাথ ফিরিয়া আসিয়াছিল। তখনও দুই ব্রাহ্মণ অগ্রসর হইতেছিলেন; উহাদের দেখিয়া সহসা তাহার মনে হইল, ইহাদের পদযুগল একজনেরও মাটিতে নাই, তাঁহাদের পিঠে রাত্র, তাঁহারা শীর্ণ, সূক্ষ্ম, স্বপ্নহীন। এবং এখন সে বেলাতটে ধর্ষিত আঁকের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিল, সেখানে একটি ক্ষুদ্রকায়া ব্যাঙ, এই শায়িত ব্রহ্মাণ্ডের উপর দিয়া লাফাইয়া লাফাইয়া চলিতেছে। এসময় তাহার কানে কাকুতি-মিনতির স্বর আসিতেছিল; সেই হেতু চক্ষুদ্বয় তুলিতেই সম্মুখে অদূরে স্পষ্ট হইল, দুই ব্রাহ্মণ তখনও দাঁড়াইয়া, একজন যেন বা কর্দমাক্ত প্রতি অঙ্গই অসম্ভব এলোমেলো, অন্যজন ক্রমান্বয়ে আশ্বাস দিতেছেন, এবং ইহাতে বৈজুনাথের অতীব ঔৎসুক্য দেখা দেয়। এখন, তাঁহারা চলিতে আরম্ভ করিলেন। পরিক্রমণরত বৃত্তাকার কীৰ্ত্তনের দলের নিকট আসিয়া লক্ষ্মীনারায়ণ থমকাইয়া গিয়াছিলেন; এখন এই দল থামিয়াছিল, কেননা ভঁহারা পথ করিয়া যাইবেন, ফলে দলটি পাশাপাশি দুলিতেছিল।
অনন্তহরি তাঁহাকে, লক্ষ্মীনারায়ণকে, একপ্রকার টানিয়া ভয়ঙ্কর বহর মধ্যে প্রবেশের পরক্ষণেই পুনরায় উচিতমত কীৰ্ত্তনের দল চলিতে লাগিল।
এই শ্যামা আরামহীন বহ-মধ্য প্রতিনিয়ত অক্ষ ঘর্ষণের বিকট কর্কশ বীভৎস রোমহর্ষক শব্দে মথিত; পূর্বেকার মত আর সকল কিছুই স্থির। ইহা অনেকাংশে মনে হয় সুগভীর কৃপ-নিম্নে আলোকপাত হইয়াছে, সেখানে জলস্তর আয়না, উপরিস্থিত আমাদের প্রতিবিম্ব দূরত্ব নিবন্ধে সবিশেষ আবছায়া; অন্যপক্ষে আকাশ প্রতিভাত, দেখা যায়, নির্ভুল সম্যক আর্থিক। আর সকল কিছুই স্থির, পত্রচ্যুত শিশিরবিন্দুর ন্যায় গঙ্গোদকের বিন্দুর শব্দ, স্তব্ধতা অনেকানেক সন্দিগ্ধতাকে জলদান করিয়া পুনরায় আত্মসাৎ করিতেছে, এবং একের ঐশ্বর্যশালী নক্ষত্রখচিত উপাধিসমূহ ধীরে অন্তর্হিত হয়।
তথাপি কীৰ্ত্তনের ধ্বনিমধ্যে কোন আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা নাই, তৎসহ গম্ভীর কণ্ঠে ‘গঙ্গা নারায়ণ ব্রহ্ম আবৃত্তি-উচ্চারণের ভীতিপ্রদ রেশ অদ্য সকালের স্বর্ণাভ তীক্ষ্ণ রৌদ্রে খেলনার মত নিরীহ। আর যে সমবেত জনমণ্ডলীর চোখেমুখে–যাঁহারা আসীন তাঁহাদের মুখমণ্ডলে–কেশে, ভস্মকণা যায়, অনিবাৰ্যতাকে লইয়া ইহারা প্রহর জাগিয়াছে, ভূতপূজকদের মত ঘঁহারা একনিষ্ঠ বিশ্বাসী; গ্রন্থি নির্মাণের মধুর, সুচতুর, মনোরমা, দিব্য, ছবিলা, চারুকলা-সুকুমার কৌশলখানি মহা ঘোরে বিমোহিত আচ্ছন্ন, ইহা সত্ত্বেও এই মরজগত হইতে অতীব প্রাচীন যে বীজময় শরীর তাহা নির্লজ্জ উন্মুখ, মৃত্যু মৃত্যু মৃত্যুকে তাহা নিতান্ত অবহেলায় চপলমতি বালকের মত তুড়ি মারিতেছিল; প্রত্যেকের মনে ইদানীং বাস্তবতাকে শ্মশানের ক্ষিপ্রতাকে অগ্রাহ্য করত আপন আপন গৃহকোণের প্রতিচ্ছবি চিত্রিত হইয়াছিল।